মোজাম্মেল হক তারা
প্রকাশ : ০৩ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ০৩ জুলাই ২০২৫, ০৭:৫৪ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ইরান ও ট্রাম্পের নেমেসিস

ইরান ও ট্রাম্পের নেমেসিস

কণ্ঠনালির ওপর চেপে বসা ছুরি আলগা হলে যেমন বোধ হয়, যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল-ইরানের যুদ্ধ অবসানে সারা বিশ্বে স্বস্তির নিঃশ্বাস। যুদ্ধের ঘন কালো মেঘ ক্রমেই বিস্তৃত হচ্ছিল। আপাতত তা অন্তর্হিত।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভক্তদের মত হচ্ছে, ২০২৬ সালের শান্তির জন্য নোবেল পাওয়ার একমাত্র দাবিদার তিনি। হোয়াইট হাউসের বাসিন্দা নিজেও মনে করেন, এ মনিহার শুধু তাকেই সাজে। মিস্টার ট্রাম্পকে যারা জানেন তারা স্বীকার করবেন, নোবেল পুরস্কারের প্রতি দুর্বলতা শুধু বাঙালির, এটি অপবাদ। কালো গাত্রবর্ণের যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাই ট্রাম্পের প্রকৃত অ্যান্টিথিসিস, বাইডেন নন। মার্কিন রাজনীতির আকাশে ডোনাল্ড ট্রাম্প নামের তারকার উদয় ‘বার্থার মুভমেন্ট (Birther movement)’ নামে পরিচিত ওবামাবিরোধী আন্দোলনের কণ্ঠস্বর হিসেবে। যার মূল বক্তব্য ছিল, মুসলিম পিতার মুসলিম সন্তান জন্মসূত্রে কেনিয়ার নাগরিক গুপ্ত কমিউনিস্ট বারাক হোসেন ওবামা নামের মধ্যম অংশ ও ধর্ম পরিচয় গোপন রেখে আমেরিকার জনগণকে ধোঁকা দিয়ে হোয়াইট হাউসের বাসভবনটি দখল করেছেন। ওবামা ‘নোবেল’ নামের পুরস্কারটিও হস্তগত করেছিলেন। সেই থেকে ট্রাম্পের সাদা ভোটাররা এ পুরস্কারটি মাছের চোখ অর্থাৎ লক্ষ্যবস্তু করেছেন। কালো থেকে সাদা পিছিয়ে থাকবে তা হতে পারে না। এই বিবেচনায় নোবেল পুরস্কারের ওপর মিস্টার ট্রাম্পের দাবি বোধগম্য। তবে গাজায় গণহত্যার জন্য অভিযুক্ত ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকেও নোবেল কমিটির ভুলে যাওয়া উচিত হবে না। কেননা যুদ্ধ ও যুদ্ধবিরতি দুক্ষেত্রেই তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট মিস্টার ট্রাম্পের সহযোগী। ট্রাম্পের ভাষায়, তারা অভিন্ন একটি দল।

বিশেষজ্ঞদের ধারণা, মি. ট্রাম্প গত মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্র-ইরান যুদ্ধের বীজটি নিজ হাতে বপন করেছিলেন। ২০১৫ সালে ওবামা প্রশাসন ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক প্রযুক্তিবিষয়ক একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল, এর আনুষ্ঠানিক নাম জয়েন্ট কমপ্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন (JCPOA)। চুক্তির উদ্দেশ্য ছিল ইরানের পারমাণবিক প্রযুক্তি কর্মসূচির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত করা, যেন তা অস্ত্র তৈরির দিকে ঝুঁকে না পড়ে। চুক্তির স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও ব্রিটেন, ফ্রান্স, চীন, রাশিয়া ও জার্মানি অন্তর্ভুক্ত (P5+1) ছিল। চুক্তি অনুযায়ী, ইরান মজুতসমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের ৯৮ শতাংশ হ্রাস, ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ ৩.৬৭ শতাংশ সীমারেখা অতিক্রম না করা, সেন্ট্রিফিউজের নাম্বার হ্রাস, আরাক ভারী পানি রিঅ্যাক্টরের নকশা বদল এবং আন্তর্জাতিক পরিদর্শক দলের তদন্ত ও পর্যবেক্ষণের অধিকার মেনে নেয়। বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাতিসংঘের পক্ষ থেকে অর্থনৈতিক অবরোধ তুলে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়।

