ড. নিতাই কুমার সাহা
প্রকাশ : ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৭:৪৪ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আনন্দদায়ক ও আকর্ষণীয় পাঠদান

আনন্দদায়ক ও আকর্ষণীয় পাঠদান

শিক্ষা মানুষের জ্ঞান, দক্ষতা ও মূল্যবোধ গড়ে তোলার প্রধান উপায়। একটি সফল শিক্ষাব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো আনন্দদায়ক পাঠদান। আনন্দদায়ক শিক্ষা শুধু শেখাকে সহজ করে না, বরং শিক্ষার্থীদের মনোযোগ, আগ্রহ বৃদ্ধি করে। শ্রেণিকক্ষে পাঠ যদি একঘেয়ে ও নিরানন্দ হয়, তবে তা থেকে শিক্ষার্থীরা বিমুখ হয়। পাঠদানকে প্রাণবন্ত ও আকর্ষণীয় করতে শিক্ষকের করণীয় অপরিসীম।

পাঠদানের আগে একটি সুনির্দিষ্ট পাঠ পরিকল্পনা রাখা অপরিহার্য। প্রয়োজনীয় উপকরণ যেমন—ছবি, ভিডিও বা মডেল প্রস্তুত রাখা আবশ্যক। শিক্ষার্থীর স্তর, বয়স, আগ্রহ ও পূর্বজ্ঞান অনুযায়ী শিখন কৌশল নির্ধারণ করতে হয়। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীকে সক্রিয় করা এবং শিক্ষার পরিবেশকে আনন্দময় করে তোলায় শ্রেণি ব্যবস্থাপনা গুরুত্বপূর্ণ। আনন্দমুখর পরিবেশ শেখাকে সহজ করে। শিক্ষার্থীরা যেন ভয় বা সংকোচ ছাড়াই প্রশ্ন করতে ও মতামত দিতে পারে, সেজন্য উৎসাহ প্রদান করা এবং বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করা দরকার। আনন্দমুখর পরিবেশ রাখতে মজার ঘটনা বা গল্পের মাধ্যমে পাঠ শুরু করা যেতে পারে। সুবিন্যস্ত ও সুনিয়ন্ত্রিতভাবে ক্লাস পরিচালনায় শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীকে নিয়মশৃঙ্খলা মেনে চলতে উৎসাহ প্রদান করা যেতে পারে। যেমন—শিক্ষক ক্লাস চলাকালে কখনো হাত উত্তোলন করলে শিক্ষার্থীদেরও হাত উত্তোলন করা। শিক্ষার্থীরা হাত উত্তোলন করলে তাৎক্ষণিক স্বয়ংক্রিয়ভাবে কথা বলা বন্ধ হয়ে যায়। যেসব শিক্ষার্থী তাৎক্ষণিক হাত তুলতে ব্যর্থ হয়, তারা গল্প করছিল বা অমনোযোগী বলে শনাক্ত করা যায়।

শিক্ষার্থীকে নিয়মিত ও নির্ধারিত সময়ে ক্লাস উপস্থিতির জন্য শিক্ষকের একই সময়ে ক্লাস উপস্থিতি অপরিহার্য। প্রতি ক্লাসেই রোলকল করা এবং শিক্ষার্থীর নির্ধারিত সময়ে ক্লাস উপস্থিতি নিশ্চিতকরণে শুরুতেই রোলকল করা উত্তম। শিক্ষার্থীকে শ্রেণিকক্ষে উপস্থিতির জন্য ধন্যবাদসহ নানা ধরনের পুরস্কারের মাধ্যমে উৎসাহ প্রদান করা; এটি হতে পারে সাপ্তাহিক, মাসিক, বার্ষিক ভিত্তিতে। শতভাগ ক্লাসে উপস্থিত সবাইকে বা সর্বাধিক উপস্থিত প্রথম দশজনকে পুরস্কৃত করা যেতে পারে।

