কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ৩০ আগস্ট ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ৩০ আগস্ট ২০২৫, ০১:৪৭ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ভালো এমপি কীভাবে পাব

ড. মো. আবুল কালাম আজাদ
ভালো এমপি কীভাবে পাব

পূর্ববাংলার জনগণ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে রায় দিয়েছিলেন তাদের জন্মগত অধিকার ভোটের, মোটা চালের, মানুষ হিসেবে ট্রিট করার এবং সমাজে ইনসাফ প্রতিষ্ঠার জন্য। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর উল্লিখিত অধিকারগুলোর হেফাজতকারী হিসেবে ৫৪ বছর ধরে এ দেশের জনগণ তাদের প্রত্যক্ষ ভোটে দুই ধারার জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করে আসছেন। প্রথমটি হলো, জাতীয় সংসদের সদস্য পদ ও পরেরটি স্থানীয় প্রতিনিধি (ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা এবং সিটি করপোরেশন)। একজন সংসদ সদস্যের (এমপি) কাজ হলো, রাষ্ট্র ও জনগণের সুরক্ষায় আইন প্রণয়ন করা এবং অধিন্যস্ত প্রশাসনকে সর্বদা জনসাধারণের কল্যাণে জবাবদিহির আওতায় দেখভাল করা।

১৯৭৩-৯১ সাল পর্যন্ত মোটাদাগে যেসব এমপি সংসদে যেতেন, তাদের সঙ্গে জনগণের কানেকটিভিটি ছিল অসাধারণ। কারণ জনপ্রতিনিধি তারাই হতেন, যারা সমাজের সব স্তরের লোকজনের কাছে হয় তার ব্যক্তি ইমেজ বা পারিবারিক ঐতিহ্য অথবা সাংগঠনিক ও মানবিক গুণের জন্য সুপরিচিত ছিলেন। অথবা সারা জীবন তৃণমূলের রাজনীতি করতে করতে এমপি হয়েছেন। ফলে কোন এলাকায় কে কোন বংশের, নাম কী—সব মুখস্থ বলতে পারতেন। এমনকি ছিল প্রতিটি ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে নিজস্ব বিপুলসংখ্যক কর্মী ও সমর্থক গোষ্ঠী। এককথায় সমাজের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, জনগণের অভাব-অভিযোগ-উন্নয়ন; এই সবকিছুর সঙ্গে এমপির এক ধরনের নাড়ির টান মিশে থাকত। আপনারা যদি একটু খেয়াল করেন, ওই সময়ে কারা হতেন এমপি? নামকরা উকিল বা অ্যাডভোকেট, প্রথিতযশা ডাক্তার, ডক্টরেটধারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কলেজের প্রিন্সিপাল, তৃণমূল নেতা এবং ডাকসাইটে ছাত্রনেতা। উদাহরণস্বরূপ বলা যাক, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জাতীয় পরিষদ (১৬৭ জন) ও প্রাদেশিক পরিষদ (২৮৮ জন) মিলিয়ে আওয়ামী লীগের প্রায় ২৫০ জনের অধিক এমপি ছিলেন উকিল এবং পরের স্থানের এমপি ছিলেন ব্যবসায়ী (পারসোনাল কমিউনিকেশন)। কিন্তু ১৯৭৩ সালের প্রথম সংসদ নির্বাচনে ৩০০ এমপির মধ্যে ছিলেন ৭৫ জন উকিল, ১৫ জন চিকিৎসক, ২৭ জন শিক্ষক এবং ৬৭ জন ব্যবসায়ী। ১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত দেশের দ্বিতীয় এবং একমাত্র ‘রেইনবো’ সংসদ নির্বাচনে উচ্চশিক্ষিত পেশাজীবী ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, আইনজীবী, অর্থনীতিবিদ, পরিকল্পনাবিদ, আমলা (সামরিক বা বেসামরিক), নামকরা ব্যবসায়ী এবং ছাত্রনেতারা এমপি হন। এরশাদের ৯ বছরের স্বৈরশাসনামলে সংসদে আর ভালো এমপি আসেননি। যারা এসেছেন তারা রাষ্ট্র ও সমাজের উন্নয়ন না করে নিজের উন্নয়ন করেছেন। পয়সা দিয়ে বা লোভে ফেলে বা অন্তর্কোন্দলে জড়িয়ে এমপি বানানো বা দলে ভেড়ানো ছিল দেখার মতো। মোটকথা, এমপিদের মূল কাজের বিচ্যুতি তখন থেকেই শুরু হয়। যারা সত্যিকার অর্থে আইন তৈরি করতে পারতেন এবং রাষ্ট্র ও সমাজে জবাবদিহির পরিবেশ অক্ষুণ্ন রাখতে পারতেন, তাদের সরিয়ে ব্যবসায়ী ও আমলারা সংসদটা দখল করলেন। উদাহরণ, সর্বশেষ ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির ১২তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন যেখানে নির্বাচিত ২৯৯ এমপির মধ্যে প্রায় ২০০ জন হলেন ব্যবসায়ী। যে দেশের আইনসভায় অধিকাংশ সংসদ সদস্য ব্যবসায়ী, আমলা, পুলিশ, অপরাধী, মাদক সম্রাট/সম্রাজ্ঞী, শামীম ওসমান, তাহের ও জয়নাল হাজারীদের মতো গডফাদার, চিহ্নিত চাঁদাবাজ, দখলকারী, লুটেরা ও মানবতা হরণকারী; সেই দেশে টেকসই গণতন্ত্র, জবাবদিহি, জানমালের নিরাপত্তা, আইনশৃঙ্খলা, সুষম উন্নয়ন, কর্মসংস্থান, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ, উদীয়মান অর্থনীতি এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সহনীয় মূল্য আশা করাই বোকামি। গত ৫৪ বছরে ১২টি নির্বাচনে প্রার্থী, প্রতীক, পেশিশক্তি, প্রশাসন, পুলিশ, নির্বাচন কমিশন এবং ভোটারদের আচরণ জাতি অবলোকন করেছে। বিনিময়ে প্রতি পাঁচ বছর পরপর নয়তো অভ্যুত্থানের পর একেক নতুন তরিকা ফলো করতে গিয়ে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। একমাত্র ভালো এমপিই দিতে পারেন টেকসই গণতন্ত্র ও উন্নয়ন। ভালো এমপি বের করার কার্যকর কিছু উপায়—