এ পর্যন্ত সবই ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু নির্বাচন জিতে হোয়াইট হাউসে প্রবেশের পর ট্রাম্প গোঁ ধরলেন, চুক্তির সবই ভুলবাল, চুক্তির একমাত্র সুবিধাভোগী ইরান। চুক্তির মাধ্যমে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে, দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি এবং স্থানীয় মিলিশিয়াদের সামরিক প্রশিক্ষণ ও সশস্ত্র সহায়তার মাধ্যমে ইরানের আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের বিষয়টি ওবামা প্রশাসন উপেক্ষা করেছে। কাজেই ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৮ সালের মে মাসে একতরফাভাবে বহুপক্ষীয় চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নাম প্রত্যাহার করলেন। তিনি ইরানের জ্বালানি তেল রপ্তানি, বাণিজ্য, ব্যাংকিং ও পরিবহনের ওপর কঠিনতর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করলেন। সন্দেহের অবকাশ নেই, চুক্তিটি নস্যাৎ করার নেপথ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী ইসরায়েল সমর্থক ইহুদি লবির সক্রিয়তা এবং মন্ত্রণাদাতা ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী মিস্টার নেতানিয়াহু। পূর্বানুমান সপ্রমাণ করে ইরান এর জবাবে উঁচু হারে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের কর্মসূচি গ্রহণ করে এবং নতুন পারমাণবিক স্থাপনা তৈরিতে হাত দেয়। অর্থনৈতিক অবরোধ থেকে মুক্তিলাভে দরকষাকষির জন্য ইরানের অন্য বিকল্প ছিল না। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে যৎকিঞ্চিৎ মৌখিক সমালোচনা বাদ দিলে চুক্তির অনুস্বাক্ষরকারীদের সমষ্টিগত ভূমিকা শূন্য।

২০২৪ সালে হোয়াইট হাউসে বসবাসের অধিকার ফিরে পেয়ে মিস্টার ট্রাম্প যে ইরান পরিস্থিতির মুখোমুখি হলেন, সেটি ২০১৫-এর জয়েন্ট কমপ্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন স্বাক্ষরপূর্ব পরিস্থিতি। মিস্টার ওবামা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে বোতলবন্দি করার চেষ্টা করেছিলেন। মি. ট্রাম্পের প্রকৃত কৃতিত্ব এটুকু, তিনি বোতলকে ছিপিমুক্ত করেছেন। কাজেই তৎপর হওয়া ছাড়া ট্রাম্পের উপায় ছিল না। নিজের কর্মদোষে বোতলমুক্ত দৈত্যকে পুনরায় বোতলে ঢোকানোর দায় তার কাঁধে চেপেছে। তিনি প্রথমে আলোচনা ও দরকষাকষির সড়কে ছিলেন। কিন্তু সুচতুর নেতানিয়াহু ইরানের বিরুদ্ধে সরাসরি হামলা করে তার চেষ্টা ভেস্তে দেন। বিপর্যস্ত স্থানীয় সহযোগী ও বৈদেশিক সহায়তাশূন্য অপ্রস্তুত ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের আকস্মিক হামলার প্রারম্ভিক কৃতিত্বে উজ্জীবিত অস্থিরমতি মিস্টার ট্রাম্প বাহাদুরিতে ভাগ বসানোর জন্য কূটনৈতিক পন্থা পরিহার করে নেতানিয়াহুর যুদ্ধসঙ্গী বনে গেলেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তার যুদ্ধাভিযানের ফল কী? কী অর্জন করলেন?

যুদ্ধোত্তর ইরানের পারমাণবিক স্থাপনার ক্ষয়ক্ষতির মূল্যায়নে মার্কিন বিশেষজ্ঞরা দ্বিধাবিভক্ত। অনেকের মতে, ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের কারখানা ফোরদোর প্রবেশপথ পাতাল টানেল ধ্বংস হলেও মূল কাঠামো অটুট। নাতাঞ্জেও ঘটনা প্রায় একইরকম। ইসরায়েলের আক্রমণে সেখানে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়েছিল। মার্কিন বোমা হামলায় উপরিভাগের অবকাঠামো ধ্বংস হয়েছে। কিন্তু দুই জায়গায় কাঠামো পুনর্নির্মাণ এবং সেন্ট্রিফিউজ ও পারমাণবিক চুল্লিগুলো দ্রুত চালু করা সম্ভব। ইসফাহানে নবনির্মিত তরল ইউরেনিয়ামকে অস্ত্র ব্যবহারের উপযোগী ধাতুতে রূপান্তরের কারখানাটি যদিওবা ধ্বংস হয়েছে, কিন্তু এ ধরনের গোপন একাধিক কাঠামোর অস্তিত্ব সম্ভব।

