

বাংলাদেশের বিচার বিভাগ বহু দশক ধরে যে কাঙ্ক্ষিত স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতার প্রত্যাশায় অপেক্ষা করেছে, সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সেই প্রয়াস এক নতুন দিগন্তে পা রাখল। বহুল আলোচিত ও প্রত্যাশিত এ সচিবালয়ের কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হওয়াকে নিঃসন্দেহে বিচার বিভাগের সংস্কারযাত্রার একটি মৌলিক ও কাঠামোগত অগ্রগতি হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।
অধ্যাদেশ জারির সঙ্গে সঙ্গে সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় কার্যকর করার উদ্যোগ শুরু হয়েছে। রেজিস্ট্রার জেনারেলকে সচিবের অতিরিক্ত দায়িত্ব প্রদানসহ প্রশাসনিক কাঠামো দ্রুত গড়ে তোলার যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা বিচার বিভাগের পরিচালনায় একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। দীর্ঘদিন ধরে বিচারকদের নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি ও শৃঙ্খলাবিধান নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণে থাকায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। নতুন অধ্যাদেশের ৭ ধারা কার্যকর হলে এ নিয়ন্ত্রণ প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন সচিবালয়ের হাতে ন্যস্ত হবে, যা বিচার বিভাগের সাংবিধানিক অবস্থানকে সুদৃঢ় করবে।
বিশ্লেষকদের মতে, এটি বাংলাদেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে এক মাইলফলক। আইনজীবী শিশির মনির যথার্থই বলেছেন, অধস্তন আদালত প্রশাসনিক কর্তৃত্ব থেকে মুক্ত হয়ে প্রকৃত তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ এখন উচ্চ আদালতের হাতে যাচ্ছে। এর ফলে বিচারকদের শৃঙ্খলা, বদলি বা প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত আর নির্বাহী বিভাগের প্রভাবাধীন থাকবে না। রাষ্ট্রের তিন অঙ্গের মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও এটি বড় ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন আনে। অধ্যাদেশের মাধ্যমে আর্থিক স্বাধীনতাও নিশ্চিত করা হয়েছে। ৫০ কোটি টাকার প্রকল্পে প্রধান বিচারপতির অনুমোদন প্রদান করার ক্ষমতা বিচার বিভাগের উন্নয়ন পরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখবে। অতীতে যেসব ক্ষেত্রে দীর্ঘ প্রশাসনিক জটিলতায় বিচার বিভাগের প্রকল্প বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হতো, এখন সে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটবে, এটা প্রত্যাশিত। এ সত্য অস্বীকারের উপায় নেই যে, বিচার বিভাগ পৃথককরণের রায় ঘোষিত হয় ১৯৯৯ সালে, কিন্তু সেই রায়ের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন আজও সম্পন্ন হয়নি। ২০০৭ সালে বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা ঘোষণা করা হলেও প্রশাসনিক কর্তৃত্বের বড় অংশ থেকেই গেছে আইন মন্ত্রণালয়ের হাতে। এই দ্বৈত শাসন দূর করার দাবি বারবার উত্থাপিত হয়েছে বিচার বিভাগ ও নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে। বর্তমান ব্যবস্থা সেই দীর্ঘদিনের সাংবিধানিক ও নৈতিক দাবি পূরণের পথ প্রশস্ত করছে। এ পদক্ষেপ বাস্তবায়নে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা অবশ্যই ইতিবাচক। তবে এখানেই কাজ শেষ নয়। সচিবালয়ের কাঠামো দাঁড় করানো, জনবল নিয়োগ, প্রশাসনিক পুনর্গঠন এবং ৭ ধারা কার্যকর করতে প্রয়োজনীয় গেজেট প্রকাশ ইত্যাদি কাজ এখন নিষ্ঠা ও দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করতে হবে। আগামীতে যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন, বিচার বিভাগের এ অর্জন যাতে ব্যাহত না হয়, তার নিশ্চয়তা দিতে হবে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কোনো সরকারের অনুগ্রহ নয়, এটি সংবিধানপ্রদত্ত অধিকার ও রাষ্ট্রের মৌলিক ভিত্তি। সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত বিচার বিভাগকে যেমন দৃঢ় ভিত্তি দেবে, তেমনি নাগরিকের ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকারকে করবে আরও সুসংহত। এখন প্রয়োজন বিচারকদের পেশাগত শৃঙ্খলা রক্ষা, স্বচ্ছতা বৃদ্ধি এবং দ্রুত ও মানসম্মত বিচারসেবা নিশ্চিত করা। স্বতন্ত্র সচিবালয় সেই কাঠামো তৈরি করেছে; এখন এটিকে কার্যকর ও জনবান্ধব করতে সমন্বিত পরিকল্পনা ও অটল রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন।
আমরা মনে করি, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রাষ্ট্রের ন্যায়, সমতা ও গণতন্ত্রের ভিত্তি। সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠা সেই ভিত্তিকে আরও শক্তিশালী করার পথে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
মন্তব্য করুন