আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্রে আকাশে ঘটছে এক নীরব বিপ্লব। ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে দক্ষিণ ককেশাসের নাগোর্নো-কারাবাখ সংঘাত পর্যন্ত সাম্প্রতিক বিভিন্ন যুদ্ধে ড্রোনের দাপট নজরে পড়ছে। ইউক্রেনে হাজার হাজার সস্তা মনুষ্যবিহীন ড্রোন রাশিয়ার অগ্রগতিকে রুখে দিয়েছে; ২০২৫ সালের শুরুর দিকে যুদ্ধক্ষেত্রে রুশ সরঞ্জাম ধ্বংসের ৬০-৭০ শতাংশ ক্ষয়ক্ষতিই ঘটছিল এ ড্রোনগুলোর মাধ্যমে। অন্যদিকে, ২০২০ সালের আজারবাইজান-আর্মেনিয়া যুদ্ধেও আজারবাইজান ব্যাপকভাবে তুরস্ক ও ইসরায়েলের তৈরি ড্রোন ব্যবহার করে আর্মেনিয়ার ট্যাঙ্ক ও এস-৩০০ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করে বিজয় ছিনিয়ে নেয়।
মধ্যপ্রাচ্যেও একই চিত্র। ইরান ও ইসরায়েলের বিরোধে ড্রোন আক্রমণ ও প্রতিরক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ইসরায়েল দাবি করেছে, সাম্প্রতিক সংঘাতে তারা ইরানের প্রায় ৯৫০টি ড্রোন আকাশে উৎক্ষেপণের আগেই ধ্বংস করতে সক্ষম হয়েছে। অন্যদিকে ইরান তার সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোর হাতে নানা ধরনের আক্রমণক্ষম ড্রোন সরবরাহ করছে, যা মোকাবিলায় ইসরায়েল তাদের বিখ্যাত আয়রন ডোম ব্যবস্থাকে ড্রোন ঠেকানোর উপযোগী করে পুনর্গঠন করেছে। শুধু তাই নয়, ইউক্রেন যুদ্ধের অভিজ্ঞতায় তাইওয়ান থেকে ইউরোপ—সবাই দ্রুত ড্রোন ও প্রতিড্রোন প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে।
পর্যবেক্ষণ ও আক্রমণে ড্রোনের বাড়তি ভূমিকা
একসময় আকাশ থেকে নজরদারি চালানো বা শত্রুর স্থাপনায় হামলা করতে মানবচালিত বিমান ছিল প্রযুক্তিগত সহায়ক মাত্র। কিন্তু এখন অনেক ক্ষেত্রেই মনুষ্যবিহীন ড্রোন ঐতিহ্যবাহী যুদ্ধবিমানের বিকল্প হয়ে উঠছে। সীমিত পরিসরে ছোট ড্রোন দিয়ে রিকনিস্যান্স থেকে শুরু করে লক্ষ্যবস্তুতে নির্ভুল আঘাত হানা সম্ভব হচ্ছে। এতে মানব পাইলটকে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় পাঠানোর দরকার কমে যাচ্ছে। আধুনিক গতিশীল আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে মূল্যবান মানবচালিত যুদ্ধবিমান পাঠানো ক্রমেই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ছে; তুলনায় সস্তা ড্রোন দিয়ে কাছ থেকে হামলা বা নজরদারি করানো অনেক নিরাপদ ও কার্যকর।
ড্রোন ব্যবহারের সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে কম খরচে বেশি ফল পাওয়া। কিয়েভের সামান্য ৪০০ ডলারের বাণিজ্যিক ড্রোনও এখন হাজার গুণ দামি রুশ ট্যাঙ্ক বা সাঁজোয়া যানকে ধ্বংস করে দিতে পারছে। একই সঙ্গে ড্রোন হারালে পাইলট নিহত বা বন্দি হওয়ার ঝুঁকি নেই, যা যুদ্ধে মনোবল ও জনমত দুদিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ। ফলে যেসব মিশনে আগে পাইলটসহ যুদ্ধবিমান পাঠাতে দ্বিধা ছিল, সেখানে নির্বিঘ্নে ড্রোন পাঠানো যাচ্ছে। দীর্ঘসময় আকাশে থেকে নজরদারি চালানো, শত্রুর অবস্থান চিহ্নিত করা এবং সুনির্দিষ্ট ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো—এসব কাজেই এখন ড্রোন অগ্রণী ভূমিকা নিচ্ছে।
একইভাবে মার্কিন MQ-9 রিপার কিংবা ইসরায়েলি হেরনের মতো ড্রোনগুলো সন্ত্রাসবাদবিরোধী অভিযানে সম্ভাব্য টার্গেটে নজরদারি ও আঘাত হানার কাজে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, সম্পূর্ণরূপে মানবচালিত যুদ্ধবিমান হয়তো শিগগিরই বিলুপ্ত হচ্ছে না। তবে বিভিন্ন মিশনে ধীরে ধীরে ড্রোনের ওপর নির্ভরতা বাড়ছে। ড্রোন এখন আর শুধু অতিরিক্ত সহযোগী নয়; অনেক ক্ষেত্রে প্রধান আঘাতকারী শক্তি হিসেবেই পরিকল্পিত হচ্ছে।
