আমীর খসরু
প্রকাশ : ২১ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২১ অক্টোবর ২০২৫, ১০:১৬ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বিপ্লব কেন বারবার ব্যর্থ হয়

বিপ্লব কেন বারবার ব্যর্থ হয়

[ষষ্ঠ পর্ব]

১৯৬৭ সালে কট্টর বামপন্থি সংগঠন সিপিইপি (হক-তোয়াহার নেতৃত্বাধীন) আট দফা ঘোষণা করে। যাতে বলা হয় ‘পূর্ব বাংলার মুক্তির পথ-জনগণতান্ত্রিক এক বিপ্লব’ (প্রকাশনার ধাপ বা পরিচয় নেই)।

সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বাধীন পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন ১১ দফার যে থিসিস প্রকাশ করে ১৯৬৮ সালের ১ ডিসেম্বর, যাতে স্বাধীনতা-সংগ্রামের প্রেক্ষাপটে দ্বন্দ্ব সম্পর্কে তাদের মূল্যায়ন পেশ করে। তাদের মূল্যায়ন হচ্ছে—১. পূর্ব বাংলার জনগণের সাথে পাকিস্তানি উপনিবেশবাদের দ্বন্দ্ব, ২. পূর্ব বাংলার বিশাল কৃষক-জনতার সাথে সামন্তবাদের দ্বন্দ্ব, ৩. (ক) পূর্ব বাংলার জনগণের সাথে সাম্রাজ্যবাদ বিশেষত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের জাতীয় দ্বন্দ্ব, (খ) সংশোধনবাদ, বিশেষত সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের দ্বন্দ্ব, (গ) পূর্ব বাংলার জনগণের সাথে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের দ্বন্দ্ব, ৪. বুর্জোয়াদের সাথে শ্রমিক শ্রেণির দ্বন্দ্ব। সিরাজ সিকদার বিপ্লবের ডাক দিয়ে বিপ্লবের চরিত্র সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেন।

১৯৬৯ সালের এপ্রিলে কাজী জাফর-মেনন-রণোর নেতৃত্বাধীন ‘কমিউ বিপ্লবীদের সমন্বয় কমিটি’ ‘স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে স্বাধীনতা-সংগ্রামের অর্থাৎ জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের ডাক দিয়ে পূর্ব বাংলা জনগণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ডাক দেয়।

এসব বিপ্লবের ডাক বাস্তবে প্রবাহিত হয় মুক্তিযুদ্ধের দিকে। যদিও কমরেড আবদুল হকের নেতৃত্বের একটি অংশ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে। কিন্তু অন্য সব বামপন্থি দল মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়।

তবে সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ঘটে ১৯৬৯ সালে। যাকে গণঅভ্যুত্থান বলা হলেও এটি পরিপূর্ণ বিপ্লব হতে পারতো—যদি না আওয়ামী লীগ, সোভিয়েত ধারার দলগুলো এতে জোরালো সমর্থন ও ভূমিকা পালন করতো। যদিও এতে মওলানা ভাসানীর সমর্থন ছিল এই বিপ্লবী যোদ্ধাদের ব্যাপারে এবং আন্দোলনের ব্যাপারে। সব ছাত্র সংগঠন অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ, যা চীনপন্থি বলে খ্যাত ছিল), ছাত্র ইউনিয়ন (মস্কো), পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ এবং তৎকালীন ডাকসু সহসভাপতি (ভিপি) তোফায়েল আহমদ, ডাকসু সাধারণ সম্পাদক নাজিম কামরান চৌধুরী সংগ্রামী ছাত্র সমাজের ব্যানারে ১১ দফা পেশ করেন। এখানে বলা প্রয়োজন, মুসলিম লীগ তথা তৎকালীন আইউব খানের কথিত ছাত্র সংগঠন কুখ্যাত এনএসএফের একটি অংশ পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা প্রশ্নে ভেঙে যায়। নাজিম কামরান এদেরই নেতা ছিলেন।

এই ঐক্যবদ্ধ ঘোষণা পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা প্রাপ্তিতে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা হিসেবে কাজ করে। ১১ দফার ওই ঐক্যবদ্ধ ঘোষণায় বলা হয়, ‘এগারো দফার দাবিতে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়িয়া তুলুন।’ ১৯৬৯ সালের ১৪ জানুয়ারি ১১ দফা ঘোষণা করা হলেও কার্যত এটি ছিল— কার্যকর এক দফা অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার ডাক। এই ১১ দফা শুধু ছাত্রদের সমস্যা বা দাবি নয়; এতে ছিল ‘কৃষকের ওপর থেকে খাজনা, ট্যাক্স হ্রাস; শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি এবং বোনাস প্রদান, ব্যাংক-বীমা, পাট ব্যবসা ও বৃহৎ শিল্প জাতীয়করণ; সেন্ট্রো, সিয়াটোসহ পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিলসহ অন্যান্য ছাত্র, কৃষক, শ্রমিকসহ সাধারণ মানুষের দাবি। এতে পশ্চিম পাকিস্তানের বেলুচিস্তান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধুসহ বিভিন্ন প্রদেশের স্বায়ত্তশাসনসহ পাকিস্তানকে একটি ফেডারেল রাষ্ট্র বা স্টেট করার ঘোষণাও ছিল।

