দেশের বিকাশে অনেকটাই নির্ভর করে সুশিক্ষিত ও কুশলী জনবলের ওপর। তাদের মধ্যকার ছাত্রসমাজের ভূমিকা অপরিসীম। দুনিয়াজুড়ে শিক্ষার্থীদের সংগঠনগুলো জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা ইস্যুতে সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগকারী গোষ্ঠী হিসেবে কাজ করে। ইতিহাস বলে, ছাত্ররাই সরকারকে দায়বদ্ধ করে তোলে এবং তরুণদের অধিকার রক্ষা করে। ছাত্রদের দাবি আদায় করতে ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস বহু পুরোনো। বাংলাদেশের ইতিহাসে ছাত্র আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। শুধু বাংলাদেশে নয়, বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে অধিকার আদায়ে মাঠে নেমেছে শিক্ষার্থীরা। ছাত্ররা দেশ গড়ার কারিগর। ছাত্ররা তাদের শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে অসীম ধৈর্য, মেহনত, ত্যাগ আর তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে, যে কোনো ন্যায্য অধিকার আদায়ে সচেষ্ট হয়ে গড়ে তুলতে পারে একটা সুশৃঙ্খল সমাজ তথা সমৃদ্ধিশালী রাষ্ট্র। বিশ্বব্যাপী ছাত্ররাজনীতি ও ছাত্র সংসদ শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিত করে তার সমাধানকল্পে দাবিদাওয়া কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে ধরে। ছাত্ররাজনীতি মূলত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের অধিকার আদায়ের রাজনীতি হলেও এর অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে, একটি দেশকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জন্য উৎকৃষ্ট নেতা তৈরি করা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদকে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সংসদ বলা হয়। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক চেতনা ও স্বাধিকার আন্দোলনের অন্যতম সূতিকাগার হলো এই ছাত্র সংসদ। প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই গৌরবময় ভূমিকা রাখে এই ছাত্র সংসদ। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে পরবর্তীকালে বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের স্বাধীন বাংলাদেশ নির্মাণের লক্ষ্যে রক্তক্ষয়ী জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম এবং পরবর্তী সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশে স্বৈরাচার ও সামরিকতন্ত্রের বিপরীতে দাঁড়িয়ে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনে সাহায্য করেছে ঢাবি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ।
এ যাবতকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে নেতৃত্ব উঠে এসেছে, তাদের অনেকে রাজনীতিতে অসাধারণ অবদান রেখেছেন। কিন্তু এর দুঃখজনক পরিণতি হলো, এই ছাত্ররাজনীতি একপর্যায়ে তাদের আদর্শলগ্ন রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠনে পরিণত হয়েছে। এমনকি নির্লজ্জ লেজুড়বৃত্তি এবং ওই রাজনৈতিক দলের স্বার্থরক্ষায় সহিংসতায় জড়িয়ে গেছে। সেইসঙ্গে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, নিয়োগবাণিজ্যেও ছাত্রনেতাদের নাম এসেছে।
গত ৩০ বছর ধরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদের নির্বাচন হয়নি বললেই চলে। ডাকসুতে ক্ষমতাসীন দলবিরোধী ছাত্রসংগঠন জয়ী হতে পারে—এ আশঙ্কা থেকে নব্বই-পরবর্তী সরকারগুলো এ নির্বাচন অনুষ্ঠানে অনীহা ছিল। ক্যাম্পাসে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা থেকে নির্বাচন অনুষ্ঠানের অর্থবহ কোনো উদ্যোগ নেয়নি সরকার-ঘনিষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় ও হলগুলোয় ক্রমে ক্রমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের একক আধিপত্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ না থাকায় মাস্তানতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায়।
