বেকারত্ব একটি বৈশ্বিক সমস্যা হলেও উন্নয়নশীল দেশগুলোয় এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তরুণদের জন্য চাকরির বাজার ক্রমেই প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠছে। শিক্ষিত তরুণরা উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পরও চাকরি পাচ্ছেন না, অন্যদিকে অনেক দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তি সহজেই জীবিকা নির্বাহ করতে পারছেন। এ পরিস্থিতিতে বেকারত্ব কমানোর মূল চাবিকাঠি কি শিক্ষা, নাকি দক্ষতা?
শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড—এ কথা সবাই জানি। একটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। তবে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা কি বেকারত্ব নিরসনে যথেষ্ট? এ প্রসঙ্গে কয়েকটি দিক আলোচনা করা যেতে পারে। শিক্ষার মূল লক্ষ্য একজন ব্যক্তিকে জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীল করা। সাধারণত শিক্ষিত জনগোষ্ঠী উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে বেশি অবদান রাখে। তবে শুধু সার্টিফিকেটভিত্তিক শিক্ষা একজন ব্যক্তিকে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা দিতে পারে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, শিক্ষিত তরুণরা উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেও কর্মসংস্থান খুঁজে পাচ্ছেন না। তার প্রধান কারণ হলো—তাদের অর্জিত জ্ঞান বাস্তব জীবনের চাহিদার সঙ্গে মিলছে না। শুধু একাডেমিক জ্ঞান থাকলেই কর্মসংস্থান হয় না; প্রয়োজন বাস্তব দক্ষতা। বর্তমান চাকরির বাজারে প্রযুক্তিগত দক্ষতা ও সৃজনশীলতা বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। তাই শিক্ষাব্যবস্থায় তথ্যপ্রযুক্তি, গবেষণা, উদ্যোক্তা উন্নয়ন এবং নতুন কর্মসংস্থান তৈরির বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। এক্ষেত্রে কারিগরি শিক্ষা, ভোকেশনাল ট্রেনিং এবং অনলাইন শিক্ষার প্রসার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
শুধু প্রথাগত শিক্ষার ওপর নির্ভর না করে দক্ষতা অর্জন করলে চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতা কমে যায়। বর্তমান বিশ্বে দক্ষ জনশক্তির চাহিদা ব্যাপক। যেমন, প্রোগ্রামিং, ডিজিটাল মার্কেটিং, গ্রাফিক ডিজাইন, কারিগরি দক্ষতা, ভাষা দক্ষতা ইত্যাদি অনেক ক্ষেত্রে প্রচলিত শিক্ষার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। শুধু ডিগ্রির ওপর নির্ভরশীল না থেকে একজন ব্যক্তি দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে নিজেই উদ্যোক্তা হতে পারে। এটি শুধু নিজেকে স্বনির্ভর করে না; বরং অন্যদের জন্যও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে। বর্তমানে বিভিন্ন দেশ দক্ষতা উন্নয়নের ওপর জোর দিচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারও বিভিন্ন প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামের মাধ্যমে দক্ষ কর্মী তৈরি করার উদ্যোগ নিয়েছে। অনলাইন প্ল্যাটফর্মেও দক্ষতা উন্নয়নের সুযোগ রয়েছে।
শিক্ষা ও দক্ষতা উভয়ই গুরুত্বপূর্ণ। তবে বর্তমান বাস্তবতায় দক্ষতার গুরুত্ব ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। কয়েকটি দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যেতে পারে—শিক্ষা একটি মৌলিক প্রয়োজন হলেও শুধু সার্টিফিকেট বা ডিগ্রির ওপর নির্ভরশীল হওয়া যুক্তিযুক্ত নয়। বাস্তব অভিজ্ঞতা ও হাতে-কলমে শেখা দক্ষতা ছাড়া কর্মসংস্থান সম্ভব নয়। বিগত দশকে চাকরির বাজারে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। প্রযুক্তিগত দক্ষতা, সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা, যোগাযোগ দক্ষতা ও উদ্ভাবনী চিন্তাধারা এখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যারা সময়ের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষতা অর্জন করছে, তাদের চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সর্বোত্তম সমাধান হলো—শিক্ষার পাশাপাশি দক্ষতা অর্জন করা। যদি কেউ একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি বাস্তব দক্ষতা অর্জন করে, তবে তার কর্মসংস্থানের সুযোগ বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে।
শিক্ষা ও দক্ষতা একসঙ্গে উন্নত করা যায় যেমন—শিক্ষাব্যবস্থায় দক্ষতা উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণ সংযোজন, কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষার প্রসার ঘটানো, শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে কাজের সুযোগ দেওয়া, উদ্যোক্তা উন্নয়নে সহায়তা প্রদান, ডিজিটাল স্কিল ও প্রযুক্তিগত শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেওয়ার দরকার হয়।
বেকারত্ব কমানোর জন্য শুধু ডিগ্রি অর্জন যথেষ্ট নয়, বরং দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জনও সমান গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান সময়ে যুগে চাকরির বাজারের চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে এদিকে মনোযোগ বাড়াতে হবে। সরকার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিপর্যায়ে উদ্যোগ নিলে বেকারত্ব কমানো সম্ভব হবে এবং দক্ষ জনশক্তি তৈরির মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হতে পারে।
জাফরিন সুলতানা
শিক্ষার্থী, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন