জাতিসংঘের তদন্ত কমিশন গত ১৬ সেপ্টেম্বর মানবাধিকার কাউন্সিলের ৬০তম অধিবেশনে তাদের প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে ইসরায়েলের চালানো হত্যাযজ্ঞকে ‘জাতিনিধন’ বলে আখ্যায়িত করা হয়। আরও বলা হয়, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, প্রেসিডেন্ট ইসাক হার্জগ এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োয়াভ গ্যালান্টসহ দেশটির অন্যান্য নেতাও এ গণহত্যা প্ররোচনার জন্য দায়ী। এ ছাড়া গণহত্যার উসকানিদাতা হিসেবে জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী বেন-গির, অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোতৃক এবং উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত চালানোর প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয় এ প্রতিবেদনে। কিন্তু এ কমিশনের প্রকাশিত প্রতিবেদন আদৌ আইনি দিক থেকে খুব বড় আকারের পরিবর্তন আনতে পারবে কি না, সেই ব্যাপারে গণহত্যা বিশেষজ্ঞরা এখনো সন্দিহান আছেন।
নেদারল্যান্ডসের হেগ শহরে অবস্থিত জাতিসংঘের প্রধান ছয়টি অঙ্গসংগঠনের একটি—আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে)। সেখানে গত বছর ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকা গণহত্যার মামলা করলেও, এখন পর্যন্ত তার চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করা হয়নি। তার আগেই ইসরায়েলের পরিচালিত গণহত্যার ওপর জাতিসংঘ তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদন আনুষ্ঠানিকভাবে ‘কনফারেন্স রুম পেপার’ হিসেবে প্রকাশ করা হলো। আন্তর্জাতিক রাজনীতির মঞ্চে এ প্রতিবেদনের যথার্থ ব্যবহারিক প্রয়োগ নিশ্চিত করা গেলে, নেতানিয়াহু ও তার মিত্রদের তাদের দীর্ঘদিনের নির্মম ও নির্লজ্জ কর্মকাণ্ডের জন্য জবাবদিহির সম্মুখীন করা যাবে।
দীর্ঘকাল ধরে ইসরায়েলের কোনো অন্যায় কর্মকাণ্ডকে প্রশ্নবিদ্ধ করলে কিংবা ইসরায়েলের অপরাধ নিয়ে যে কোনো ধরনের আলোচনা করলেই ইসরায়েলি নেতারা সেটাকে ‘ইহুদিবিদ্বেষী ষড়যন্ত্র’ বলে চালিয়ে দিচ্ছেন। এমনকি নেতানিয়াহুর প্রিয় শব্দ হলো, ‘রক্ত অপবাদ’। মধ্যযুগে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে এমন গুজব প্রচলিত ছিল যে, ধর্মীয় বিদ্বেষের কারণে ইহুদিরা খ্রিষ্টানদের হত্যা করে তাদের রক্ত দিয়ে খাবার তৈরি করত এবং নিজেদের ইবাদাতের কাজে সেই রক্ত ব্যবহার করত। ঐতিহাসিকভাবে ইহুদিদের বিরুদ্ধে এ ভিত্তিহীন অভিযোগগুলোকে ‘রক্ত অপবাদ’ নাম দেওয়া হয়। কিন্তু বর্তমান যুগে এসে বিবি নেতানিয়াহু এ শব্দটার অপব্যবহার করছেন। ইসরায়েলের সমালোচনা করলেই তাকে ‘রক্ত অপবাদ’ বলে আখ্যায়িত করছেন।
জাতিসংঘের তদন্ত কমিশনের দ্বারা প্রকাশিত এ অনুসন্ধানপত্রই একমাত্র প্রামাণিক দলিল নয়; অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং স্বনামধন্য ইসরায়েলি সংগঠন বিটসেলেম ও ফিজিশিয়ানস ফর হিউম্যান রাইটসসহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠান ইসরায়েলকে দোষী সাব্যস্ত করে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই বিস্তারিত ও প্রমাণনির্ভর বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে এ উপসংহারে পৌঁছেছে যে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের নৃশংসতার পর থেকে গত দুই বছরে ইসরায়েল গাজায় সুস্পষ্টভাবে গণহত্যা চালাচ্ছে। জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞ এবং গণহত্যাবিষয়ক গবেষকরাও একই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন।
বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদের অসংখ্য কণ্ঠস্বর উচ্চারিত হওয়ার পরও যখন ইসরায়েলের নেতা ও সরকারি কর্মকর্তাদের আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যাচ্ছে না, তখন জাতিসংঘের তদন্ত কমিশনের এ প্রতিবেদন বিশেষ গুরুত্ব বহন করতে পারে। অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড, পূর্ব জেরুজালেম এবং ইসরায়েল সম্পর্কিত কমিশনের নেতৃত্বে আছেন নাভি পিল্লাই। রুয়ান্ডার গণহত্যাবিষয়ক আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাবেক সভাপতি তিনি। আমার সঙ্গে তার প্রথম সাক্ষাৎ হয় যখন তিনি জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। কোনোভাবেই তাকে ‘হামাসের দোসর’ বলা চলে না। অথচ সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় জাতিসংঘে নিয়োজিত ইসরায়েলি কূটনেতিক দূত এ প্রতিবেদনের লেখকদের বিরুদ্ধে মানহানির অভিযোগ তুলেছেন এবং দাবি করেছেন যে, ইসরায়েলের সমালোচকরা সবাই ইহুদিবিদ্বেষী।
