

রাজনীতিতে কি আবারও নতুন কোনো চরিত্রের আবির্ভাব ঘটল? মাত্র পাঁচ দিনের মধ্যে পরপর তিনটি বড় ধরনের আগুনের ঘটনা রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা প্রশ্ন ও আলোচনার জন্ম দিয়েছে। রাজধানীর মিরপুরের রূপনগরে গত ১৪ অক্টোবর একটি পোশাক কারখানা ও রাসায়নিক গুদামে আগুন লেগে অঙ্গার হয়েছেন ১৬ জন। প্রায় ২৬ ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। ১৬ অক্টোবর চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (সিইপিজেড) এলাকায় একটি সাততলা ভবন আগুনে পুড়ে গেছে। ভবনে থাকা একটি টেক্সটাইল ও মেডিকেল কোম্পানির কারখানা ও গুদামের সব সামগ্রী পুড়ে ছাই হয়েছে। ঠিক এর এক দিন পর ভয়াবহ আগুনের ঘটনা ঘটে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে। বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজ একটি প্রিমিয়াম কেপিআইভুক্ত এলাকা। এরপরও কীভাবে এখানে আগুন লাগে এবং তা নিয়ন্ত্রণে আনতে কেন ২৬ ঘণ্টার মতো সময় লেগেছে, তা নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্নের অবতারণা হয়েছে। পরপর তিনটি বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাকে অনেকেই নাশকতা হিসেবে দেখছেন। ‘নাশকতা’ কি তাহলে রাজনীতির নতুন চরিত্র?
প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের এ সময় বিভিন্ন চরিত্রের আগমন ঘটেছে। কোনো কোনো চরিত্র এর আগে বিভিন্ন সময়ে দেখা গেলেও এত বড় হয়ে ওঠেনি আর কখনো। এসব চরিত্র আলোচনা ও বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। যেমন, শুরু থেকেই যে চরিত্রটি ভীতিকর চরিত্র হিসেবে দেখা যায় তা হচ্ছে ‘মব’, যা মাঝেমধ্যে এখনো তার উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। পাশাপাশি আরেকটি চরিত্র হচ্ছে, ‘তৌহিদি জনতা’।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে মব সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছে অসংখ্য মানুষ। কখনো তৌহিদি জনতার ব্যানারে, আবার কখনো অন্য কোনো নামে মব সৃষ্টি করা হয়েছে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, নারীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ, বিদেশি নাগরিক, এমনকি পুলিশ পর্যন্ত মব সহিংসতার শিকার হয়েছেন। দিনদুপুরে রাস্তাঘাট, শিক্ষাঙ্গনসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মব সহিংসতা হয়েছে। গভীর রাতে বাসাবাড়িতে মব সৃষ্টি করা হয়েছে। মবের বড় ঘটনা ছিল ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে দেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবন ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া। বুলডোজার দিয়ে এই ঐতিহাসিক স্থাপনা ভেঙে ফেলা হয়। মব সৃষ্টি করে শতাধিক মাজার ও দরগা ভাঙা হয়েছে। নারীদের ফুটবল ম্যাচ বন্ধ করতে খেলার মাঠে আক্রমণের ঘটনাও ঘটেছে। মব একটি আতঙ্কের চরিত্র হয়ে বিরাজ করছে, পাশাপাশি আছে ‘তৌহিদি জনতা’।
ভয়াবহ তিনটি আগুনের ঘটনাকে নাশকতা হিসেবে দেখার পেছনে রয়েছে নানামুখী আলোচনা। নির্বাচনের সময় যতই এগিয়ে আসবে—ততই ঘটতে থাকবে নানা ধরনের ঘটনা। রাজনীতির ময়দানে চলমান অনেক দৃশ্যই চোখে দেখা যাচ্ছে। তবে পর্দার অন্তরালে থেকে এবং বিদেশে বসে নতুন করে কে কী ঘুঁটি সাজাচ্ছে, তা বলা খুব সহজ নয়। হয়তো অনুমান করা যেতে পারে। ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন হওয়া নিয়েও রয়েছে সংশয়। অন্তর্বর্তী প্রধান প্রফেসর ইউনূস একাধিকবার ‘ইতিহাসের সেরা নির্বাচন’ উপহার দেওয়ার ঘোষণা উচ্চারণ করেছেন। তার এ ঘোষণার সঙ্গে বাস্তব অবস্থার কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। ‘সেরা নির্বাচন’ অনুষ্ঠানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি বড় ভূমিকা থাকবে। এক্ষেত্রে পুলিশের সক্ষমতা নিয়ে এখনো প্রশ্ন রয়েছে। এমনকি প্রশ্ন রয়েছে, কমিশনের সক্ষমতা নিয়েও। শাপলা প্রতীকে অনড় এনসিপির দাবির বিষয়ে নির্বাচন কমিশন শেষ অবধি কী সিদ্ধান্ত নেয়, তা দেখার বিষয়। এ ক্ষেত্রে কমিশন বর্তমান অবস্থান থেকে সরে গেলে নির্বাচন আয়োজনের মতো কঠিন পরীক্ষায় তাদের উত্তীর্ণ হওয়া নিয়ে সংশয় তৈরি হবে। নির্বাচন বিলম্বিত করার জন্য সরকারের ভেতরের সরকার বা ‘ডিপস্টেট’ কিছুদিন আগে পর্যন্ত বেশ ভালোভাবেই সক্রিয় ছিল। পরিস্থিতি বুঝে ডিপস্টেট আবারও কলকাঠি নাড়বে কি না, তা দেখার বিষয়। যদিও এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সম্প্রতি একটি টেলিভিশন চ্যানেলে দেওয়া সাক্ষাৎকার বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের অনেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে লিয়াজোঁ করে ফেলেছেন, তারা নিজেদের সেইফ এক্সিটের কথা ভাবছেন। তার এই বক্তব্য নিয়ে সামাজিক মাধ্যম, টিভি টকশোতে নানা আলোচনা, সমালোচনা ও বিতর্ক হয়েছে।
সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) ইকবাল করিম ভূঁইয়া ফেসবুকে লিখেছেন, ‘বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার আরও এক থেকে দুই বছর থাকবে। তার মতে অদক্ষতা বা আইনশৃঙ্খলা অবনতির কারণে অথবা ছাত্র চাপের মুখে সংস্কার মিশনে হাত দিলে, নির্বাচন না হয়ে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় থাকবে। তখন দুর্বল মন্ত্রীরা বদলাবে এবং ড. ইউনূসকে রাষ্ট্রপতি করে ঐকমত্যের জাতীয় সরকার গঠিত হবে। যাই ঘটুক, পাঁচটি বছর দেশকে বাস করতে হবে বিভ্রান্তি, অস্থিরতা, প্রতিবাদ, আন্দোলন, হরতাল-অবরোধ, সহিংসতার ভেতর দিয়ে। পঙ্গু অর্থনীতি দরিদ্রদের আরও বিপদে ফেলবে এবং সামাজিক অর্থনৈতিক সূচকে বাংলাদেশ ক্রমাগত পেছাতে থাকবে।’
জাতীয় নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার ঝুঁকি দেখছে বিশ্বব্যাংক। দাতা সংস্থাটি মনে করছে, নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার ঝুঁকি রয়েছে, যা নির্বাচনের পরও থেকে যেতে পারে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সঙ্গে আইনশৃঙ্খলার অবনতি নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে বলেও মনে করে বিশ্বব্যাংক। সম্প্রতি ‘বাংলাদেশ আপডেট’ শিরোনামে প্রতিবেদনে এ ঝুঁকির কথা বলা হয়েছে। প্রতিবেদনে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা প্রসঙ্গে আরও বলা হয়েছে, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের মন্থর গতি কাটছে না।
এদিকে ঘোষিত নির্বাচনের সময় এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতির ময়দানে চলছে নানা ধরনের খেলাধুলা, সমীকরণ। কখনো কখনো রাজনৈতিক দলগুলোর একে অন্যকে সমালোচনা রীতিমতো বাগযুদ্ধে পরিণত হচ্ছে। সম্প্রতি জামায়াতে ইসলামীর ওপর কামান দেগেছে শিক্ষার্থী-জনতার অভ্যুত্থানে নেতৃত্বে দেওয়া ছাত্রদের দল এনসিপি। ফেসবুকে এক পোস্টে নবগঠিত দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ‘জামায়াতের কথিত সংখানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) আন্দোলন একটি সুচিন্তিত রাজনৈতিক প্রতারণা ছাড়া আর কিছু নয়।’ নাহিদ বলেন, কমিশনের সংস্কার প্রক্রিয়া এবং সংলাপকে গণঅভ্যুত্থানের আলোকে সংবিধান ও রাষ্ট্র পুনরুত্থানের প্রকৃত প্রশ্ন থেকে ভিন্ন দিকে সরিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে পরিকল্পিতভাবে এটা করা হয়েছে। এনসিপি আহ্বায়কের অভিযোগ, জামায়াতে ইসলামী জুলাই অভ্যুত্থানের আগে ও পরে কখনোই সংস্কার আলোচনায় যুক্ত হয়নি। তারা (জামায়াত) কোনো কার্যকর প্রস্তাব দেয়নি, কোনো সাংবিধানিক দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেনি এবং গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের প্রতি কোনো অঙ্গীকারও দেখায়নি। এর কয়েকদিন পর জামায়াতও এনসিপির ওপর পাল্টা তোপ দেগেছে। জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার এনসিপিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, ‘জন্ম নিয়াই বাপের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আইসো না।’ এনসিপির আরেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীও জামায়াতকে একহাত নিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘জামায়াতের রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়ার প্রশ্নই আসে না।’ এক ফেসবুক পোস্টে নাসীরুদ্দীন মন্তব্য করেছেন, ‘দলটির (জামায়াত) দর্শন ও অতীত আচরণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা, মানচিত্র ও জাতীয় চেতনার পরিপন্থি। তারা যতবার ইতিহাসের মঞ্চে ফিরে আসতে চেয়েছে, ততবারই জনগণের অন্তর থেকে প্রতিধ্বনি উঠেছে এ দেশকে আর অন্ধকারে ফেরানো যাবে না।’
জুলাই সনদে স্বাক্ষর করা না করা নিয়ে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের গণতান্ত্রিক দল ও জোটের মধ্যে বিভেদের সুর স্পষ্ট হয়েছে সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের দিন। সনদে সই করেনি গণঅভ্যুত্থানের ছাত্রনেতাদের দল এনসিপিসহ কয়েকটি দল। তারা সনদ সই অনুষ্ঠান বর্জন করে। এ প্রসঙ্গে এনসিপি নেতা সারজিস আলম বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে দায়সারা ভাব দেখা দিয়েছে। তাদের উদ্দেশ্য নামকাওয়াস্তে জুলাই সনদ সই করে নির্বাচনের দিকে যেতে পারলেই হলো। এতে সংস্কার হোক, না হোক, সনদের আইনি ভিত্তি থাকুক, না থাকুক, পরবর্তী নির্বাচিত সরকার তা বাস্তবায়ন করুক, না করুক, কোনোমতে সই করে দায় সারল। এজন্য এনসিপি সনদ সই অনুষ্ঠানে অংশ নেয়নি বলে জানান এনসিপির এই নেতা।
সবকিছু মিলে রাজনীতি কোন দিকে যাচ্ছে, এ নিয়ে যেমন নানা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ চলছে, তেমনি জনপরিসরে ঘুরে ফিরে যে প্রশ্ন উঠছে তা হলো, ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচন হবে তো? উচ্চকক্ষ, নিম্নকক্ষ, গণভোট, গণপরিষদ, পিআর নিয়ে ময়দানের বিতর্কের অবসান হয়নি। ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সাত মাসেরও বেশি সময় ধরে চলা সংলাপেও সমঝোতায় পৌঁছাতে পারেনি সংলাপে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দল ও জোট। ঘোষিত সময়ে নির্বাচন হতে আর মাত্র সাড়ে তিন মাস বাকি। অথচ নির্বাচনমুখী কোনো সুস্পষ্ট পথরেখা দেখা যাচ্ছে না। এদিকে কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগের তৎপরতা চলছে দেশের ভেতরে বাইরে। রাজধানীতে মাঝেমধ্যেই ঝটিকা মিছিল করছে দলটি ও তার বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন। তাদের মিছিলের সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে মিছিলের কলেবর। বিচার অনুষ্ঠান ও নির্বাচনকে সামনে রেখে দলটি চ্যালেঞ্জ ছড়িয়ে দিতে চাচ্ছে কি না, তাও এক বিরাট প্রশ্ন।
এসবের মধ্যে পর পর সংঘটিত তিনটি ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নতুন আলোচনার জন্ম দেয়। রাজনীতি সংশ্লিষ্ট অনেকে এসব আগুনের ঘটনাকে নিছক দুর্ঘটনা হিসেবে না দেখে নাশকতা হিসেবে বিবেচনা করছেন। রাজনীতির নতুন চরিত্র নাশকতা এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে সামনের দিনগুলোয় আরও কী ঘটে, তা দেখার অপেক্ষায় থাকতে হবে।
লেখক: লেখক সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক
মন্তব্য করুন