বৈচিত্র্যময় ও আকর্ষণীয় শিখন কৌশল শিক্ষার্থীর কৌতূহল বাড়ায়, পাঠ হয়ে ওঠে প্রাণবন্ত ও আনন্দময়। এতে শিক্ষার্থীরা শুধু শোনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং শেখার প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। আকর্ষণীয় সূচনা অর্থাৎ পাঠের শুরুতে গল্প, কৌতুক, ছবি, ভিডিও বা কোনো বাস্তব উদাহরণ ব্যবহার করলে শিক্ষার্থীর আগ্রহ জাগে এবং পাঠ সহজবোধ্য হয়। শুধু বক্তৃতাভিত্তিক পাঠদান নয়, বরং ব্রেনস্টর্মিং, আলোচনা, প্রশ্নোত্তর, দলীয় কাজ, কেস স্টাডি, প্রকল্পভিত্তিক শিক্ষা, গেম-বেসড লার্নিং ইত্যাদি ব্যবহার করলে শিক্ষার্থীরা সক্রিয় থাকে এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে।

শ্রেণিকক্ষে আনন্দদায়ক ও আকর্ষণীয় পাঠদানের অন্যতম একটি পদ্ধতি হলো শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক পাঠদান। এতে শিক্ষার্থীরা সক্রিয় থাকে, শিক্ষক পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেন। শিক্ষার্থীদের মতামত, প্রশ্ন শ্রেণিকক্ষকে প্রাণবন্ত করে তোলে। শিখনে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সুসম্পর্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে মূল কর্মদক্ষতা এবং পরিপূরক কর্মদক্ষতা দুটিই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মূল কর্মদক্ষতা হলো শিক্ষকের দায়িত্ব পালনের দক্ষতা। যেমন—পাঠদান, বিষয়বস্তু বোঝানো। পরিপূরক কর্মদক্ষতা হলো পাঠদানের বাইরে শিক্ষকের এমন আচরণ, যা শ্রেণিকক্ষে সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করে। যেমন—সহযোগিতা, সহানুভূতি। শিক্ষার্থীকে নিজের সন্তানের আদলে সেবা প্রদান করা এবং সব শিক্ষার্থীকে সমান দৃষ্টিতে দেখা দরকার। শিক্ষার্থীর ছোট ছোট সাফল্যকেও প্রশংসা করা, যার মধ্যে যে গুণটি আছে সেটিকে গুরুত্ব দেওয়া দরকার। এতে তাদের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায়। শিক্ষার্থীর নাম ধরে ডাকা, চোখে চোখ রেখে কথা বলা, ব্যক্তিগত ও অন্যান্য সমস্যায় কাউন্সেলিং সেবা প্রদান করা শিক্ষক-শিক্ষার্থীর ইতিবাচক সম্পর্ক তৈরিতে ভূমিকা রাখে।

শ্রেণিকক্ষ হলো শিক্ষার্থীদের জ্ঞান, দক্ষতা ও মূল্যবোধ গড়ে তোলার প্রধান ক্ষেত্র। কিন্তু শুধু মৌখিক ব্যাখ্যা অনেক সময় একঘেয়ে ও কঠিন হয়ে যায়। এজন্য শিক্ষণ উপকরণ ব্যবহার করা অত্যন্ত জরুরি। উপকরণ শেখাকে আনন্দমুখর, আকর্ষণীয়, স্থায়ী ও কার্যকর করে তোলে। শিক্ষামূলক খেলা, চিত্রাঙ্কন, গল্প বলা, প্রতিযোগিতা ইত্যাদি ব্যবহার করলে পাঠ আকর্ষণীয় হয় এবং আনন্দ খুঁজে পায়। চিত্র, মডেল বা ভিডিও বিমূর্ত ধারণাকে বাস্তবের সঙ্গে মিলিয়ে বুঝতে সহজ করে। উপকরণ শ্রেণিকক্ষে বৈচিত্র্য আনে, রঙিন ছবি, অডিও-ভিডিও মনোযোগ ধরে রাখে এবং হাতে-কলমে কাজের অভিজ্ঞতা শিক্ষার্থীদের মনে স্থায়ী ছাপ ফেলে, ফলে বিষয়বস্তু দীর্ঘ সময় মনে রাখতে পারে।