বিশেষজ্ঞভেদে মত হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের হামলার ফলে ইরানের পারমাণবিক প্রযুক্তি কয়েক মাস থেকে কয়েক বছর পিছিয়ে যাবে। কিন্তু সবাই একটি ব্যাপারে সমান উদ্বিগ্ন, জানামতে ইরানের কাছে ৬০ শতাংশসমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের পরিমাণ ছিল ৪০০ কেজি। ধারণা করা হচ্ছে, হামলার আগে ইরান তা নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থার প্রধান গ্রোসির বক্তব্য হচ্ছে, নজরদারি এড়িয়ে বহনযোগ্য ধাতব পাত্রে সংরক্ষিত ইউরেনিয়াম সরিয়ে নেওয়ার জন্য দশটি মাত্র প্রাইভেট কারের ট্যাঙ্কই যথেষ্ট। এ অবস্থায় আর কিছু না হলেও ট্রাম্প প্রশাসনকে ইউরেনিয়াম বিষয়ে মনস্থির ও ইরানের সঙ্গে আলোচনায় বসতে হবে।

ফের আলোচনা, ফের দরকষাকষি। এ যেন যেখান থেকে শুরু করেছিলেন, মিছে ছোটাছুটি করে হয়রান হয়ে সেখানেই আবার ফেরত আসা। অথচ এরই মধ্যে মিস্টার ট্রাম্পের নির্দেশে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ব্যয়বহুল বিলিয়ন ডলারের বি২ বিমান যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিরতিহীনভাবে উড়ে গিয়ে ১৪টি বাস্টার বোমা নিক্ষেপ করেছে ইরানে, যার প্রতিটির মূল্য কয়েকশ মিলিয়ন ডলার। সাবমেরিন থেকে ছোড়া হয়েছে ২৪টি টমাহক ক্রুজ মিসাইল। হামলায় যুক্ত ছিল ১২৫টি এয়ারক্রাফট, চালকবিহীন ড্রোন, বিমানবাহী রণতরী, ডেস্ট্রয়ার ও ফ্রিগেট ইত্যাদি। সব মিলিয়ে যেমনি এলাহি কাণ্ড, তেমনি খরচের ব্যাপার কিন্তু জমার ঘরে অঙ্ক অনিশ্চিত। বিশ্বযুদ্ধের ঝুঁকি গ্রহণ ও ব্রিঙ্কম্যানশিপ (Brinkmanship) সম্পূর্ণ বিফল।

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ওবামা সম্প্রতি একটি তাৎপর্যপূর্ণ উক্তি করেছেন, ‘মধ্যপ্রাচ্য আণবিক অস্ত্রমুক্ত এলাকায় পরিগণিত হওয়া উচিত এবং ইসরায়েলও এর অন্তর্ভুক্ত।’ প্রকৃতপক্ষে মধ্যপ্রাচ্যে একমাত্র পারমাণবিক শক্তি ইসরায়েল। ফেডারেশন অব আমেরিকান সায়েন্টিস্টের মতে, ইসরায়েলের পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা হতে পারে ৯০ থেকে ১০০টি। ২০০টি পারমাণবিক বোমা তৈরির উপযোগী ফিসাইল মেটেরিয়াল অর্থাৎ সমৃদ্ধ উপকরণ তাদের কাছে মজুত আছে। ১৫০০ কিলোমিটার দূরত্ব থেকে শুরু করে ১১৫০০ কিলোমিটার দূরে ভূমি থেকে উৎক্ষেপণের জন্য রয়েছে আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র জেরিকো ২ ও ৩। রয়েছে বোমা নিক্ষেপ উপযোগী যুদ্ধবিমান এফ-১৫১, এফ ১৬১ ও এফ ৩৫। চাইলে ডলফিন ক্লাশ সাবমেরিন থেকে পপেই টারবো মিসাইলের মাধ্যমে পারমাণবিক বোমা ছুড়তেও তারা সক্ষম। এ সক্ষমতার গালভরা ডাকনাম নিউক্লিয়ার ট্রায়াড, অর্থাৎ ভূমি, আকাশ ও সাগর থেকে পারমাণবিক হামলা চালানোর ক্ষমতা।