১. প্রার্থী মনোনয়ন সংস্কার

একটি আসনের কমপক্ষে ১০ ভাগ ভোটারের মতামত সংবলিত রেকর্ড মনোনয়ন বোর্ডে জমাদান বাধ্যতামূলক করা উচিত। অবশ্যই প্রার্থী তার শিক্ষাগত যোগ্যতা, অপরাধমূলক ডাটাবেস, দল-সমাজ-দেশের প্রয়োজনে নেওয়া পদক্ষেপগুলো এবং নির্বাচনী ব্যয়ের উৎস বোর্ডে জমাদান করা উচিত।

২. রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন

‘১০টি হোন্ডা, ২০টি গুন্ডা, নির্বাচন ঠান্ডা’—এরকম পেশিশক্তিনির্ভর ভোটের সংস্কৃতি সমূলে ধ্বংস করতে হবে। ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতি থেকে সরে এসে নীতি, আদর্শ ও কর্মফলভিত্তিক রাজনৈতিক কালচার প্রমোট করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোতে ভোটের মাধ্যমে দলীয় নেতা নির্বাচন ও জনপ্রতিনিধি অবশ্যই সংশ্লিষ্ট এলাকার দলীয় কর্মী এবং জনগণকে ঠিক করতে দিতে হবে।

৩. জনসাধারণের সচেতনতা ও ভোটারদের দায়িত্ব

রাজনীতি হলো জনসেবামূলক পেশা। যখন রাষ্ট্রের একজন নাগরিক জানবেন তার ট্যাক্সের টাকায় এমপিরা বেঁচে থাকেন, তখনই তিনি সরাসরি বলতে পারবেন, আমি আপনাকে খাওয়াচ্ছি, বেতন দিচ্ছি। বিদেশে কিন্তু এ ধরনের গণতন্ত্রই চালু। আমরা কেন তা পারছি না? কারণ, আমাদের এখানে বেশিরভাগ এমপির আয় আমার-আপনার ট্যাক্স থেকে আসে না। তারা চাঁদাবাজি আর বড় বড় অলিগার্কের কাছ থেকে নিচ্ছেন। একজন ভোটার যখন ভোটের আগের রাতে কে কত বেশি টাকা দিল বা প্রার্থী কত ক্ষমতাবান বিবেচনায় ভোট দেবে, তত খারাপ এমপি সংসদে যাবেন। তাই দলীয় প্রতীক বা পরিচয় না দেখে প্রার্থীর সততা, অতীত পরিকল্পনা, প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবায়ন রেকর্ড দেখে ভোট দেওয়া উচিত। ভোটারদের গণতন্ত্র ও জবাবদিহি সম্পর্কে সচেতন হতে হবে।

