দেশে ট্রেনে কাটা পড়ে কিংবা ট্রেন দুর্ঘটনায় হতাহত হওয়া নিয়মিত ঘটনা। দেশের অধিকাংশ রেলক্রসিং যেন পরিণত হয়েছে এক-একটি মৃত্যুফাঁদে! শনিবার কক্সবাজারের রামুতে ‘কক্সবাজার এক্সপ্রেস’ ট্রেনের ধাক্কায় একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক ও চার যাত্রীসহ পাঁচজনের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে; যা কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত নয়।
এ ঘটনায় দেখা যায়, ইঞ্জিনে আটকে যাওয়া অটোরিকশাকে এক কিলোমিটার টেনে নিয়ে যায় ট্রেনটি। হঠাৎ রেললাইনে উঠে আসা অটোরিকশাটি আটকে যায় ৭০ কিলোমিটার গতিতে চলা ট্রেনের ইঞ্জিনের সঙ্গে। ওই অবস্থায় ট্রেনটি প্রায় এক কিলোমিটার টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায়। ট্রেনটি থামার পর দুমড়েমুচড়ে যাওয়া অটোরিকশাটি ছিটকে পড়ে বেশ দূরে। কক্সবাজারের রামুতে ট্রেনের ধাক্কায় এর পাঁচ যাত্রী নিহত হওয়ার ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। দুপুর দেড়টায় রামুর রশিদনগরের ধলিরছড়া রেলক্রসিংয়ে এ দুর্ঘটনা ঘটে। মর্মান্তিক মৃত্যুর শিকার অটোরিকশার চালক হাবিবউল্লাহ, ভারুয়ালী ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের ছাদকপাড়ার রেণু আরা ও তার বোন আসমা আরা, রেণু আরার তিন বছর ও দেড় বছর বয়সী দুই ছেলে আশেকউল্লাহ ও আতাউল্লাহ নিহত হয়। এ ঘটনার পর বিক্ষুব্ধ জনতা ধলিরছড়া রেলক্রসিংয়ে অবস্থান নিলে চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে যাওয়া কক্সবাজারগামী সৈকত এক্সপ্রেস ট্রেন আটকা পড়ে।
আমাদের দেশে ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যু কিংবা ট্রেনকেন্দ্রিক দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে রেলক্রসিং ঘিরেই সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়। স্বভাবতই হতাহতের সংখ্যাও এ ক্রসিং কেন্দ্র করেই ঘটে, যার সংখ্যা নেহাত কম নয়। রেল পুলিশের তথ্য বলছে, গত ১০ বছরে এ দুই কারণেই ৭৭ শতাংশের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে রেলক্রসিং ঝুঁকিপূর্ণভাবে পারাপারের চেষ্টা এবং রেললাইনের ওপর বসা বা চলাচলের কারণে গত এক দশকে ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেছে ৭ হাজার ৯৮ জন। আর বিভিন্ন কারণে গত ১০ বছরে ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যু হয়েছে ৯ হাজার ২৩৭ জনের। এর মধ্যে গত তিন বছরে মৃত্যু বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ১৪০ জনে, অর্থাৎ এ সময়ে প্রতিদিন গড়ে ট্রেনে কাটা পড়ে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত একটি পরিসংখ্যান বলছে, দেশের ৮২ শতাংশ রেলক্রসিং অরক্ষিত। আবার রেল দুর্ঘটনার প্রায় তিন-চতুর্থাংশের প্রাণ যাচ্ছে এসব রেলক্রসিংয়ে।
রেললাইনে ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যুর পেছনে মোটাদাগে চারটি কারণ উল্লেখ করেছেন রেলওয়ে পুলিশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এক. সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় রেলক্রসিং দ্রুত পার হতে গিয়ে এবং রেললাইনের ওপর বসা বা চলাচলের কারণে। দুই. কানে হেডফোন লাগিয়ে রেললাইন পার হওয়া বা হাঁটার সময়। তিন. ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ে যাওয়া। চার. রেললাইন ব্যবহার করে হত্যা ও আত্মহত্যা।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বছরের পর বছর রেলে মৃত্যুর এই অনাকাঙ্ক্ষিত মিছিল থামবে কীভাবে? এর কি কোনোই প্রতিকার নেই? আমরা মনে করি, অবশ্যই এর প্রতিকার রয়েছে। উল্লিখিত কারণগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা যেহেতু রেলক্রসিং এবং রেলের ওপর চলাচল কেন্দ্র করে ঘটে, সুতরাং চাইলেই এটা এড়ানো সম্ভব। এ ক্ষেত্রে প্রথমেই দরকার সচেতনতা ও সতর্কতা অবলম্বন। দ্বিতীয়ত, প্রয়োজন সারা দেশের অরক্ষিত রেলক্রসিংগুলোকে সংরক্ষিত বা নিরাপদ করা। এ ক্ষেত্রে গেটম্যানসহ যা যা পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, সেসব বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া। মোটকথা, অবকাঠামো নিশ্চিতের পাশাপাশি জনসচেতনতাই পারে দুর্ঘটনা কমাতে।
মন্তব্য করুন