অথচ একটি মাত্র ভায়াল পরিমাণ ইউরেনিয়ামের ছুতো ধরে গণবিধ্বংসী অস্ত্র তৈরির মিথ্যে অভিযোগে ইরাককে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল। আসাদ পারমাণবিক প্রযুক্তি আয়ত্তের চেষ্টা করছেন, এ অভিযোগে হামলা চালিয়ে সিরিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস করেছে ইসরায়েল। শেষ পর্যন্ত আসাদ বিতাড়িত হয়েছেন। গাদ্দাফির অপরাধ ছিল পশ্চিমা শক্তির চাপের মুখে তিনি পারমাণবিক বোমা তৈরির চেষ্টা পরিত্যাগ করে মজুত ইউরেনিয়াম ফেরত দিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার কাছে। ওবামা তার শুভেচ্ছার প্রত্যুত্তর দিয়েছেন, বিদ্রোহীদের রক্ষায় লিবিয়ার বৈধ সরকারি বাহিনীর ওপর যথেচ্ছ বিমান হামলা চালিয়ে। মুয়াম্মের গাদ্দাফিও নিজেকে রক্ষা করতে পারেননি। পেছন পানে ফিরে তাকালে ফলাফল স্পষ্ট, মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের একচ্ছত্র পারমাণবিক ক্ষমতা নিশ্চিত করা হয়েছে। উল্লেখ্য, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ইসলামী বিপ্লবের সন্তান নয়। এ পথে প্রথম পা বাড়িয়ে ছিলেন মার্কিনপন্থি রেজা শাহ, ইসরায়েলের মতো শাহের পারমাণবিক কর্মসূচির ব্যাপারেও পশ্চিমা শক্তি সম্পূর্ণ নীরব ছিল। বস্তুত ইসরায়েল ও ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির জন্ম সহোদর হিসেবে, প্রযুক্তি বিষয়ে দ্বিক্ষীয় গোপন লেনদেন ও সহযোগিতা চালু ছিল। সে সময় ইরানের শাহ এবং ইসরায়েলের অভিন্ন শত্রু ছিলেন আরব ঐক্যের আহ্বানকারী মিশরের গামাল আবদুল নাসের।

পরমাণু শক্তিধর তিনটি দেশ ভারত, পাকিস্তান ও ইসরায়েল আন্তর্জাতিক পরমাণু অস্ত্র রোধ বিস্তার চুক্তিতে এ যাবৎকাল স্বাক্ষর করেনি। পরমাণু শক্তিধর উত্তর কোরিয়া আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা থেকে নিজেদের নাম প্রত্যাহার করেছে। পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো অনেকাংশে হামলার উপদ্রবমুক্ত। কারণ অধিকতর শক্তিধর দেশগুলোর বিরুদ্ধে এটি তাদের রক্ষাকবচ, প্রতিরক্ষা, প্রতিরোধক।

নেতানিয়াহু ও ট্রাম্প যতই বলুন, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে অস্ত্র তৈরির ইচ্ছার আভাস ও প্রতিফলন অনুপস্থিত। বিশেষজ্ঞরাও এ কথা মেনে নিয়েছেন। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ। ইরানের বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদরা বাইরের সহায়তা ছাড়া এই জ্ঞান ও প্রযুক্তি আয়ত্ত করেছে। সম্পূর্ণ নিজস্ব ও দেশজ এ কর্মসূচিকে ইরান নিজেদের গৌরব ও অগ্রগতি হিসেবে বিবেচনা করে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত জ্ঞানের ওপর অধিকার এবং পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের প্রতিশ্রুতি হিসেবে ইরান পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তিতে (NPT) স্বাক্ষর করেছে। আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার সদস্য হতে আপত্তি জানায়নি। আন্তর্জাতিক নজরদারি ও তদন্তের শর্ত মেনে নিয়ে বহুপক্ষীয় জয়েন্ট কমপ্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন (JCPOA) স্বাক্ষর করে তাদের সদিচ্ছার পরিচয় রেখেছে। ৬০ শতাংশ থেকে ইরান যদি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের কর্মসূচি পারমাণবিক গ্রেড ৯০ শতাংশে উন্নীত করে, তথাপি তাকে নিক্ষেপ উপযোগী বোমায় রূপান্তর ও দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রে বোমা সংযোজিত করার জন্য প্রয়োজন ন্যূনতম এক থেকে দেড় বছর সময়। অর্থাৎ আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির সুবিধা নেওয়া ছাড়া মিস্টার ট্রাম্পের অত তড়িঘড়ির দৃশ্যত কোনো কারণ ছিল না। বিশেষজ্ঞরা একমত, ইরান পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী হলে এ হামলার শিকার হতো না। মিস্টার ট্রাম্প তার গত মেয়াদে উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক হামলার হুমকি মোকাবিলায় সামরিক উপায় অবলম্বন করেননি। রাষ্ট্রীয় সফরে দুনিয়ার আরেক মাথায় গিয়ে পানমুনজমে কিম জং উনের সঙ্গে করমর্দন ও ফটোঅফ করেছেন।

