তুষার কান্তি সরকার
প্রকাশ : ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০১:৫৩ এএম
আপডেট : ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:৩৭ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ

পোশাক শিল্পে সবুজের ছোঁয়া

পোশাক শিল্পে সবুজের ছোঁয়া

মানুষ প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষ প্রকৃতির উদারতায় বেড়ে ওঠে। ছায়ার মায়া দিয়ে ঘিরে রাখা প্রকৃতির উদারতার প্রতিদান মানুষ নিষ্ঠুরতা হিসেবে ফিরিয়ে দেয়। গাছ কাটে, বন উজাড় করে, নদী দূষণ ও ভরাট করে, পাহাড় কাটে, মাটির বুকে ফসল ফলাতে গিয়ে যথেচ্ছ কীটনাশক ব্যবহার করে মাটিকে বন্ধ্যা করে তোলে। আবার কেউ কেউ প্রকৃতিকে ভালোবেসে, প্রকৃতির গুরুত্ব অনুধাবন করে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়। তৃণমূল পর্যায়ে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেয় সচেতনতার বার্তা। প্রকৃতি আর উন্নয়ন সাংঘর্ষিক হলেও প্রকৃতি সংরক্ষণ করে কীভাবে উন্নয়ন সম্ভব, তার দিকনির্দেশনা খুঁজে বের করে। গড়ে তোলে পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন পরিকল্পনা। বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে পরিবেশবান্ধব সবুজ কারখানা পৃথিবীর ভেতর এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

