তিন দফা দাবিতে দেশের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের আন্দোলন চলছে বেশ কয়েক দিন ধরে। গতকাল সোমবার থেকে দাবি আদায়ে নতুন কর্মসূচি হিসেবে আমরণ অনশন শুরু করেছেন তারা। যে শিক্ষকদের কাজ শিক্ষার্থীদের পাঠদান ও সব সম্ভাবনার স্বাভাবিক বিকাশে নিজের সর্বাত্মকভাবে নিবেদিত রাখা, সেই সময় তাদের যৌক্তিক বেতন-ভাতার জন্য রাস্তায় আন্দোলন-অনশন করতে হয়—এটা অত্যন্ত দুঃখজনক ও দৃষ্টিকটু।
শিক্ষক-কর্মচারীদের তিন দাবির মধ্যে মূল বেতনের ২০ শতাংশ বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ভাতা ৫০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা এবং উৎসব ভাতা ৫০ থেকে ৭৫ শতাংশ করা। চলমান এ আন্দোলনের মুখে গত রোববার বাড়ি ভাড়া মূল বেতনের ৫ শতাংশ (সর্বনিম্ন ২০০০) হারে নির্ধারণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে অন্তর্বর্তী সরকার। তবে শিক্ষকরা এটিকে ‘প্রহসনের প্রজ্ঞাপন’ আখ্যা দিয়ে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন। এরপর শুরু করেন আমরণ অনশন এবং বাড়ি ভাড়ার প্রজ্ঞাপন প্রত্যাখ্যান করে ঢাকার রাজপথে ‘ভুখা মিছিল’ করতে দেখা যায়। তারা জানান, উত্থাপিত দাবি মানা না হলে আন্দোলন থামবে না। শিক্ষকদের অনড় অবস্থানে অচলাবস্থায় মুখে দেশের বেসরকারি শিক্ষাব্যবস্থা।
এরই মধ্যে এ আন্দোলন বিভিন্ন মহলের সমর্থন ও দৃষ্টি কেড়েছে। বিশেষ করে তাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের ওপর কয়েক দিন আগে পুলিশের অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। তাদের প্রতি সংহতি ও পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি জানায় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠন। এদিকে ৫ শতাংশ বাড়ি ভাড়ার প্রজ্ঞাপন জারির পর শিক্ষা উপদেষ্টার যে বক্তব্য, তা আন্দোলনকারীদের দাবি-দাওয়ার ন্যায্যতারই সাক্ষ্য বহন করে। উপদেষ্টার ভাষ্যে, শিক্ষক সমাজের অনেক বেশি পাওয়া দরকার। কিন্তু বর্তমান সীমাবদ্ধতার কারণে এ সিদ্ধান্ত হয়েছে।
বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের প্রতি অবজ্ঞা, অবহেলা ও বৈষম্যের অভিযোগ নতুন নয়। অতীতেও তাদের কিছু দাবিদাওয়া নিয়ে বিভিন্ন সময় রাজপথে নামতে দেখা গেছে। এ চিত্রের বদল ঘটেনি। বেসরকারি এমপিওভুক্ত স্কুল, মাদ্রাসা ও কলেজের শিক্ষক সংখ্যা প্রায় চার লাখ। এসব প্রতিষ্ঠানে রয়েছে দেশের মোট শিক্ষার্থীর বড় একটি অংশ। বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীকে যারা আগামী দিনের মেধাবী নাগরিক তৈরির দায়িত্বে নিয়োজিত, তাদের যে বেতন কাঠামো, তা বর্তমান সময়ে বেমানান। দুর্মূল্যের বাজারে এ বেতন কাঠামো কতটা বাস্তবসম্মত—এ প্রশ্ন অবান্তর। কেননা, সংসারের খরচ যিনি মেটান কিংবা বাজারের ব্যাগ নিয়ে যিনি বাজারে যান, তিনিই জানেন ক্রমবর্ধমান জীবনযাত্রার সঙ্গে টিকে থাকা কতখানি কষ্টের। অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, ন্যূনতম কিছু দাবির জন্যও যখন শিক্ষক গ্রেপ্তার, লাঞ্ছনা ও অপমানের শিকার হন, তখন তা হয় সমগ্র জাতিরই অপমান।
আমরা মনে করি, শিক্ষকের সম্মান ও মর্যাদার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটা অবশ্যই মনে রাখতে হবে। পাশাপাশি এও মনে রাখতে হবে, এ পেশা যেন শুধুই সম্মানজনক না হয়ে আর্থিক ও পেশাগতভাবে আকর্ষণীয়ও হয়ে ওঠে। সামগ্রিকভাবে শিক্ষায় একটি ভালো পরিবেশ তৈরি করতে ব্যর্থ হলে মেধাবী ও যোগ্যতাসম্পন্নরা এ পেশায় আসবে না। এটি ভবিষ্যতে ভালো ফল দেবে না, যা শিক্ষার জন্য অত্যন্ত খারাপ বার্তা। যে দেশে শিক্ষকের মর্যাদা নেই, সে দেশ কখনো উন্নত ও সম্মানিত রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে না। যারা জাতি গড়ার কারিগর, তাদের প্রতি অবজ্ঞা ও বঞ্চনা কাম্য নয়। আমাদের প্রত্যাশা, শিক্ষকদের দাবিদাওয়ার বিষয়টি একটি ন্যায্য ও সময়োপযোগী করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। পাশাপাশি বেসরকারি শিক্ষার অচলাবস্থা দূর হবে।
মন্তব্য করুন