পশ্চিমা শক্তির পারমাণবিক ক্ষমতাভেদে আচরণগত বৈষম্য সুস্পষ্টভাবে লক্ষণীয়। ইরান এবং অন্যান্য রাষ্ট্রের কাছে হালে এ বার্তা খুবই পরিষ্কার। প্রসঙ্গত, হামলার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থার প্রধান মিস্টার গ্রোসি ইরানের তৎপরতা আরোপিত বিধিনিষেধের লঙ্ঘন বলে অভিহিত করেছেন। এ বিবৃতি ছিল ইসরায়েলের আক্রমণের পটভূমি তৈরি ও নৈতিক বৈধতাদানের উলঙ্গ চেষ্টা। তার বিবৃতি থেকে সংস্থাটির বহুপাক্ষিকতা ও নিরপেক্ষতার আবরণ খসে পড়ে পশ্চিমা শক্তির প্রভাব ও যোগসাজশ সম্পূর্ণ অনাবৃত। ইরানের পার্লামেন্ট মজলিস আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা থেকে সদস্য পদ প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইরানের জন্য এ সিদ্ধান্ত খুবই যৌক্তিক।

ইরানের কাছে যে পরিমাণ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম রয়েছে, তা যেনতেন প্রকারের (crude) দশটি বোমা তৈরির জন্য যথেষ্ট। ইরানের পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের প্রতিশ্রুতি এবং সহযোগিতা ও চুক্তি ইরানের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধানে ব্যর্থ হয়েছে। পশ্চিমাদের আশঙ্কা, হামলার ফলে ইরান হয়তো আণবিক বোমা তৈরির লক্ষ্যে দ্রুততম বেগে আমেরিকার বোমা হামলার দিনটিকে চিহ্নিত করেছেন, ‘যেদিন পারমাণবিক ইরান জন্ম নিয়েছিল।’

উত্তর কোরিয়ার পর আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা থেকে ইরানের পদত্যাগ সংস্থাটিকে প্রশ্নের মুখে ফেলবে। সম্ভবত নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে আরও রাষ্ট্রশক্তি ইরানের পথ ধরতে উৎসাহিত হবে। কেন পারমাণবিক অস্ত্রের মালিকানা শুধু শক্তিধর দেশগুলোর মধ্যে সীমিত থাকবে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এ জিজ্ঞাসা আরও জোরেশোরে ধ্বনিত হবে।

মিস্টার ট্রাম্প কয়দিক সামলাবেন?

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক, আমেরিকাপ্রবাসী

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ট্রাম্পের বিরুদ্ধে একাট্টা ওবামা-বুশ

বিএমইটির বহির্গমন শাখার পরিচালক মামুনের বদলি 

ইয়াবা লুটের অভিযোগ : ছাত্রদল নেতার পদত্যাগ

১৯ জুলাই ‘জাতীয় সমাবেশ’ সফল করুন : গোলাম পরওয়ার

দেশে মুক্তি পাচ্ছে হলিউডের দুই সিনেমা

পিলখানায় বৃক্ষরোপণ অভিযানের উদ্বোধন বিজিবি মহাপরিচালকের

ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষায় অনুপস্থিত ২৫৬৪৫ জন

চূড়ান্ত হলো শাকিব খানের নতুন সিনেমা

ডেঙ্গু প্রতিরোধে নূরুল ইসলাম মণি ফাউন্ডেশনের লিফলেট বিতরণ

আশুরাকে কেন্দ্র করে সুসংহত নিরাপত্তা গ্রহণ ডিএমপির

১০

অবৈধভাবে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েন ভারতীয় নাগরিক, অতঃপর...

১১

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পিআর পদ্ধতির নির্বাচন সম্ভব না : এ্যানি

১২

পুকুরে ডুবে প্রাণ গেল দুই ভাইয়ের

১৩

ভারতে পাকিস্তানি তারকাদের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার?

১৪

তুরস্কের ‘খপ্পর’ থেকে বাঁচতে ইসরায়েলে ঝুঁকছে সিরিয়া

১৫

ছাড়পত্র ছাড়াই খোলা আকাশের নিচে তৈরি করত সিসা, অতঃপর...

১৬

গুপ্তচরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে নতুন বিপদে ইরান

১৭

বাংলাদেশ থেকে কুয়েতে গিয়ে ফুটপাতে চাঁদাবাজি

১৮

ইরান ইস্যুতে রাশিয়ার সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ রেখেছিল ইসরায়েল

১৯

‘স্বাধীনতা সংগ্রাম’ ভাস্কর্য সংস্কারের দাবিতে ঢাবি উপাচার্যকে স্মারকলিপি

২০
X