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে নতুন ছাত্ররাজনীতির প্রত্যাশা বেগবান হয়েছে। এ পরিস্থিতির মধ্যে দেশের প্রধান কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে ডাকসু নির্বাচন হচ্ছে আজ। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে প্রার্থিতার ক্ষেত্রে নারীরা অনেকটাই পিছিয়ে। ডাকসুতে এবার ২৮টি পদে নির্বাচন হচ্ছে। প্রার্থী ৪৭১ জন। তাদের মধ্যে নারী প্রার্থী ৬২ জন, যা মোট প্রার্থীর মাত্র ১৩ শতাংশ। যদিও ডাকসুতে মোট ভোটারের ৪৮ শতাংশই ছাত্রী। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ছাত্রদের পাশাপাশি সম্মুখসারিতে ছিল ছাত্রীরা। তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হামলা-নির্যাতন ও গুলি মোকাবিলা করে ছাত্রদের সঙ্গে সমানতালে রাজপথে ছিল তারা।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর হলে হলে ছাত্ররাজনীতি সাধারণ ছাত্রদের অপছন্দের বিষয় হয়ে ওঠে। বিশেষ করে কোনো কোনো ছাত্র সংগঠনের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের নামে তারা গুপ্ত সংগঠন চালানোর সুবিধা নিচ্ছে। এবারের ডাকসু নির্বাচনে সেটাই সম্ভবত বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে গণরুম-গেস্টরুমের নিপীড়নের রাজনীতি থেকেও বের করে আনতে চায়। যারা নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছে, তারা সবাই সেই প্রতিশ্রুতিও দিচ্ছে। শেষাবধি ডাকসু নির্বাচন নামে-বেনামে দেশের মূল রাজনীতির ছায়া রাজনীতি হিসেবে গঠিত রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনগুলোর আদলেই ফিরে এসেছে।
এদিকে ৪৮ শতাংশ নারী ভোটও এবারের ফলাফল নির্ধারণে খুব গুরুত্ব বহন করছে। থাকবে প্রার্থীর ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি। ফলে ডানপন্থি, বামপন্থি, মধ্যপন্থি সব ভোট বিভাজিত হয়ে ডাকসু ভোটকে এক নতুন মাত্রায় দাঁড় করিয়েছে। যারা স্বতন্ত্র প্রার্থী, তারা বিচ্ছিন্ন ভোটের অনেকটাই হয়তো পাবে।
এবারের ডাকসু নির্বাচন নিছক প্রাতিষ্ঠানিক আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং এটি দেশের ছাত্ররাজনীতির ইতিহাসে এক সম্ভাবনাময় বাঁক। ডাকসুর ইতিহাসে নারী শিক্ষার্থীদের ভূমিকা ও প্রভাব সবসময় সীমিত পরিসরে থাকলেও, এবার সেই চিত্র পাল্টে দেওয়ার আভাস দিচ্ছে নারী ভোটাররা।
২০২৫ সালের ডাকসু নির্বাচনে প্রার্থীদের তালিকা পর্যালোচনায় করলে দেখা যায়, অধিকাংশ প্যানেল কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলকর্তৃক মনোনীত। কয়েকজন স্বতন্ত্র প্রার্থীও রয়েছে। মূলত একটিমাত্র পূর্ণাঙ্গ স্বতন্ত্র প্যানেল রয়েছে। বাংলাদেশের অতীত অভিজ্ঞতা হলো, রাজনৈতিক দলের প্যানেলকে সহযোগী সংগঠন বলা হলেও ছাত্রনেতারা প্রকৃতপক্ষে মূল সংগঠনের নির্দেশনায় কাজ করে। তাদের স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোনো এখতিয়ার থাকে না। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, এসব প্যানেল থেকে নির্বাচিত হলে অতীতের মতো মেরুদণ্ড বিসর্জন দিয়ে মূল দলের আজ্ঞাবহ হিসেবেই কাজ করতে বাধ্য হবে। তবে আশা জাগাচ্ছে স্বতন্ত্র প্যানেল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। স্বতন্ত্র প্যানেল থেকে নির্বাচিত হলেই ছাত্রনেতারা নিজেদের মেরুদণ্ড অক্ষত রেখে অর্থাৎ বিবেককে স্বাধীনভাবে কাজে লাগাতে পারে। প্রচলিত বচন রয়েছে, আন্দোলনে যে শক্তিশালী, নির্বাচনেও সে শক্তিশালী।
আশা করা যাচ্ছে, উৎসবমুখর পরিবেশে হবে বহু আকাঙ্ক্ষিত ডাকসু নির্বাচন। নির্ভয়ে-নির্বিঘ্নে ভোট দেবে শিক্ষার্থীরা—এমনটা প্রত্যাশা। প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত বাংলাদেশের দ্বিতীয় মিনি পার্লামেন্ট হিসেবে পরিচিত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা গত ৩০ বছরের ছাত্ররাজনীতির ইতিহাস অধ্যায়ন করে অতীতে অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে লেজুড়বৃত্তি, দলদাস, যৌন নিপীড়নকারী, নারী নির্যাতক, সাইবার বুলিংয়ে জড়িত, মাদকসেবী, যৌতুকলোভী, মব ভায়োলেন্সের সঙ্গে জড়িত, বকধার্মিক ও কোনো আদুভাইকে ভোট প্রদান থেকে নিজে বিরত থাকবে এবং অন্যদেরও বিরত রাখার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ করবে। তবেই ছাত্ররাজনীতির হারানো ঐতিহ্য রক্ষার প্রথম ধাপ সম্পন্ন হবে এ ডাকসুর হাত ধরেই।
লেখক: প্রেসিডেন্ট, আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী সংগঠন ফ্রিডম ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্টি অ্যালকোহল
মন্তব্য করুন