যুক্তরাজ্যে কিয়ার স্টারমারের সরকার আগে বলেছিল যে, আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের মতো বিশ্বাসযোগ্য ও দক্ষ কোনো আইনি প্রতিষ্ঠান চূড়ান্ত রায় না দেওয়া পর্যন্ত তারা গণহত্যার প্রশ্নে কোনো অবস্থান নেবে না। কিন্তু তদন্ত কমিশন গণহত্যার ব্যাপারে স্পষ্ট রায় দিলেও, এখনো এ ব্যাপারে মুখ খোলেননি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী। দুঃখের ব্যাপার হলো, স্টারমার নিজে একসময় মানবাধিকারবিষয়ক আইনজীবী ছিলেন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে লড়াই করা ছিল তার পেশা। এখন গাজায় লাখ লাখ মানুষের মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে জেনেও তিনি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিচ্ছেন না।
কিয়ার স্টারমার এ ব্যাপারে নিশ্চয়ই অবগত আছেন যে, ১৯৪৮ সালের গণহত্যা কনভেনশনের অন্যতম মূলনীতি হলো ‘গণহত্যা প্রতিরোধে সব সম্ভাব্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা’। সেই প্রতিরোধ গড়ে তোলার ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করছে না পশ্চিমা বিশ্বের সরকারগুলো। এদিকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা গবেষণা সংস্থার সভাপতি এরই মধ্যে উল্লেখ করেছেন যে, গণহত্যা কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশের সংখ্যা এখন ১৫৩; ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকার প্রতিটি দেশ এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। তারপরও রাষ্ট্রগুলো এ ব্যাপারে তাদের নিজ দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হচ্ছে।
জাতিসংঘের তদন্ত কমিশনের এ অনুসন্ধান শুধু ফিলিস্তিনের গণহত্যাকেই স্বীকৃতি দেয়নি, একই সঙ্গে এটা প্রকাশ করেছে, কীভাবে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর সরকার পরিচালনাকারীদের নৈতিক অবক্ষয় হয়ে গেছে। যেসব রাষ্ট্র ১৯৯৮ সালে রোমে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) প্রতিষ্ঠায় অংশ নিয়ে গর্ববোধ করেছিল, তারাই আজ সেই আদালতের রায়কে অবজ্ঞা করছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ব্যক্তি পর্যায়ের বিচারকার্য পরিচালনা করে এবং আন্তর্জাতিক বিচার আদালত রাষ্ট্র পর্যায়ের বিচারকার্য পরিচালনা করে। গণহত্যার মতো অপরাধের বিচার করার এখতিয়ার দুটো আদালতেরই রয়েছে।
কিন্তু তাদের রায় গ্রাহ্য করছে না পশ্চিমা বিশ্বে ইসরায়েলের মিত্র রাষ্ট্রগুলো। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের দায়ে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে আইসিসি সর্বসম্মতভাবে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলেও, জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মের্ৎস বলেন, নেতানিয়াহুকে আটক করাটা ‘অযৌক্তিক’ হবে। ফ্রান্সও বলেছে, নেতানিয়াহু প্যারিসে এলে তাকে গ্রেপ্তার করা হবে না। অথচ রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে একই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করার পর সেই রায়কে তারা সাধুবাদ জানিয়েছে এবং বলেছে, রায় বাস্তবায়নের পক্ষে তারা তাদের দায়িত্ব পালন করবে।
নেতানিয়াহু ও তার সরকার যে গণহত্যা চালাচ্ছে এবং তার জন্য তাদের যথাযথ শাস্তির আওতায় আনা উচিত—এমন মতপ্রকাশ করার পেছনে অনেক শক্ত যৌক্তিক ভিত্তি তুলে ধরেছে জাতিসংঘের তদন্ত কমিশন। কিন্তু পশ্চিমা সরকারগুলো যে আইসিসিকে সহযোগিতা করতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে, এটা ভবিষ্যতে তাদের নিজেদের জন্যই বিপজ্জনক বলে প্রমাণিত হতে পারে। ডোনাল্ড ট্রাম্প ও নেতানিয়াহুর জোট আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতকে ধ্বংস করার পরিকল্পনা করছে। এর অংশ হিসেবে ট্রাম্প আইসিসির কিছু আইনজীবী, বিচারক ও কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন। এমনকি আল-হাকসহ স্বনামধন্য ফিলিস্তিনি মানবাধিকার সংগঠনগুলোর ওপরও নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন তিনি, যাদের একমাত্র দোষ হলো ইসরায়েলের অপরাধগুলো নথিবদ্ধ করা।
