বদরুদ্দীন উমর সবসময়ই একজন সামাজিক মানুষ। রাজশাহীতে প্রগতিশীল শিক্ষকদের সঙ্গে তার যোগটা ছিল নিবিড় বন্ধুত্বের। আইয়ুবী শাসনের শেষদিকে একটা উদ্যোগ দানা বেঁধে উঠছিল স্বৈরাচারবিরোধী একটি বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠী গঠনের। উমর ভাইয়ের সহকর্মী ও বন্ধুরা ওই উদ্যোগে ছিলেন। উমর ভাই চেয়েছিলেন আমিও যুক্ত হই। তাদের একাংশ বের করলেন ইংরেজি সাপ্তাহিক ফোরাম পত্রিকা। আর তখনই দেখা গেল দৃষ্টিভঙ্গিতে একটা মৌলিক পার্থক্য। ফোরাম যারা বের করলেন, তারা অবশ্যই ছিলেন অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে সামরিক শাসনবিরোধী এবং গণতন্ত্রপন্থি; কিন্তু উমর ভাই তো আরও অগ্রসর, তিনি তো সমাজতন্ত্রী। ফোরামে উমর ভাই লিখতে সম্মত হয়েছিলেন, কিন্তু তখনকার রাজনীতি সম্পর্কিত বিষয়ে নয়, আগের আন্দোলনের পর্যালোচনামূলক লেখা। ওই পত্রিকায় আমিও লিখেছি। ফোরামের সঙ্গে নয়, উমর ভাই যুক্ত হয়েছিলেন গণশক্তির সঙ্গে। গণশক্তি গোপন পার্টির সাপ্তাহিক মুখপত্র। তিনি ছিলেন সেটির সম্পাদকের দায়িত্বে। পত্রিকাটি চালু রাখাটা খুবই কঠিন ছিল; বেশি দিন চালু রাখা যায়ওনি, থেমে গেছে একাত্তরের যুদ্ধ শুরু হওয়ার সময়ে। আন্দোলনের জন্য যে পত্রিকা আবশ্যক সেটা সবসময়ই তার চিন্তা ও উপলব্ধির মধ্যে ছিল। সেজন্য নানান প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে সংস্কৃতি নামের একটি মাসিক পত্রিকাও প্রকাশ করেন। সেটি নিয়মিত বের হতো। মাঝখানে থেমে গিয়েছিল, কিছুদিন হলো আবার চালু করেছেন। এক সময়ে নয়া পদধ্বনি নামে একটি বামপন্থি সাপ্তাহিক বের হয়েছিল। তার পেছনে ছিলেন বদরুদ্দীন উমর; সামনে কর্নেল কাজী নূরুজ্জামান। সে পত্রিকা অক্ষরবিন্যাস করতেন পার্টির কর্মীরা, বিতরণেও তারা ছিলেন। পত্রিকাটি জমে উঠছিল। আমরা যুক্ত হয়েছিলাম তার সঙ্গে; আমার স্ত্রী নাজমা জেসমিনও লিখত, সোৎসাহে। কিন্তু টিকল না। এরশাদ চলে এলেন অস্ত্রহাতে, সামরিক বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে। কর্নেল জামানকে গ্রেপ্তার করা হলো, মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের নিয়ে তিনি এরশাদবিরোধী আন্দোলন করবেন—এ আশঙ্কাতে। পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে গেল।
উমর ভাই তার রাজনৈতিক কর্মজীবনে সর্বদাই সচেষ্ট থেকেছেন বামপন্থিদের পরস্পরের কাছাকাছি নিয়ে আসতে। পুঁজিবাদীদের মধ্যে বিরোধের অন্ত নেই; কিন্তু তারা একটি লক্ষ্যে বেশ ঐক্যবদ্ধ, সেটি হলো কমিউনিস্ট-পীড়ন। এদের বিরুদ্ধে কমিউনিস্টরা এক হতে পারেননি। নানা মতে ও পথে বিভক্ত থেকেছেন। অনেক চেষ্টার পরও যখন দেখেছেন যে, কমিউনিস্টরা যত কাছে আসছেন, ততই দূরে সরে যাচ্ছেন, হাল ছেড়ে দিয়ে তখন তিনি মনোযোগ দিয়েছেন নিজের সংগঠন গড়ে তোলার কাজে।
রাজনীতির সঙ্গে সংস্কৃতির সম্পর্কের বিষয়টা শুধু যে তার রচনাতে জায়গা পেয়েছে তা নয়, তার কর্মধারায়—যা ছিল মূলত রাজনৈতিক, সেখানেও দেখা গেছে। বাংলাদেশ লেখক শিবির ছিল লেখকদের একটি সংগঠন, কিন্তু সাহিত্যচর্চা যে রাজনীতিকে বাদ দিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ হতে পারে না, এ প্রত্যয়ে ছিলেন তিনি সুপ্রতিষ্ঠিত। তার অপ্রত্যক্ষ পরিচালনায় তাই বাংলাদেশ লেখক শিবির রাজনীতি সচেতন সংগঠন হিসেবে কাজ করেছে। হাসান আজিজুল হক ও আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মতো কথাসাহিত্যিকদের তিনি ওই সংগঠনে নিয়ে এসেছেন। তারা সম্মেলন করেছেন, ঢাকায় এবং দেশের নানা জায়গায়। চেষ্টা ছিল মেহনতি মানুষদের সঙ্গে লেখকদের দূরত্ব ঘোচানোর।
