

বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে রয়েছে একটি দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বপূর্ণ, সহযোগিতামূলক এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাভিত্তিক সম্পর্ক। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি জাপান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে এবং সে বছরই দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। এরপর থেকেই জাপান বাংলাদেশের অন্যতম ঘনিষ্ঠ উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে ভূমিকা পালন করে আসছে। দুই দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক দিন দিন সম্প্রসারিত হচ্ছে। বাংলাদেশ জাপানে তৈরি পোশাক, চামড়াজাত পণ্য, ওষুধ এবং কৃষিপণ্য রপ্তানি করে আর জাপান থেকে আমদানি করে উন্নত যন্ত্রপাতি, গাড়ি, ইলেকট্রনিক সামগ্রী ও প্রযুক্তি। বাংলাদেশের জন্য জাপান একটি সম্ভাবনাময় বাজার, বিশেষ করে পোশাক ও আইটি সেক্টরে। জাপান বাংলাদেশের মানবসম্পদ উন্নয়ন ও শিক্ষা খাতে অবদান রাখছে। প্রতি বছর বহু বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ও গবেষক জাপানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা এবং গবেষণার সুযোগ পান। জাপানি ভাষা শিক্ষা, সাংস্কৃতিক বিনিময় এবং কারিগরি প্রশিক্ষণ কর্মসূচিগুলো দুই দেশের মানুষের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়াচ্ছে।
আগামী পাঁচ বছরে বাংলাদেশ থেকে এক লাখের বেশি দক্ষ কর্মী নেবে জাপান। কর্মী নিয়োগের এ অগ্রগতি জানাতে জাপানের ন্যাশনাল বিজনেস সাপোর্ট কম্বাইন্ড কো-অপারেটিভসের (এনবিসিসি) ২৩ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছে। সোমবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় এ সাক্ষাৎ হয়। এ সময় প্রবাসী কল্যাণ ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল ও প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের এসডিজিবিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদ উপস্থিত ছিলেন। এনবিসিসি হলো ৬৫টির বেশি কোম্পানির একটি জাপানি ব্যবসায়িক ফেডারেশন, যারা সম্প্রতি দক্ষ বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগের সুবিধার্থে এ দেশের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওআই) স্বাক্ষর করেছে। এ চুক্তির লক্ষ্য জাপানে বাংলাদেশিদের প্রশিক্ষণ, সার্টিফিকেশন এবং কর্মসংস্থানের জন্য একটি কাঠামো প্রতিষ্ঠা করা, যার মাধ্যমে আগামী পাঁচ বছরে টেকনিক্যাল ইন্টার্ন ট্রেনিং প্রোগ্রাম (টিআইটিপি) এবং স্পেসিফাইড স্কিলড ওয়ার্কার্সের (এসএসডব্লিউও) মতো কর্মসূচির আওতায় এক লাখের বেশি কর্মী নিয়োগ করা হবে।
বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশে প্রবাসী শ্রমিকরা অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। তারা শুধু নিজেদের জীবিকা নির্বাহের পথ খুলে দেয় না, বরং দেশের অর্থনীতিতেও এক বিশাল অবদান রাখে। তাদের পাঠানো অর্থ অর্থাৎ, রেমিট্যান্স আজ বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার অন্যতম প্রধান উৎস। বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের পাঠানো অর্থ দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সমৃদ্ধ করছে। এই রিজার্ভ থেকেই সরকার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক দেনা, ঋণ পরিশোধ এবং পণ্য আমদানির খরচ মেটাতে পারছে। অনেক সময় রেমিট্যান্সই দেশের মুদ্রার স্থিতিশীলতা বজায় রাখে, টাকার মান ধরে রাখে এবং আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। রেমিট্যান্স গ্রামীণ অর্থনীতিতে নতুন গতি সঞ্চার করে। বিদেশে থাকা শ্রমিকরা তাদের পরিবারের কাছে অর্থ পাঠালে সেই টাকা দিয়ে পরিবারগুলো জমি ক্রয়, বাড়িঘর নির্মাণ, কৃষিকাজে বিনিয়োগ, কিংবা ছোট ব্যবসা শুরু করে। ফলে স্থানীয় উৎপাদন বৃদ্ধি পায়, কর্মসংস্থান বাড়ে এবং গ্রামীণ দারিদ্র্য কমে আসে।
এ খাতে কিছু সমস্যা ও চ্যালেঞ্জও রয়েছে। অনেক শ্রমিক অবৈধ পথে বা যথাযথ প্রশিক্ষণ ছাড়া বিদেশে যায়, ফলে তারা শোষণের শিকার হয়। আবার মধ্যপ্রাচ্যনির্ভর রেমিট্যান্স অর্থনীতিকে মাঝেমধ্যে এক ধরনের ঝুঁকির মধ্যে ফেলে। কারণ, মধ্যপ্রাচ্য বা অন্যান্য অঞ্চলে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিলে রেমিট্যান্স প্রবাহ হ্রাস পায়। তাই আমাদের উচিত হবে এ বিষয়ে একটি রোডম্যাপ তৈরি করা, যাতে এ খাত আরও বিস্তৃত করা যায়।
মন্তব্য করুন