৬৯-এর এই ছাত্র আন্দোলন রূপ নেয় গণআন্দোলনে। যাতে অংশগ্রহণ শুধু ছাত্রদের ছিল না। ছিল কৃষক, শ্রমকিসহ সর্বজনীন বা গণমানুষের। এই আন্দোলন ১৯৬৯ সালে হলেও ১৯৬৮ সাল থেকে এর সূত্রপাত।

এককালের পাকিস্তানের প্রখ্যাত ছাত্রনেতা, পরে বাম তান্ত্রিক ও বুদ্ধিজীবী তারিক আলী এই আন্দোলন সম্পর্কে বলেন, ছাত্র-শ্রমিক, কৃষকের এই আন্দোলনে যাতে ’৬৮-এর ডিসেম্বর থেকে ’৬৯-এর মার্চ পর্যন্ত কমপক্ষে ২০৯ জন বেসামরিক ব্যক্তি নিহত হন। তিনি পাকিস্তান রাষ্ট্রটি শেষ পর্যন্ত টিকবে কি না অর্থাৎ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান এক থাকবে কি না, সে সম্পর্কে গভীর সংশয় ব্যক্ত করেন।

[Tariq Ali, can Pakistan Survive; The death of a state, Penguin, London, Page-67]

১৯৬৯-এর আন্দোলনের কারণে আইউব খানের পদত্যাগ করতে হয়। নতুন সামরিক শাসক হন জেনারেল ইয়াহিয়া খান। জন্মলগ্ন থেকেই পাকিস্তান রাষ্ট্রটি আমলাতান্ত্রিক এবং মুষ্টিমেয় বা অলিগার্কির শাসনের মধ্য দিয়ে চলতে থাকে। আর শেষ পর্যায়ে এতে নেতৃত্বের ভূমিকায় চলে আসে সামরিক বাহিনী বা সামরিক আমলাতন্ত্র। যাদের কাজ ছিল স্বাধীনতার লক্ষ্যে বিপ্লবকে প্রতিহত করা এবং জনগণ থেকে রাষ্ট্রকে বিচ্ছিন্ন করা। আর এই গোষ্ঠীর মূল কেন্দ্র ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। ১৯৬৯-এর আন্দোলন-সংগ্রামকে এ কারণে কেন্দ্রীভূত সামরিক আমলাতন্ত্র ও গোষ্ঠী বা মুষ্টিমেয়তান্ত্রিক পাকিস্তান রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ব্যাপক জনসাধারণের বা সমাজের সর্বস্তরের মানুষের এক প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জ, গণঅভ্যুত্থান এবং সর্বোপরি বিপ্লবের আলামতের বিদ্যমানতা। আসলে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা-সংগ্রামের সূচনাকালও বলা যায়। আর এর মূল উদ্দেশ্য ছিল—‘সংগঠিত জনগোষ্ঠীর এমন এক সচেতন প্রয়াস—যা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিদ্যমান সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামোকে বদলে বা পরিবর্তন করে নতুন এক ব্যবস্থার জন্ম দেয়া।’ এটাই বিপ্লবের মৌল চেতনা। ১৯৬৯ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাটি করেছেন গবেষক ড. লেনিন আজাদ। তিনি বইয়ে বলছেন, ‘ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এই কারণে গুরুত্বপূর্ণ নয় যে, তা আইউব সরকারের মতো একটি শক্তিশালী স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটাতে সক্ষম হয়েছিল। অধিকন্তু এ আন্দোলনে এমন সব উপাদানের সংযোজন ঘটেছিল, যা সামাজিক বিপ্লবের পথকে প্রশস্ত করতে পারতো। আর সে সামাজিক বিপ্লবকে বাধা দিতেই মূলত সেদিন সামরিক শাসন জারি করা পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্য অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল।’

[লেনিন আজাদ; ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান: রাষ্ট্র, সমাজ ও রাজনীতি; জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ-ঢাকা, ২০১৯, পৃ-৬৮২]

১৯৬৯-এর গণআন্দোলনটির মধ্যে বিপ্লবের সব সম্ভাবনার বিদ্যমানতা থাকলেও তাকে বিপ্লব হতে দেয়া হয়নি, সুকৌশলে ‘হত্যা’ করা হয়েছে মূলত সামরিক আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে। সাথে ছিল সেই অলিগার্কি এবং এরও পেছনে মার্কিন সমর্থন—যাদের প্রথম খপ্পড়ে পাকিস্তান পড়েছিল ১৯৫০-এর বছরগুলোতে। তবে ছাত্র এবং জনগণ বিপ্লবকে বাস্তবায়নের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল—যার বহিঃপ্রকাশ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ।

জেনারেল ইয়াহিয়া পুনরায় নতুন মাত্রার সামরিক শাসন, যা গোষণার জন্য আইউব খান অন্তিম মুহূর্তে আবদার করেছিলেন, তাতে রাজি হননি। তিনি সাধারণ নির্বাচন ঘোষণা করেন। ১৯৭০-এর ৭ ডিসেম্বর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই ইতিহাস সবার জানা বলে এ নিয়ে কোনো আলোচনা না করাই শ্রেয়।

এদিকে, আওয়ামী লীগ ১৯৬৯-এর ১ আগস্ট দলের ম্যানিফেস্টো অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের দলীয় ম্যানিফেস্টো ঘোষণা করে। এতে ছয় দফাভিত্তিক পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি তোলা হয়। তবে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে—মৌলিক অধিকার শীর্ষক দফায় ‘সকল নাগরিকের মৌলিক প্রয়োজনীয় খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা এবং ন্যায়সংগত ও সহজ উপায়ে জীবিকা অর্জনের ব্যবস্থার’ নিশ্চয়তার কথা উল্লেখ করা হয়। এতে ব্যক্তি-স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক-শিল্প-কৃষি-পাট-বন্যা-শ্রমিক-কৃষকদের ব্যাপারে এবং পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে পরিষ্কার অঙ্গীকারনামা লিখিত আকারে পেশ করা হয়। যেহেতু ১৯৭০-এর নির্বাচনের আগে এ ধরনের কোনো ম্যানিফেস্টো আর দেয়নি আওয়ামী লীগ—কাজেই এটিকে আওয়ামী লীগের নীতি ও কর্মসূচি হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে।

ঘটনাবলি খুব দ্রুত ঘটতে থাকে। মওলানা ভাসানী ১৯৭১-এর ১ জানুয়ারি এক দফা অর্থাৎ ‘আপস নহে সংগ্রাম-ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান’ দাবি করে সন্তোষে এক সর্বদলীয় সম্মেলন করেন এবং এই বক্তব্যটি প্রস্তাব হিসেবে গৃহীত হয়।(চলবে)

লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

লোহাগড়া পৌর বিএনপির ৭ নম্বর ওয়ার্ড কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা

পুকুরে মিলল রাজনের অর্ধগলিত মরদেহ

স্পিন-স্বর্গে রিশাদের ঝড়, বাংলাদেশের সংগ্রহ ২১৩

অন্তরে আল্লাহ-রাসুল সম্পর্কে বাজে চিন্তা এলে যে ৫ কাজ করবেন

সরকারকে ধন্যবাদ জানালেন জামায়াত আমির

২ টন ইলিশসহ ৪৬ জেলে আটক

আ.লীগের ঝটিকা মিছিলের চেষ্টা, ককটেল বিস্ফোরণ

টাঙ্গাইল জেলা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতির মৃত্যুতে তারেক রহমানের শোক

উচ্চস্বরে গান বাজিয়ে রেস্টুরেন্টে কিশোরীকে ধর্ষণ, গ্রেপ্তার ৩

সালমান শাহ হত্যা মামলা, নতুন আসামি হলেন যারা

১০

ভারতকে এশিয়া কাপের ট্রফি কবে দেওয়া হবে, জানাল এসিসি

১১

একনেকে ১৯৮৮ কোটি টাকার ১৩ প্রকল্প অনুমোদন

১২

মাদ্রাসাছাত্রীকে ধর্ষণের পর হত্যা, আসামির মৃত্যুদণ্ড

১৩

দেয়ালের উপর পড়ে ছিল বস্তায় মোড়ানো নবজাতক

১৪

জোবায়েদ হত্যা : ৩ আসামির জবানবন্দির জন্য আবেদন

১৫

এবার দীঘির সঙ্গে জুটি বাঁধছেন বাপ্পারাজ

১৬

জোবায়েদের খুনিদের ফাঁসির দাবিতে আদালতপাড়ায় ছাত্রদলের বিক্ষোভ

১৭

শ্রেণিকক্ষে ফেরার ঘোষণা এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের

১৮

ওয়ানডে ইতিহাসে প্রথমবার এমন কিছু করল ওয়েস্ট ইন্ডিজ

১৯

তৃতীয়বার কন্যাসন্তান হওয়ায় মায়ের কাণ্ড

২০
X