

সরকারি ক্রয় খাত সারা বিশ্বেই সবচেয়ে দুর্নীতিপ্রবণ। বাংলাদেশে তা নিয়ন্ত্রণহীন দখলদারত্বের হাতে নিমজ্জিত হয়েছে। আমলাতন্ত্র, ঠিকাদার ও রাজনৈতিক শক্তির যোগসাজশে সরকারি ক্রয় খাত নিয়ন্ত্রণহীন জিম্মি দশায় পরিণত হয়েছে। এমনকি ই-জিপির মাধ্যমে ডিজিটাইজেশন করা হলেও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। বরং ত্রিপক্ষীয় আঁতাতে সরকারি ক্রয়ের বাজার দখল আরও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে।
এ কারণেই সরকারি ক্রয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে বিধিমালায় বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে। খবরে প্রকাশ, ২০০৮ সালের পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালার (পিপিআর) জায়গায় আসছে নতুন ‘পিপিআর-২০২৫’। নতুন খসড়ায় ৯৪টি সংশোধনের পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে ১২টি নতুন বিধি। বাতিল হয়েছে ৭টি বিধি। সংযোজন হয়েছে ৪টি নতুন তপশিল, সংশোধন হয়েছে আরও ৮টি। পাশাপাশি ১৮টি উপধারা বাতিল করে মোট ১৫৩টি বিধি নিয়ে দাঁড়িয়েছে নতুন কাঠামো। খসড়া বিধিমালা নিয়ে সাংবাদিকদের অবহিত করতে বুধবার রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে আইএমইডি সম্মেলন কক্ষে কর্মশালার আয়োজন করে বাংলাদেশ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অথরিটি (বিপিপিএ)।
এর আগে এক গবেষণায় সরকারি ক্রয়ে সুশাসন নিশ্চিতকরণে ছয় দফা সুপারিশ করেছে টিআইবি। সুপারিশমালায় রয়েছে—বাংলাদেশ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অথরিটি (বিপিপিএ) কর্তৃক জয়েন্ট ভেঞ্চার প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা, যাতে যোগসাজশের মাধ্যমে বাজার দখলের সুযোগ না থাকে; সিন্ডিকেট ভাঙতে বিপিপিএ কর্তৃক প্রতিযোগিতামূলক আইন প্রণয়ন করা এবং জয়েন্ট ভেঞ্চারের কার্যক্রম সীমিতকরণ; মার্কেট শেয়ারের ক্ষেত্রে একক ঠিকাদার ও জয়েন্ট ভেঞ্চারের একটি সীমারেখা নির্ধারণ করা, যাতে সবাই সমান সুযোগ পায়; বিপিপিএসহ ক্রয় কার্যক্রমে জড়িত অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের আন্তর্জাতিক ভালো চর্চাগুলো বজায় রাখা এবং একচ্ছত্র বাজার ব্যবস্থার বদলে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখা; পাবলিক প্রকিউরমেন্ট নীতিমালা সংশোধন করা, যেন প্রতিষ্ঠান ও জয়েন্ট ভেঞ্চারের বেনিফিশিয়াল ওনারশিপের তথ্য সবার জন্য উন্মুক্ত থাকে এবং যে চুক্তিগুলো ই-প্রকিউরমেন্ট প্রক্রিয়ায় হয়নি সেগুলোকে দ্রুত ই-টেন্ডারিং প্রক্রিয়ার মধ্যে নিয়ে আসা।
বিপিপিএ-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদ্যমান সরকারি ক্রয় বিধিমালা, ২০০৮-কে সংশোধিত আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে নতুন বিধিমালা প্রণয়ন অপরিহার্য হয়ে ওঠে। এ খসড়া বিধিমালার লক্ষ্য হচ্ছে সরকারি ক্রয় ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা। পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব ও সামাজিকভাবে দায়বদ্ধ ক্রয়ের বিধান রাখা হয়েছে। সরকারের আশা, এ উদ্যোগ সরকারি অর্থব্যবস্থায় সুশাসন ও দক্ষতা বাড়াবে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, একক নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি প্রভাবশালী ঠিকাদারদের চক্র নীতিমালার ফাঁকফোকর ব্যবহার করে যৌথ অংশীদারত্ব বা জয়েন্ট ভেঞ্চারের মাধ্যমে কার্যাদেশ নেওয়ার সুযোগকে একই উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার পথ রুদ্ধ করেছে এবং দখলদারত্ব আরও ঘনীভূত করেছে। আবার ই-জিপি কর্তৃপক্ষের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে যে, মন্ত্রণালয় বা সরকারি সংস্থার নেতৃত্বের পরিবর্তন হলে শীর্ষ কার্যাদেশগুলো হাতবদল হয়েছে। কিন্তু বাজার নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত থেকেছে। এটা ক্রয় খাতে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের অকাট্য প্রমাণ।
আমরা মনে করি, ফ্যাসিবাদের পতনের পর রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক প্রেক্ষিতে একই অবস্থা অব্যাহত থাকবে কি না, এ প্রশ্নের উত্তর সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধি এবং ই-জিপি প্রক্রিয়ার যুগোপযোগী সংস্কারের ওপর নির্ভর করবে। তবে রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তন ও আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ইতিবাচক পরিবর্তন ছাড়া এ ক্ষেত্রে বাস্তব সুফল অর্জন অসম্ভব।
মন্তব্য করুন