আনন্দদায়ক ও আকর্ষণীয় পাঠদানে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এখন সময়ের দাবি। নতুন নতুন জ্ঞান অর্জনে শিক্ষক হবেন গতিশীল এবং শিক্ষার্থীর থেকে এগিয়ে। প্রযুক্তির ব্যবহারে শিক্ষককে আগ্রহী ও দক্ষ হওয়া দরকার। মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরে ছবি, ভিডিও, অডিওসহ ডিজিটাল কনটেন্ট উপস্থাপন করলে বিষয়বস্তু জীবন্ত হয়ে ওঠে। শিক্ষক যদি বিষয়ভিত্তিক উপকরণ যথাযথভাবে ব্যবহার করেন, তবে শ্রেণিকক্ষ হবে প্রাণবন্ত ও আনন্দঘন শেখার কেন্দ্র। স্মার্ট বোর্ডে শিক্ষকের পাশাপাশি শিক্ষার্থীরাও লিখতে, ছবি আঁকতে পারে। ফলে শিক্ষার্থীর সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকে। Google Classroom-এর মাধ্যমে শিক্ষক-শিক্ষার্থী যোগাযোগ, অ্যাসাইনমেন্ট, অনলাইন কুইজ করা যায়। শিক্ষার্থীরা মোবাইল অ্যাপ, যেমন—Kahoot ব্যবহার করে শিখতে পারে। YouTubeসহ নানা অনলাইন উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করে পাঠকে সমৃদ্ধ করা যায়। বিজ্ঞান, ইতিহাস বা ভূগোলের পাঠে ভার্চুয়াল রিয়ালিটি ও অগমেন্টেড রিয়ালিটি ব্যবহার করে শিক্ষার্থীরা যেন বাস্তব জায়গায় ঘুরছে বা পরীক্ষাগারে কাজ করছে, এমন অভিজ্ঞতা পেতে পারে। Google Forms-এর মাধ্যমে তাৎক্ষণিক মূল্যায়ন ও প্রতিক্রিয়া দেওয়া যায়। একুশ শতকের শিক্ষাব্যবস্থায় ব্লেন্ডেড লার্নিং একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রচলিত মুখোমুখি শ্রেণি কার্যক্রম ও অনলাইন শিক্ষণ কার্যক্রমের সমন্বিত পদ্ধতিই হলো ব্লেন্ডেড লার্নিং। এতে শিক্ষার্থীরা প্রযুক্তি ব্যবহার করতে শেখে এবং শেখাকে আনন্দময় অভিজ্ঞতায় রূপান্তরিত করে।

শিক্ষার্থীর শেখা চলমান অবস্থায় দুর্বলতা চিহ্নিতকরণ ও সংশোধনের সুযোগ থাকায় ধারাবাহিক মূল্যায়ন (যেমন ক্লাস পরীক্ষা) সামষ্টিক মূল্যায়ন (যেমন বার্ষিক পরীক্ষা) অপেক্ষা অধিক কার্যকর। পাঠকে আনন্দদায়ক করতে মূল্যায়ন পদ্ধতিকে বৈচিত্র্যময় এবং বস্তুনিষ্ঠ হওয়া দরকার। যে কোনো মূল্যায়ন শেষে কৃতিত্ব অর্জনকারী শিক্ষার্থীদের স্বীকৃতি বা পুরস্কার প্রদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এতে কৃতিত্ব অর্জনকারীরা উজ্জীবিত হয়, অন্যরা আগামীর জন্য অনুপ্রাণিত হয়। প্রিন্সিপাল অ্যাওয়ার্ড, টিচার অ্যাওয়ার্ড, বেস্ট অব দ্য অ্যাওয়ার্ড ইত্যাদি বিশেষ নামের পুরস্কারে শিক্ষার্থীরা বিশেষভাবে আনন্দিত হয়।