পাইলটবিহীন ভবিষ্যৎ: স্বয়ংক্রিয় ঝাঁক ও এআই: আগামী দিনের বিমানবাহিনীতে মানুষচালিত ফাইটার জেটের ভূমিকা কী হবে, তা নিয়ে জোর আলোচনার সূচনা হয়েছে। বর্তমান বাস্তবতা বলছে, আগামীতে হয়তো আকাশযুদ্ধে মানব পাইলটের সংখ্যা কমে যাবে এবং তারা সরাসরি লড়াইয়ের বদলে রিমোট কন্ট্রোল বা মিশন কমান্ডারের ভূমিকায় বেশি থাকবে। ‘মানব-রোবট টিমিং’ নামের ধারণা অনুযায়ী, পাইলটসমৃদ্ধ একটি নেতৃত্বপূর্ণ যুদ্ধবিমান কয়েকটি স্বয়ংক্রিয় ড্রোনকে নির্দেশনা দিয়ে সংঘবদ্ধভাবে মিশন পরিচালনা করবে। এসব ড্রোন হবে ‘লোয়াল উইংম্যান’। তারা নিজস্ব কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবস্থার সাহায্যে পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে, তবে চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণে থাকবেন মানব কমান্ডার।
স্বচালিত এ ড্রোনগুলোর অন্যতম সুবিধা হলো অত্যন্ত দ্রুত প্রতিক্রিয়া ও নির্ভুল সমন্বয় সাধন, যা মানব পাইলটের পক্ষে সবসময় সম্ভব নয়। শত্রুপক্ষের রাডার ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ফাঁকি দিতে ড্রোনঝাঁক একসঙ্গে বিভিন্ন দিক থেকে আক্রমণ চালাতে পারে। মার্কিন সেনাবাহিনী এমন সফটওয়্যার ও নেটওয়ার্ক উন্নয়নে কাজ করছে, যা একসঙ্গে ‘শত শত হাজার’ ড্রোন ও স্বয়ংক্রিয় প্ল্যাটফর্মকে সমন্বিতভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হবে। একঝাঁকে অসংখ্য ড্রোন হামলে পড়লে সবচেয়ে উন্নত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকেও চাপের মুখে ফেলা সম্ভব, কারণ প্রতিটি ড্রোন ধ্বংস করা প্রতিপক্ষের পক্ষে কঠিন হয়ে যাবে।
মানুষ ছাড়া বিমান মানে প্রশিক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচেও বিরাট সাশ্রয় হবে বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের। যেমন, মার্কিন বিমানবাহিনী হিসাব করে দেখছে যে, স্বশিক্ষিত কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত ড্রোনের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ ওড়ান চালানোর প্রয়োজন হবে না, যা বর্তমানে বাস্তব বিমানে পাইলটদের দক্ষ রাখতে ঘন ঘন চালাতে হয়। তা ছাড়া ৩০-৫০ বছর টিকে থাকে এমন টেকসই জেট বিমান বানানোর বদলে স্বল্পায়ু কিন্তু সস্তা ড্রোন বিপুল সংখ্যায় বানিয়ে ক্ষয়ক্ষতি মেনে নেওয়া যেতে পারে। এতে করে একদিকে পাইলট ও বিমানের প্রতি ইউনিট খরচ কমবে, অন্যদিকে একই বাজেটে বেশি সংখ্যক আকাশযান পাওয়া যাবে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) এই নতুন প্রজন্মের ড্রোনকে আরও প্রাণবন্ত করে তুলেছে। উন্নত সেন্সর, ডাটা লিঙ্কের মাধ্যমে ড্রোনগুলো নিজেদের মাঝে তাৎক্ষণিক তথ্য বিনিময় করে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আকাশে তারা একে অন্যের সঙ্গে মিলে শত্রুর অবস্থান চিহ্নিত, লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ এবং এমনকি স্বয়ংক্রিয়ভাবে আক্রমণ চালাতে পারবে বলে আশা করা হচ্ছে। যেমন, যুক্তরাষ্ট্রের পরীক্ষামূলক XQ-58A ‘ভ্যালকিরি’ ড্রোনকে এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যাতে এটি মানবচালিত F-35 বা ভবিষ্যৎ জঙ্গিবিমানের সঙ্গে উড়তে উড়তে নিজের বুদ্ধিমত্তায় শত্রুপক্ষের ওপর আঘাত হানতে পারে।