৪. নির্বাচনী ব্যবস্থার উন্নয়ন

নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষ, শক্তিশালী ও স্বাধীনভাবে কাজ করতে হবে। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হবে। নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচনী সহিংসতা ‘জিরো টলারেন্স’ ঘোষণা করতে হবে। প্রার্থীদের এজেন্টদের জাল ভোটার প্রতিরোধে কঠোর হতে হবে। ভোটকেন্দ্রে নির্বিঘ্নে প্রতিটি ভোটার যেন তার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে বাড়িতে ফেরত আসতে পারেন, সেই পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।

৫. সংসদীয় জবাবদিহি

নির্বাচিত এমপিকে সংসদে নিয়মিত উপস্থিতি, এলাকার উন্নয়ন, জনগণের সঙ্গে যোগাযোগ ও স্বচ্ছতা বজায় রাখতে বাধ্য করতে হবে। জনগণকে এমপিদের কাজ পর্যবেক্ষণ করে প্রশ্ন করার অধিকার সুনিশ্চিত করতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়া ও সিভিল সোসাইটিকে এমপিদের কার্যক্রম নিয়মিত আপডেট দিতে হবে।

৬. এমপিদের ডাটাবেস সংরক্ষণ

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত গত ১২টি নির্বাচনে নির্বাচিত এমপিদের পেশা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, ক্রিমিনাল রেকর্ড, দেশ ও জাতির উন্নতিতে ভূমিকা এবং আরও প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করে জাতির সামনে তুলে ধরা।

সবশেষ তিনিই হতে পারেন একজন ভালো এমপি; যার ঈর্ষণীয় ন্যায়নীতি, পলিসি দক্ষতা, ফান্ডরাইজিং ক্ষমতা, সততা-স্বচ্ছতা-জবাবদিহি, পার্টির আদর্শের প্রতি শতভাগ আনুগত্য, জনসেবার ইতিহাস, স্থানীয় জনপ্রিয়তা, টিমওয়ার্ক দক্ষতা এবং রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা থাকবে। এ কথা স্বতঃসিদ্ধ ‘ভালো এমপিরাই টেকসই গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ’।

লেখক: অধ্যাপক ও গবেষক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ

(প্রকাশিত নিবন্ধের বক্তব্য ও দায়িত্ব লেখকদের নিজস্ব)

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

এনবিআরের সহকারী কমিশনার জান্নাতুল ফেরদৌস বরখাস্ত

সকাল ৯টার মধ্যে বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে যেসব জেলায় 

‘কার্টা ব্লু’ ভিসা নিয়ে বাংলাদেশিদের সতর্ক করল ইতালি

যুক্তরাজ্য বিএনপি নেতা ড. মুজিবের ছেলের বিয়েতে সস্ত্রীক তারেক রহমান 

আফগানিস্তানে ভূমিকম্পে ব্যাপক হতাহত, হেফাজতের শোক ও সহায়তার আহ্বান

দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নতুন কর্মসূচি দিল ছাত্রদল

বনানীর সেলসিয়াস সিসা লাউঞ্জে পুলিশের অভিযান

অবশেষে মাদক সম্রাজ্ঞী আ.লীগ নেত্রী স্বপ্না আক্তার আটক

সর্বদলীয় বৈঠক শেষে ফেরার পথে জাগপা সভাপতিকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে জখম

আদাবরে পুলিশের ওপর কিশোর গ্যাংয়ের হামলা

১০

নাটোরে ডা. আমিরুলকে হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার ও বিচার দাবি ড্যাবের

১১

গাজীপুরের কমিশনারের দায়িত্ব থেকে সরানো হলো নাজমুল করিমকে

১২

একাত্তরে ভুল করেছেন, এখনো ভুলের রাজনীতিতে আছেন : টুকু

১৩

দুই কিংবদন্তি অলরাউন্ডার সাকিব ও সিকান্দারকে ‘এক’ করলেন জুলফিকার!

১৪

বিএনপিকে এনসিপির শুভেচ্ছা / ‘আমরা তর্কবিতর্ক করব কিন্তু পারস্পরিক সৌহার্দ্য থাকবে’

১৫

পুরো সেপ্টেম্বরের পূর্বাভাস জানাল আবহাওয়া অফিস

১৬

নদীতে জাল ফেলা নিয়ে দ্বন্দ্বে হামলা, জেলের মৃত্যু

১৭

ক্ষমা চাইলেন রিটকারীকে ধর্ষণের হুমকি দেওয়া সেই শিক্ষার্থী

১৮

আহত চবি শিক্ষার্থীদের দেখতে চমেকে শাহজাহান চৌধুরী

১৯

জাঁকজমক আয়োজনে রুয়েটে বিশ্ববিদ্যালয় দিবস উদযাপন

২০
X