পৃথিবীতে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ খ্যাতি দিয়েছে পোশাক শিল্প। অর্থনীতিতে এনে দিয়েছে ঈর্ষণীয় সাফল্য। দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান এবং তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের ক্ষমতা বাড়িয়ে দিয়েছে এ খাত। বর্তমানে বিশ্বে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে চীনের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। গত বছর ৪২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের তৈরি পোশাক বাংলাদেশ রপ্তানি করেছে, ২০৩০ সালে যা ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছাবে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের যাত্রা শুরু হয় ষাটের দশকে। তবে সত্তর দশকের শেষদিকে রপ্তানিমুখী শিল্প হিসেবে এ শিল্পের বিকাশ ঘটতে থাকে। বাংলাদেশের পোশাক দ্রুতই জয় করে নেয় বিশ্ববাসীর মন। বর্তমানে এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানিমুখী শিল্প খাত। বাংলাদেশ রপ্তানিমুখী পোশাক শিল্পে সচল কারখানার সংখ্যা কত, তার সঠিক কোনো হিসাব পাওয়া যায় না। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তা উন্নয়ন কেন্দ্রের (সিইডি) ম্যাপড ইন বাংলাদেশের তথ্যানুযায়ী, দেশে ৩ হাজার ৪০৯টি পোশাক কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে বিজিএমইএর সদস্য ১ হাজার ৯৪৫ ও বিকেএমইএর সদস্য ৫২১টি। তার বাইরে বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ উভয় সংগঠনের সদস্য ২৫৪টি। কোনো সংগঠনের সদস্য নয়, এমন কারখানার সংখ্যা রয়েছে ৬৮৯টি। এ কারখানাগুলো থেকে উৎপাদিত পোশাকের মধ্যে শার্ট, পায়জামা, জিন্স প্যান্ট, জ্যাকেট, ট্রাউজার, গেঞ্জি, সুয়েটার, পুলওভার, ল্যাবরেটরি কোট, খেলাধুলার পোশাক, শীতকালীন নানা ধরনের গরম কাপড়ের তৈরি পোশাক, নাইট ড্রেস, মেয়েদের ব্লাউজ ইত্যাদি বিশ্ববাজারে যথেষ্ট সমাদৃত। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজা ধসে ১ হাজার ১৭৫ জন পোশাক শ্রমিক মারা যান। আহত হন দুই হাজারের বেশি শ্রমিক, যা ছিল বিশ্বের ইতিহাসে তৃতীয় বৃহত্তম শিল্প দুর্ঘটনা। সবার বিবেক নাড়িয়ে দেয় এ মর্মান্তিক ঘটনা। বিদেশি ক্রেতাদের কাছ থেকে চাপ আসতে থাকে শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ নিয়ে। চিন্তিত হয়ে পড়েন উদ্যোক্তারা। এ সময় কেউ কেউ পরিবেশবান্ধব সবুজ কারখানা স্থাপনে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ২০১৪ সালে সবুজ কারখানা স্থাপন করা হয় তিনটি। ২০১৫ সালে হয় ১১টি। ২০১৬, ’১৭ ও ’১৮ সালে স্থাপন করা হয় যথাক্রমে ১৬, ১৮ এবং ২৪টি। ২০১৯ সালে আরও ২৮টি সবুজ কারখানা স্থাপন করেন পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তারা। ২০২০ ও ’২১ সালে ২৪টি করে আরও ৪৮টি কারখানা গড়ে ওঠে দেশে। ২০২৩ সালে এসে সবুজ কারখানা সংখ্যা দাঁড়ায় ১৯২টি। বিশ্বের শীর্ষ পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানা এখন বাংলাদেশ। উল্লেখ্য, সবুজ কারখানার তালিকায় বাংলাদেশের পরের অবস্থানে রয়েছে ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়া। বাংলাদেশে ১৯২টি সবুজ কারখানার মধ্যে এ পর্যন্ত ৬৮টি কারখানা প্লাটিনাম রেটিং, ১১০টি কারখানা গোল্ড রেটিং, ১০টি কারখানা সিলভার রেটিং এবং আরও ৪টি কারখানা সার্টিফাইড রেটিং পেয়েছে। এ ছাড়া প্রায় ডজনখানেক কারখানা পরিবেশসম্মত সবুজ কারখানার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লিড সনদ পাওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। বিশ্বের বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান পরিবেশবান্ধব স্থাপনার লিড সনদ দিয়ে থাকে। তাদের মধ্যে একটি যুক্তরাষ্ট্রের ইউএস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল (ইউএসজিবিসি)। ১৯৯৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ইউএসজিবিসি। সংস্থাটির দেওয়া সনদ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। বিশ্বের বড় বড় ক্রেতা প্রতিষ্ঠান এ সংস্থার সনদকে গুরুত্বের সঙ্গে মূল্যায়ন করে। লিডের পূর্ণাঙ্গ রূপ লিডারশিপ ইন এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ডিজাইন। সনদটি পেতে একটি প্রকল্পকে ইউএসজিবিসির তত্ত্বাবধানে নির্মাণ থেকে উৎপাদন পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ে সর্বোচ্চমান রক্ষা করতে হয়। এ ক্ষেত্রে কিছু শর্ত মেনে এগোতে হয়। শর্তগুলো হলো—কারখানার ভেতরে প্রাকৃতিক আলো বাতাসের সুব্যবস্থা থাকতে হবে, আধুনিক মেশিনারিজ স্থাপন করতে হবে, পর্যাপ্ত জমির ওপর নির্মিত হতে হবে কারখানা, কারখানার চারপাশে থাকতে হবে গাছগাছালিসহ কৃত্রিম লেক বা ফোয়ারা, থাকতে হবে খোলামেলা পরিবেশ, থাকতে হবে সব ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থাসহ সুযোগ-সুবিধা অর্থাৎ শক্তিশালী আধুনিক সেইফটি ডিভাইসসহ অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা, এক শ্রমিক থেকে অন্য শ্রমিকের নির্দিষ্ট দূরত্ব মেনে কাজ করতে হবে। শ্রমিকদের আবাসন ব্যবস্থাসহ যাতায়াতের জন্য বিশেষ সুবিধা থাকতে হবে, থাকতে হবে লাইফস্টাইল সেন্টার, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, থাকতে হবে এনার্জি সেভ করার প্রক্রিয়া, যা দৈনন্দিন উপাত্ত সংগ্রহের মাধ্যমে লিপিবদ্ধ করে রাখতে হবে, ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে ব্যবহার করতে হবে। সব মিলিয়ে পরিবেশবান্ধব স্থাপনায় ২৪ থেকে ৫০ শতাংশ বিদ্যুৎ, ৩৩ থেকে ৩৯ শতাংশ কার্বন নিঃসরণ এবং ৪০ শতাংশ পানি ব্যবহার কমানো সম্ভব। এসব শর্ত পূরণ করলেই মিলবে লিড সনদ। মনে রাখতে হবে, কারখানা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কার্যপ্রণালি পরিচালনার শতভাগ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে চলতে হবে। সাধারণত অন্যান্য স্থাপনার চেয়ে পরিবেশবান্ধব স্থাপনায় ৫ থেকে ২০ শতাংশ খরচ বেশি হয়। তবে বাড়তি খরচ করলেও এ ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি সুফল পাওয়া যায়।

যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিলের (ইউএসজিবিসি) পরিবেশবান্ধব কারখানার তালিকায় বিশ্বে শীর্ষস্থান অধিকার করে নিয়েছে ময়মনসিংহের ভালুকায় অবস্থিত গ্রিন টেক্সটাইল লিমিটেডের চতুর্থ ইউনিট। এটি পরিবেশবান্ধব কারখানার বিভিন্ন মানদণ্ডে ১১০ নম্বরের মধ্যে ১০৪ পেয়েছে। ইউএসজিবিসির সর্বশেষ তালিকা অনুযায়ী, বিশ্বের শীর্ষ ১০ পরিবেশবান্ধব কারখানার ৮টিই বাংলাদেশের। বাকি দুটি ইন্দোনেশিয়া ও শ্রীলঙ্কায়। ২০১৮ সাল থেকে বিশ্বের সেরা পরিবেশবান্ধব কারখানাটি ছিল ইন্দোনেশিয়ায়। কারখানাটি ১১০ নম্বরের মধ্যে ১০১ পেয়েছিল। এ ছাড়া শীর্ষ ১০০টি পরিবেশবান্ধব কারখানার মধ্যে বাংলাদেশের কারখানা রয়েছে ৫৩টি। বর্তমানে বিশ্বের ১৬৭ দেশে লিড সনদ পাওয়া স্থাপনার সংখ্যা ৯২ হাজারের বেশি। লিড সনদের জন্য মোট ১১০ পয়েন্ট আছে। এর মধ্যে ৮০ পয়েন্টের ওপরে হলে ‘লিড প্লাটিনাম’, ৬০ থেকে ৭৯ হলে ‘লিড গোল্ড’, ৫০ থেকে ৫৯ হলে ‘লিড সিলভার’ এবং ৪০ থেকে ৪৯ হলে লিড সার্টিফায়েড সনদ মেলে। কারখানার উদ্যোক্তাদের পৃথিবীব্যাপী বদনাম রয়েছে পরিবেশ ধ্বংসকারী হিসেবে, সবুজ ধ্বংসকারী হিসেবে। পরিবেশবান্ধব কারখানা স্থাপনে এ দুর্নাম কিছুটা হলেও ঘুচছে সবুজ কারখানা নির্মাণে। সবুজ কারখানা মানে সবুজ বিপ্লবের সূচনা। পরিবেশ সংরক্ষণে আরও একধাপ এগিয়ে যাওয়া। পরিবেশবান্ধব এ বিপ্লবের মাধ্যমে পোশাক শিল্প নতুন এক মাত্রা সংযোজন করেছে। পোশাক শিল্পের মতো অন্যান্য শিল্পকারখানা, হাসপাতাল, বাণিজ্যিক ভবন ইত্যাদি ভবিষ্যতে পরিবেশবান্ধব হবে—এটা এখন সময়ের দাবি।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ডিএমপির সাবেক এডিসি নাজমুল বরখাস্ত

বৈদেশিক কর্মসংস্থানের নতুন প্ল্যাটফর্ম উদ্বোধন

পাথরকাণ্ডে দুদকের তালিকায় সেই মোকাররিম

একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির প্রথম ধাপের ফল প্রকাশ, দেখবেন যেভাবে

‘সমন্বিত শিক্ষার্থী সংসদ’ প্যানেলে সেই মাহিন সরকারসহ প্রার্থী হলেন যারা

জানা গেল আইসিসি র‍্যাঙ্কিং থেকে রোহিত-কোহলির নাম মুছে যাওয়ার কারণ

অনুমতি ছাড়া ছবি-ভিডিও ব্যবহার নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রভা

অভিজ্ঞতা ছাড়াই অর্ধলাখের বেশি বেতনে চাকরির সুযোগ

ডিএমপির বোম ডিসপোজাল ইউনিটের উচ্চতর প্রশিক্ষণ সম্পন্ন

হাসপাতাল পরিচ্ছন্নতা অভিযানে স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতাকর্মীরা

১০

চ্যাটজিপিটির ভুল তথ্যে বিপাকে পড়লেন তরুণী

১১

ইসলামী আন্দোলনের নতুন কর্মসূচি ঘোষণা

১২

ইউরোপ জাপান কোরিয়ায় শ্রমিক পাঠানো নিয়ে ‘সুখবর’ দিলেন আসিফ নজরুল

১৩

জুলাই সনদের মতামত জমাদানের সময় বাড়ল

১৪

অসুস্থ মেয়ের জন্য ত্রাণ নিতে গিয়ে প্রাণ হারালেন গাজার সাবেক খেলোয়াড়

১৫

দিল্লিতে মাথায় চুল গজানোর চেষ্টায় ঢাকার সাবেক পলাতক এমপি

১৬

কালিগঞ্জে হিন্দু পরিবারের জমি দখলের অভিযোগ, পুলিশের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ

১৭

রাকসুর চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ, মনোনয়ন বিতরণ ২৪ আগস্ট

১৮

টয়লেটে বসে দীর্ঘ সময় কাটান? যে ভয়াবহ রোগের ঝুঁকির কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা

১৯

শেখ হাসিনার সঙ্গে ছবি প্রকাশ করে স্মৃতিচারণ করলেন বাঁধন 

২০
X