

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় গত বৃহস্পতিবার ঘোষিত আপিল বিভাগের রায় নিঃসন্দেহে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। ১৪ বছর আগে যে রায়ে ত্রয়োদশ সংশোধনীকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হয়েছিল, সে রায়ই এখন ‘ত্রুটিপূর্ণ’ ও ‘কলঙ্কিত’ হিসেবে বাতিল হলো। এর ফলে সংবিধানের পরিচ্ছেদ ২ক-এ সন্নিবেশিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিধান পুনরুজ্জীবিত হলো। যদিও আপিল বিভাগ স্পষ্ট করে বলেছে, এটি অবিলম্বে কার্যকর হচ্ছে না; কার্যকর হবে পরবর্তী সংসদ থেকে—অর্থাৎ চতুর্দশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার আবির্ভাব হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারে অধীনে অনুষ্ঠিত তিনটি নির্বাচন (১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮) তুলনামূলকভাবে গ্রহণযোগ্য হয়েছিল বলেই জনমনে এ ব্যবস্থার প্রতি আস্থার ভিত শক্ত ছিল। কিন্তু ২০১১ সালে বাতিলের পরের তিনটি নির্বাচনে (২০১৪, ২০১৮, ২০২৪) সীমাহীন কারচুপি, ভোটারবিহীন নির্বাচন, ভোটের আগের দিন রাতেই ব্যালট বাক্স পূর্ণ করা, ডামি নির্বাচন রাজনৈতিক দ্বন্দ্বকে আরও তীব্র করেছে। এ প্রেক্ষাপটে আপিল বিভাগের রায় একটি নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। বিশেষত যখন দেশ সদ্য অতিক্রম করেছে রাজনৈতিক উত্তাল সময় আর সামনের দিনে গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয়তা সর্বজনস্বীকৃত হয়ে উঠেছে। রায়ে বলা হয়েছে, ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সৃষ্ট কাঠামোই পুনরুজ্জীবিত হলো। অর্থাৎ নির্বাচনকালীন সরকার হবে নির্দলীয়, প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ হবে সংসদ ভাঙার ১৫ দিনের মধ্যে এবং নতুন সরকার গঠিত হওয়া পর্যন্ত তারা দায়িত্ব পালন করবে—এ পরীক্ষিত ও পরিচিত কাঠামোতে।
রায়ের রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ায় দেখা যাচ্ছে—বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি ও আরও কয়েকটি দল এটিকে ‘স্বাগত’ জানিয়েছে। তারা মনে করছে, তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ফিরে আসার মাধ্যমে দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা আবারও আস্থার জায়গায় দাঁড়াতে পারবে। অন্যদিকে অ্যাটর্নি জেনারেল রায়কে বলেছেন ‘গণতন্ত্রের মহাসড়কে ফিরে আসা’। যদিও এখানে রাজনৈতিক বক্তব্যের তীব্রতা চোখে পড়ে; তবে মূল সত্য হলো, বিচার বিভাগ দীর্ঘদিন পর একটি বহুল আলোচিত, রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল বিষয়ে পুনরায় অবস্থান বদলে জনগণের আস্থার পরিসরে ফিরে এসেছে। এখন প্রশ্ন হলো, এ রায় বাস্তবায়িত হলে ভবিষ্যৎ নির্বাচনের চিত্র কেমন হবে? তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা কি সত্যিই অতীতের মতোই জনআস্থা অর্জন করতে পারবে, নাকি এর কাঠামোয় নতুন সংস্কার প্রয়োজন?
এ প্রশ্নগুলোর উত্তর নির্ভর করবে তিনটি বিষয়ের ওপর। প্রথমত, রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্বশীল আচরণ; দ্বিতীয়ত, তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার সম্ভাব্য দুর্বলতাগুলো সংশোধনের ইচ্ছাশক্তি এবং তৃতীয়ত, গণভোট ও সাংবিধানিক সংস্কারের মতো দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়ায় সব পক্ষের অংশগ্রহণ। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা কোনো জাদুকাঠি নয়। অতীতেও এর অপব্যবহার হয়েছে, পক্ষপাতের অভিযোগও উঠেছে। তাই রায়-পরবর্তী আনন্দের সঙ্গে প্রয়োজন সতর্কতা, যেন এ ব্যবস্থাকে রাজনৈতিক সুবিধাবাদী চক্র আবারও নিজেদের স্বার্থে অপব্যবহার করতে না পারে। বাংলাদেশের গণতন্ত্র আজ একটি পুনর্গঠনের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পুনর্বহাল সেই যাত্রার প্রথম ধাপ মাত্র, শেষ নয়। সামনে রয়েছে কাঠামোগত পরিবর্তন, রাজনৈতিক সংস্কৃতি উন্নয়ন ও আস্থা পুনর্গঠনের দীর্ঘ পথ। গণতন্ত্রের ভিত্তি স্থায়ী করতে হলে প্রয়োজন শুধু একটি নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নয়, প্রয়োজন রাজনৈতিক সততা, দায়িত্বশীলতা এবং জনগণের প্রতি প্রকৃত জবাবদিহি।
এ রায় তাই একদিকে নতুন আশার সঞ্চার করছে, অন্যদিকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে, গণতন্ত্রকে রক্ষা করার দায়িত্ব শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলোর, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর এবং সর্বোপরি জনগণেরই।
মন্তব্য করুন