শ্রেণিকক্ষকে আনন্দমুখর ও আকর্ষণীয় করে তোলা শিক্ষকের অন্যতম দায়িত্ব। শ্রেণিকক্ষের পাঠগ্রহণ শিক্ষার্থীকে শুধু পাঠ্য বিষয় শেখায় না, অধিকন্তু শিক্ষার্থীর নম্রতা, ভদ্রতা, মূল্যবোধের বিকাশ এবং সামাজিকীকরণের মাধ্যমে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে সক্রিয় ভূমিকা রাখে। শিক্ষক যদি দক্ষতার সঙ্গে বিষয়বস্তু মিল রেখে উপযুক্ত শিখন কৌশল, আধুনিক প্রযুক্তি ও উপকরণ ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেন, তবে শ্রেণিকক্ষের পরিবেশ হয়ে উঠবে আনন্দঘন। শ্রেণিকক্ষকে আনন্দমুখর ও আকর্ষণীয় করে তুলতে পারলে শিক্ষকের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব তৈরি হবে, পাঠে মনোযোগী হবে, পড়ালেখার প্রতি অনুরাগ সৃষ্টি হবে, প্রতিষ্ঠানের প্রতি আগ্রহ বাড়বে, সর্বোপরি শিক্ষার্থীরা ক্লাসমুখী হবে।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, মনোবিজ্ঞান বিভাগ

শহীদ বুদ্ধিজীবী সরকারি কলেজ, রাজশাহী

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

শারীরিক শিক্ষাকেন্দ্রে ভোট পড়েছে ৮৩ শতাংশের বেশি

পদত্যাগপত্রে যা লিখলেন নেপালের প্রধানমন্ত্রী অলি

টানা ৫ দিন ঝরতে পারে বৃষ্টি, অপরিবর্তিত থাকবে তাপমাত্রা

এস আলমের দুই ছেলেসহ ফেঁসে গেলেন ১০ জন

কালবেলার বরিশাল ব্যুরো প্রধান তুষারের দাফন সম্পন্ন

পালাতে যাচ্ছেন অলি, ভারত সীমান্তে উচ্চ সতর্কতা

নেপালের মন্ত্রীদের হেলিকপ্টারে করে সরিয়ে নিচ্ছে সেনাবাহিনী

এআইইউবি চ্যাম্পিয়ন্স লিগের উদ্বোধন

মৃত্যুর আগে বন্ধুকে নিয়ে যে স্মৃতিচারণ করেছিলেন মান্না

ফল না দেওয়ায় রাবি আরবি বিভাগে শিক্ষার্থীদের ‘শাটডাউন’ ঘোষণা

১০

এক ঘণ্টা আগে ভোট বর্জন করলেন ভিপি প্রার্থী

১১

ডাকসুর ভোটগ্রহণ শেষ

১২

স্পেনের ভিসার নামে সৌদির মরুভূমিতে ফেলে রাখার অভিযোগ

১৩

নেপালে আটকে পড়া বাংলাদেশ দল নিয়ে যা জানাল বাফুফে

১৪

এখনো নেপাল সরকারের চূড়ান্ত পতন হয়নি!

১৫

ডাকসু নির্বাচনে ভোট কাস্ট ৮০ শতাংশ 

১৬

অনিয়মের অভিযোগ পেলে সঙ্গে সঙ্গেই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে : উপাচার্য

১৭

নুরাল পাগলার মরদেহ উত্তোলনের নির্দেশদাতা গ্রেপ্তার

১৮

একসঙ্গে আ.লীগের দুই নেতার পদত্যাগ

১৯

নেপালের প্রধানমন্ত্রী কোথায় পালাচ্ছেন?

২০
X