আইসিসির একজন প্রধান আইনজীবী ছিলেন ব্রিটিশ সাবেক সামরিক প্রসিকিউটর, যিনি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে মামলা লড়েছেন বলে মৃত্যুর হুমকি ও নানান চাপে অবশেষে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। তিনি বলেন, ‘এ কদিন আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ কয়েকটা মাস পার করেছি আমি।’ +৯৭২ ম্যাগাজিন, দ্য গার্ডিয়ান এবং অন্যান্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত তদন্তে দেখা গেছে, আদালতের কাজ ব্যাহত করতে নেতানিয়াহু আদালতের কর্মচারীদের ফোন ট্যাপ থেকে শুরু করে তাদের ব্ল্যাকমেইল পর্যন্ত করেছেন। নিজের স্বার্থরক্ষায় কল্পনাতীত পর্যায়ে যেতে প্রস্তুত আছেন তিনি।
আইসিসিতে মানবতার বিরুদ্ধে যেই অপরাধগুলোর জন্য নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে রায় শোনানো হয়েছে, তা কোনো অর্থেই গণহত্যার চেয়ে হালকা অপরাধ নয়। বর্ণবৈষম্য, নিশ্চিহ্নকরণ, বড় পরিসরে হত্যার নির্দেশনা এবং একটি জনগোষ্ঠীকে জোরপূর্বক স্থানান্তর করানো—এসবই জাতিসংঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী জাতিনিধনের অংশ। গণহত্যার সঙ্গে জাতিনিধনের মৌলিক পার্থক্য এই জায়গায় যে, একটা জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য যখন গণহত্যা চালানো হয়, তখনই সেটা জাতিনিধন অপরাধ বলে চিহ্নিত হয়।
এরই মধ্যে ১৪৭টি দেশ ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। আগামী সপ্তাহে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, কানাডাসহ আরও কয়েকটি দেশ তাদের স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে যাচ্ছে। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে গণহত্যার প্রতিবেদনের পাশাপাশি সেটা নেতানিয়াহুর ওপর চাপ আরও কিছুটা বৃদ্ধি করবে বলে ধারণা করা যায়। তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন যে, তার দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি এখন ভয়াবহভাবে বিশৃঙ্খল। তবে শুধু ফিলিস্তিনের স্বীকৃতি যথেষ্ট নয়; ইসরায়েলের অপরাধের জবাবদিহিও নিশ্চিত করতে হবে। অপরাধী বন্ধু হোক বা শত্রু, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই।
ট্রাম্প-পুতিন জোটকে মোকাবিলা করতে যেমন ইউরোপীয় নেতারা দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিলেন, তেমনি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ধ্বংসের প্রচেষ্টাকেও প্রতিহত করতে হবে। কারণ, আদালত একবার ভেঙে গেলে তাকে আর নিকট ভবিষ্যতে পুনর্গঠন করা সম্ভব হবে না। কিয়ার স্টারমারের উচিত এ সপ্তাহেই ট্রাম্পকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করা। ন্যায়বিচারের পদদলন উপেক্ষা করা যাবে না, যেমন উপেক্ষা করা যায়নি ট্রাম্পের দ্বারা ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির প্রকাশ্য অপমান।
লেবাননে যুক্তরাজ্যের সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং বর্তমানে জাতিসংঘের মানবিকবিষয়ক উপমহাপরিচালক টম ফ্লেচারের ভাষায়, গাজায় যা ঘটছে তা হলো—‘একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ বর্বরতা, আমাদের প্রতিদিন যার সাক্ষী হতে হচ্ছে।’ আন্তর্জাতিক বিচার আদালত জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সরকারকে অনুরোধ করেছে, ‘গণহত্যা প্রতিরোধ করুন’। কিন্তু সেই ব্যাপারে এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রগুলোর তেমন আগ্রহ দেখা যায়নি। এখন জাতিসংঘের তদন্ত কমিশন যেহেতু স্পষ্ট প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, সেহেতু এ ব্যাপারে কিছুটা পরিবর্তন আশা করা যেতে পারে।
লেখক: সাংবাদিক ও লেখক। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সংস্থার যুক্তরাজ্য শাখার সাবেক পরিচালক এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সংস্থার সচিবালয়ের সাবেক পরিচালক। নিবন্ধটি যুক্তরাজ্যভিত্তিক পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ানের মতামত বিভাগ থেকে অনুবাদ করেছেন অ্যালেক্স শেখ
মন্তব্য করুন