কৌশল ও নিরাপত্তা ব্যবস্থায় বদল: ড্রোনকেন্দ্রিক বৈপ্লবিক এ পরিবর্তন সামগ্রিক সামরিক কৌশল ও বৈশ্বিক নিরাপত্তা প্রেক্ষাপটেও প্রভাব ফেলছে। প্রথমত, আকাশে আধিপত্য বজায় রাখার সংজ্ঞা বদলে যাচ্ছে। শুধু উন্নততম ফাইটার জেট থাকার চেয়ে এখন কে কত উন্নত ড্রোন প্রযুক্তি ও কাউন্টার-ড্রোন ব্যবস্থা রাখছে, তাই বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, অনেক ছোট দেশ বা গোষ্ঠীও এখন সস্তা ড্রোন সংগ্রহ করে আকাশ থেকে আঘাত হানার সক্ষমতা অর্জন করছে, যা আগে শুধু ক্ষমতাধর দেশগুলোর হাতে ছিল। এর উদাহরণ ইয়েমেনে ইরান-সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীদের ড্রোন দিয়ে সৌদির তেল স্থাপনায় আক্রমণ বা গাজায় সহজলভ্য ড্রোন দিয়ে ইসরায়েলকে বিপাকে ফেলা। এই ‘সুলভ এয়ারফোর্স’ ধারণা বড় শক্তিকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে।
যদিও ড্রোনের বিস্তারে যুদ্ধক্ষেত্রে মানুষের প্রাণঝুঁকি কমছে, কিন্তু বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন যে, এর ফলে যুদ্ধ শুরু করার প্রবণতা কিছুটা বাড়তে পারে; কারণ নিজের পক্ষের বড় ধরনের প্রাণহানি ছাড়াই শত্রুপক্ষকে আঘাত করা সম্ভব হচ্ছে। তা ছাড়া, ড্রোন দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত (এমনকি পারমাণবিক) স্থাপনায় আঘাত হানার আশঙ্কা বেড়েছে, যা ভুল হিসাবনির্ভর বড় সংঘাতের শঙ্কা বাড়াচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষকরা মনে করছেন যে, ভারত যদি ঝাঁক ড্রোন ও নির্ভুল ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে পাকিস্তানের পারমাণবিক বাহকগুলোকে আগে থেকে ধ্বংস করার সক্ষমতা অর্জন করে, তবে তা পারমাণবিক প্রতিরোধ নীতি দুর্বল করতে পারে। আবার প্রতিপক্ষও ড্রোন-মিসাইল সমন্বয়ে প্রতিরক্ষা ভেদ করার কৌশল নেবে। ফলে দুপক্ষের মধ্যে আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণের উদ্বেগ বাড়বে।
ফলশ্রুতিতে আকাশযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এক নতুন অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে, একদিকে শক্তিধর দেশগুলো আরও উন্নত ড্রোন ও AI প্রযুক্তি উদ্ভাবনে ঝাঁপাচ্ছে, তেমনি এগুলো ঠেকানোর জন্য লেজার অস্ত্র, শক্তিশালী রাডার ও জ্যামিং প্রযুক্তিতেও বিনিয়োগ বাড়ছে। কেউ একটি ড্রোনের ঝাঁক তৈরি করলে, প্রতিপক্ষ তা ভূপাতিত করতে ডজন ডজন আকাশ-প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র প্রস্তুত রাখছে; তার জবাবে প্রথম পক্ষ আনছে আরও দ্রুতগতির স্টেলথ মনুষ্যবিহীন ড্রোন। এভাবে ক্রমশ একটি নতুন প্রতিযোগিতামূলক ভারসাম্য গড়ে উঠছে।
বিমানবাহিনীর ধারণা এখন মৌলিকভাবে পরিবর্তনের পথে। প্রতিযোগিতা এখন আর শুধু মানুষ বনাম যন্ত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং কোন পক্ষ পাইলটের মস্তিষ্ক ও এআইর গণনাশক্তির সর্বোত্তম সমন্বয় ঘটিয়ে তা কৌশলে প্রয়োগ করতে পারে, সেটাই নির্ধারক বিষয়। আধুনিক যুদ্ধবিমানের ককপিট থেকে শুরু করে পুরো সেনানিবাসের সদর দপ্তর পর্যন্ত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও মনুষ্যবিহীন সিস্টেমের প্রভাব বিস্তৃত হচ্ছে। হয়তো সামনের দিনগুলোতে আকাশে মানুষের হাতের নিয়ন্ত্রণে থাকা ফাইটার কম আর প্রোগ্রাম করা ড্রোনের দলই বেশি দেখা যাবে। তারপরও মানুষ পুরোপুরি ছিটকে যাবে না; মানুষই কৌশল নির্ধারণ করবে; কমান্ডার হিসেবে সিদ্ধান্ত নেবে আর তার বাহন হয়ে কাজ করবে অসংখ্য নির্ভুল ড্রোন ও রোবট সহচর। আকাশযুদ্ধে এ যুগান্তকারী পরিবর্তন এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে, যার প্রভাব আগামী দশকগুলোতে বিশ্ব নিরাপত্তা ও যুদ্ধনীতিতে গভীরভাবে অনুভূত হবে।
লেখক: কবি ও সাংবাদিক
মন্তব্য করুন