গত শতাব্দীর ষাট-সত্তর দশকে জোয়ার এসেছিল নকশালবাড়ী আন্দোলনের। তার ইতিবাচক দিকটা ছিল শ্রেণিচ্যুতির এবং তথাকথিত সংসদীয় গণতন্ত্রকে প্রত্যাখ্যানের; নেতিবাচক দিকগুলোর ভেতর ছিল বুর্জোয়া সংস্কৃতির বিকাশযোগ্য অর্জনগুলোকে নির্বিচারে বর্জন। বদরুদ্দীন উমরদের কমিউনিস্ট পার্টি নকশাল লাইন গ্রহণ করেছিল, কিন্তু তিনি নিজে তাতে গা ভাসিয়ে দেননি। গণশক্তিতে তিনি সাংস্কৃতিক পশ্চাদগমনের পক্ষে লিখতে সম্মত হননি। একাত্তরের যুদ্ধের সময়, তাদের পার্টি প্রথমে হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সঠিক সিদ্ধান্তটিই নিয়েছিল, পরে চৌ এন লাইয়ের পাকিস্তানের প্রতি পক্ষপাতমূলক বিবৃতি আসে এবং তাতে পার্টির লাইন-পরিবর্তনের আভাস দেখা যায়। উমর ভাই লাইন পরিবর্তনের বিরোধিতা করেছেন এবং বিফল মনোরথে দলের সঙ্গে সম্পর্কের ছেদ ঘটিয়েছেন।
তার সম্পাদিত গণশক্তি ছিল একটি বিশুদ্ধ রাজনৈতিক পত্রিকা, তাতে সংস্কৃতির কথা পাওয়া যেত না। অথচ উমর ভাই তো সাংস্কৃতিক আন্দোলনে ও অগ্রগমনে বিশ্বাসী। মনে পড়ে একদা আমি ব্যাপারটির দিকে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলাম। তিনি কোনো জবাব দেননি। তবে অনুমান করেছি যে, পত্রিকা যদি দীর্ঘায়ু হতো এবং পার্টির বিপ্লবী আন্দোলন যদি আরও অগ্রসর হতো, তাহলে সংস্কৃতির বিষয়গুলোকে পত্রিকায় নিয়ে আসতে তিনি সচেষ্ট হতেন; কারণ সাংস্কৃতিকভাবে মানুষকে সচেতন না করতে পারলে সামাজিক বিপ্লব যে সম্ভব নয়; এটি তো ছিল তার অভিজ্ঞানের মধ্যেই।
ইতিহাসের চর্চা যারা করেন, তাদের জন্য সহায়ক হচ্ছে স্মৃতিশক্তি। উমর ভাই যে শুধু দলিলপত্র সংরক্ষণেই উৎসাহী ও দক্ষ ছিলেন তা নয়, তার স্মৃতিশক্তিও দেখেছি অসাধারণ। কত বিচিত্র সব ঘটনা, সাল-তারিখ, খুঁটিনাটি, মানুষজন, তিনি এমনভাবে স্মরণ রেখেছেন এবং তার লেখায় ব্যবহার করেছেন, ভাবলে বিস্মিত হতে হয়।
উমর ভাইকে আমি নানা জায়গায় দেখেছি। দেখা হয়েছে আজিমপুরে সাপ্তাহিক সৈনিক অফিসে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে; লন্ডন ও অক্সফোর্ডে উচ্চশিক্ষার জন্য যখন তিনি বিলেতে ছিলেন, ছিলাম আমিও। দেখেছি তাকে মিছিলে, সভায়, সম্মেলনে; নয়া পদধ্বনি কার্যালয়ে। নিরাপত্তার প্রয়োজনে যখন তিনি আত্মগোপনে ছিলেন তখন দেখা হয়েছে খুলনাতে। কিন্তু সবসময়ই তাকে একইরকম দেখেছি। প্রাণবন্ত, অঙ্গীকারে অনমনীয় এবং অসম্ভব আশাবাদী। আড়ম্বর নেই। না তার আচার-আচরণে, না তার লেখায়। দেখেছি তার প্রসন্নতা ও কৌতুকপ্রিয়তা। তার লেখা, কথা এবং বক্তৃতা সবই দেখেছি পরিষ্কার, স্বচ্ছ, গোঁজামিলবিহীন। বুর্জোয়াদের অনেক গুণ তার ভেতর স্পষ্টভাবেই ছিল; কিন্তু ছিল না তাদের শ্রেণিগত সংকীর্ণতা, বিচ্ছিন্নতা ও বিপ্লবভীরুতা।
আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির ভয় জিনিসটা অত্যন্ত মর্মান্তিক রূপে সত্য। রাষ্ট্র, সমাজ, আর্থিক ব্যবস্থা, সবকিছুই প্রতিনিয়ত ভয় দেখায়। বিশেষ করে তাদের যারা প্রতিবাদ করতে চায়। উল্টোদিকে থাকে লাভের আশা। বাম আন্দোলনকে ভয়ভীতি দিয়ে দমন করার চেষ্টা চলেছে, লাভের লোভও দেখানো হয়েছে। বামপন্থিরা কেউ কেউ লোভে পড়েছেন, অনেকেই হতাশ হয়ে ক্ষান্ত দিয়েছেন। বদরুদ্দীন উমরের ক্ষেত্রে ভীতি, লোভ, হতাশা—এ তিন শত্রুর কোনোটিই বিন্দুমাত্র কাজ করেনি। সাহস তার দুঃসাহসিক। যেজন্য শ্রেণিগত সুযোগ-সুবিধা প্রত্যাখ্যান করে অতি অনায়াসে চলে যেতে পেরেছেন মেহনতিদের কাতারে। স্বৈরশাসনের বিভিন্ন সময়ে এমন সব লেখা লিখেছেন, যা পত্রিকার সম্পাদকরা ছাপতে সাহস পাননি। বক্তৃতায় এমন কথা বলেছেন, যা শুনে আয়োজকদের ভেতর শঙ্কা দেখা দিয়েছে। লাভের লোভ তার ধারেকাছে ঘেঁষতে সাহস পায়নি। হতাশাকে তিনি শান্তভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন।
উমর ভাইরা পশ্চিমবঙ্গের লোক। দুই বাংলার ভেতর অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিস্তর পার্থক্য ছিল। সে পার্থক্য বৃদ্ধি পেয়েছে সাতচল্লিশের দেশভাগের ফলে। দেশভাগের ভীষণ ক্ষতিকর দিকগুলোর ভেতর একটি হচ্ছে সাংগঠনিকভাবে বাম আন্দোলনকে দুভাগে ভাগ করে ফেলা। বাম আন্দোলনের ধারাবাহিকতা বিঘ্নিত হয়েছে। কলকাতা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার দরুন পূর্ববঙ্গের পক্ষে সাংস্কৃতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়ে উপায় থাকেনি। উমর ভাইরা পশ্চিমবঙ্গ থেকে ঢাকায় এসেছেন পঞ্চাশের দাঙ্গায় বিপদগ্রস্ত হয়ে। আসতে হয়েছে শরণার্থী হিসেবেই। তার পিতা আবুল হাশিম, অবিভক্ত বাংলায় যিনি প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন এবং দেশভাগের প্রথম ধাক্কা সামলে নিয়ে যিনি পশ্চিমবঙ্গের বিধান সভায় অবস্থান নিয়েছিলেন বিরোধী দলের নেতা হিসেবে; শেষ পর্যন্ত তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বর্ধমান ও কলকাতা ছাড়বেন এবং ঢাকায় এসেই বুঝতে পেরেছেন যে, খুব বড় রকমের একটা ভুল হয়ে গেছে। সার্বক্ষণিক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব তিনি, পূর্ববঙ্গের রাজনীতিতে তিনি যুক্ত হতে আগ্রহী ছিলেন, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে দীর্ঘ সময় কারাভোগ করেছেন; কিন্তু পূর্ববঙ্গে তার জন্য কোনো রাজনৈতিক পরিসর বিদ্যমান ছিল না; তাকে বহিরাগত করেই রাখা হয়েছে। উমর ভাইয়ের চেষ্টা ছিল মেহনতিদের যে মূল অংশ, কৃষক সমাজ, তার সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে সমাজ বিপ্লবী আন্দোলনে নিজেকে সার্বক্ষণিক কর্মী করবেন। কিন্তু যথোপযুক্ত সংগঠন পাননি, যেটি পেয়েছেন সেটিও আগেই বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল এবং পরে পড়েছিল নির্জীব হয়ে। ওদিকে মূল যে বাম রাজনীতি, সেখানেও দেখা দিয়েছে বিভ্রান্তি, বিভেদ, বিপথগামিতা ও হতাশা। কিন্তু নিজে তিনি কোনো বিরতি দেননি। আন্দোলনেই থেকেছেন।
বয়সে উমর ভাই আমার চেয়ে কিছুটা বড়। প্রথম পরিচয়ের সময় থেকেই তাকে আমি অগ্রজ হিসেবে জানি। তার কাছে অনেক কিছু শিখেছি এবং ঋণী হয়েছি। তার প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা। তিনি বিদায় নিলেন। রেখে গেলেন তার জ্ঞানের বিশাল ভান্ডার। দেশের প্রগতিশীল আন্দোলনের জন্য সহায়ক তার অনেক লেখা বিপ্লব আকাঙ্ক্ষীদের ওপর নিশ্চয়ই প্রভাব ফেলতে পারবে বলেই মনে করি। বিপ্লবীদের মৃত্যু নেই। উমর ভাই আমাদের মাঝে ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন অনন্তকাল। গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি উমর ভাইয়ের প্রতি।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন