মুহাম্মদ আলম
প্রকাশ : ২১ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২১ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:১৯ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

খবরের পেছনে ছোটা এক নিবেদিতপ্রাণ

খবরের পেছনে ছোটা এক নিবেদিতপ্রাণ

নিবেদিত এক সাংবাদিক মাহবুব হোসেন সারমাত। খবর সংগ্রহই ছিল তার নেশা। অন্য সাংবাদিকদের মতো নিজ জীবনের খবর তার কাছে মূল্যহীন। বুকের হৃৎকম্প ঠিকভাবে কাজ করছে না। তারপরও ছুটে যেত অকুস্থলে। খবরের পেছনের খবর তার লাগবেই। এ যেন এক আজব নেশা! হয়তো তার নীতি ছিল, হৃৎকম্পের সঙ্গে আপস চলে কিন্তু মনগড়া তথ্যের সঙ্গে নয়। সঠিক তথ্য তুলে আনতে সে ছুটত ঘটনাস্থলে। যাত্রাপথ যতই বন্ধুর হোক।

কাঁধে ক্যামেরা। হাতে বুম নিয়ে তার অবিরাম ছুটে চলা। চলছে তো চলছেই। বিশ্রাম নেই। কিন্তু নিজ হৃদরোগের সবশেষ ‘প্যারামিটার’ জানা নেই তার। গোপালগঞ্জের কোথায়, কোন প্রান্তে কী ঘটছে, সারমাতের সব জানা। হঠাৎ বেঁকে বসল বুকের শিরা-উপশিরা। থেমে গেল সারমাতের হৃদযন্ত্র। থেমে গেল ‘হৃদ কলমের টান’। খবর লেখার সব শক্তি। ক্যামেরার ক্লিক।

১০ অক্টোবর বড় অকালে ওপারে চলে গেল সাংবাদিক সারমাত। গোপালগঞ্জের মানুষ হারাল এক কীর্তিমান মেধাবী, অন্তঃপ্রাণ সাংবাদিককে।

মাহবুব হোসেন সারমাত আমার বাল্যবন্ধু। সতীর্থ। গোপালগঞ্জ শহরের একই পাড়ায় (থানাপাড়া) আমরা বড় হয়েছি। এসএম মডেল গভ. স্কুলে একসঙ্গে একই ক্লাসে পড়েছি। পরে বঙ্গবন্ধু কলেজেও একই সঙ্গে। কোটালীপাড়া থেকে একই ক্লাসে যোগ দেয় সাংবাদিক, লেখক দীপঙ্ককর গৌতম। সারমাত ভাইদের মধ্যে দ্বিতীয়। এ কারণে দীপঙ্কর ওকে দেখলেই, ডাক দিত—মাইজ্যা ভাই বলে। সারমাত ওকে বলত, ‘কমরেড লেনিনের দোস্ত’। দীপঙ্কর ছাত্র ইউনিয়ন করত। তাই এ ‘খেতাব’!

স্কুলে আমি সায়েন্সে। সারমাত আর্টসে। আমার চেয়ে ওর হাতের লেখা সুন্দর। গোটা গোটা। এখন তার মুখচ্ছবি ভেসে উঠলে, সঙ্গে সঙ্গে তার সুন্দর হাতের লেখাও ভেসে উঠে হৃদয়ে আয়নায়। আমাদের কমন বন্ধু সাংবাদিক আনোয়ারুল হক মিল্টন প্রথম সারমাতের মৃত্যু সংবাদ দিল। কিছুক্ষণ আমি বিহ্বল ছিলাম। পরে মনে পড়তে থাকে একের পর এক স্মৃতি। এখন কোনটা রেখে যে কোনটা বলি!

ইংরেজি ভালো পারত সারমাত। স্কুলে আমাদের ইংরেজি পড়াতেন ফজলে আনোয়ার স্যার। ঢাকা বোর্ডের ইংরেজির হেড এক্সামিনার ছিলেন তিনি। আমরা স্যারের ডাক নাম পান্নু স্যার বলে ডাকতাম। স্যার পরীক্ষায় এমন সব ট্রান্সলেশন দিতেন, সঠিকভাবে লেখা কঠিন ছিল। না পারলে, এক কান টেনে ধরে, জোড়া বেতের বাড়ি। তবে ভয়ই বেশি দেখাতেন। সারমাতকে স্যার খুব স্নেহ করতেন।

আমরা যারা নানা কারণে গোপালগঞ্জ ছেড়ে এসেছি, তাদের লোকাল স্টেশন ছিল সারমাত। কোনো সমস্যা হলেই ফোন দাও সারমাতকে। মা-বাবার চিকিৎসা, জমির খাজনা, দলিল সংগ্রহ, ভাগ্নে-ভাগ্নিকে স্কুলে ভর্তি করানো, কোন কাজে সাহায্য করেনি বন্ধু সারমাত? একদিনের জন্যও কখনো বিরক্ত হয়নি। শুধু যে প্রতিষ্ঠানের কাজ করে তাদের জন্য নয়, ঢাকা থেকে ছোট্ট কিন্তু ঐতিহাসিক গোপালগঞ্জে সাংবাদিক, কবি, সাহিত্যিক, রাজনৈতিক দলের নেতাসহ যারাই কাজ কিংবা বেড়াতে গেছেন, সারমাত তাদের সঙ্গ দিয়েছেন। সাধ্যমতো আপ্যায়ন করেছে। কলেজ জীবনে ভাবতাম সারমাত অনেক ভালো করবে। নিদানপক্ষে বিসিএস দিয়ে কলেজের প্রভাষক তো হবেই। ভীষণ পড়ুয়া ছিল। কিন্তু সে হয়ে গেল সাংবাদিক। সম্ভবত দৈনিক দিনকালের জেলা প্রতিনিধি দিয়ে শুরু। পরে আমার দেশ ও এনটিভিতে কাজ করেছে। দৈনিক আমার দেশের একদম শুরু থেকেই সারমাত ছিল। ছিল জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। শুরুতে আমি আজকের কাগজ থেকে ওই পত্রিকায় সিনিয়র রিপোর্টার হিসাবে যোগ দিই। পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক প্রয়াত রাশীদ উন নবী বাবু ভাই আমাকে বললেন, বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য-বিবৃতি সবিস্তারে ছাপবে আমার দেশ। যাতে কেউ বলতে না পারে আমরা কোনো দলের রাজনৈতিক দলের আদর্শ বিলং করি। এজন্য গোপালগঞ্জে দক্ষ প্রতিনিধি লাগবে। আমি সারমাতের নাম প্রস্তাব করি। সহকর্মী মোস্তাফিজ শফিও সায় দেন। বাবু ভাই সারমাতকে মনোনীত করেন। এনটিভিতেও প্রথমে জেলা প্রতিনিধি ছিল সারমাত, পরে স্টাফ রিপোর্টার। ২০০৪ সালের দিকে সারমাতকে আমি ঢাকায় নিয়ে আসার চেষ্টা করি। ওকে নিয়ে দুদিন হরতালের ডিউটি করি অফিসের সিএনজি স্কুটারে। শেষ দিনে পিকেটারদের ছোড়া ইট এসে পড়ে আমাদের স্কুটারে। তখন আমরা প্রগতি সরণিতে। পুলিশের টিয়ার শেলে অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যায় চারপাশ। আমাদের চোখ দিয়ে শুধু পানি ঝরে। চোখ খুললেই জ্বালা-যন্ত্রণা। দুপুরে বাসায় খাবার খেতে এসেই সারমাত জানায়—নাইট কোচে সে বাড়ি যাবে। তার জন্য তার পুরোনো জায়গাই ভালো। শান্তিময়। সংঘাতময় ঢাকায় সে থাকবে না। যে কথা সেই কাজ। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত গোপালগঞ্জেই সাংবাদিকতায় নিয়োজিত ছিল বন্ধু আমার। তারপর ছুটে বেড়িয়েছে গোপালগঞ্জের এ-প্রান্ত থেকে সে-প্রান্তে। মাঝে হৃদরোগ বাসা বাঁধে বুকে। ডাক্তারের পরামর্শ ছিল—বিশ্রাম নিতে হবে। কে শোনে কার কথা। সারমাতকে থামাবে কে? সবকিছু তুচ্ছ করে বিরামহীন ছুটতে থাকত তথ্যের পেছনে। সবার আগে খবর পৌঁছে দিতে হবে অফিসে। এ প্রতিযোগিতায় আজ নিজেই হয়ে গেছে খবর। সারমাতের তিন মেয়ে। বড়জন এইচএসসি পাসের খবর পেয়েছে বাবার মৃত্যুর দুদিন পর। জানি না ভবিষ্যৎ ওদের কোথায় নিয়ে যাবে? আমাদের সবার প্রার্থনা ওরা যেখানেই থাকুক, ভালো থাকুক। দক্ষিণের জনপদে অনেক অনেক দিন জাগ্রত থাকুক— সাংবাদিক মাহবুব হোসেন সারমাতের নাম।

লেখক: ব্যবস্থাপনা সম্পাদক

দৈনিক বাংলাদেশ সময় ও

সভাপতি, পলিটিক্যাল রিপোর্টার্স ফোরাম

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

লোহাগড়া পৌর বিএনপির ৭ নম্বর ওয়ার্ড কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা

পুকুরে মিলল রাজনের অর্ধগলিত মরদেহ

স্পিন-স্বর্গে রিশাদের ঝড়, বাংলাদেশের সংগ্রহ ২১৩

অন্তরে আল্লাহ-রাসুল সম্পর্কে বাজে চিন্তা এলে যে ৫ কাজ করবেন

সরকারকে ধন্যবাদ জানালেন জামায়াত আমির

২ টন ইলিশসহ ৪৬ জেলে আটক

আ.লীগের ঝটিকা মিছিলের চেষ্টা, ককটেল বিস্ফোরণ

টাঙ্গাইল জেলা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতির মৃত্যুতে তারেক রহমানের শোক

উচ্চস্বরে গান বাজিয়ে রেস্টুরেন্টে কিশোরীকে ধর্ষণ, গ্রেপ্তার ৩

সালমান শাহ হত্যা মামলা, নতুন আসামি হলেন যারা

১০

ভারতকে এশিয়া কাপের ট্রফি কবে দেওয়া হবে, জানাল এসিসি

১১

একনেকে ১৯৮৮ কোটি টাকার ১৩ প্রকল্প অনুমোদন

১২

মাদ্রাসাছাত্রীকে ধর্ষণের পর হত্যা, আসামির মৃত্যুদণ্ড

১৩

দেয়ালের উপর পড়ে ছিল বস্তায় মোড়ানো নবজাতক

১৪

জোবায়েদ হত্যা : ৩ আসামির জবানবন্দির জন্য আবেদন

১৫

এবার দীঘির সঙ্গে জুটি বাঁধছেন বাপ্পারাজ

১৬

জোবায়েদের খুনিদের ফাঁসির দাবিতে আদালতপাড়ায় ছাত্রদলের বিক্ষোভ

১৭

শ্রেণিকক্ষে ফেরার ঘোষণা এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের

১৮

ওয়ানডে ইতিহাসে প্রথমবার এমন কিছু করল ওয়েস্ট ইন্ডিজ

১৯

তৃতীয়বার কন্যাসন্তান হওয়ায় মায়ের কাণ্ড

২০
X