

বর্তমান পৃথিবী নানা সংকট, সংঘাত ও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ দূষণ, প্রাকৃতিক সম্পদের অব্যবস্থাপনা, অপরাধ বৃদ্ধি, সামাজিক অবক্ষয় এবং প্রযুক্তির অপব্যবহার—সব মিলিয়ে মানবসভ্যতা এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এমন সময় প্রয়োজন নিরাপদ, সুন্দর এবং সার্বজনীনভাবে বাসযোগ্য পৃথিবী বিনির্মাণ। এ লক্ষ্য অর্জনের পথে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে মানুষ নিজেই—ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সমন্বিত প্রচেষ্টায়। তাই একটি শান্তিময় ও নিরাপদ পৃথিবী গড়তে আমাদের করণীয়গুলো সুস্পষ্টভাবে নির্ধারিত হওয়া জরুরি। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে স্থানীয় সরকার বিভাগ কর্তৃক সরাসরি বাস্তবায়নাধীন ইম্প্রুভমেন্ট অব আরবান পাবলিক হেলথ প্রিভেন্টিভ সার্ভিসেস প্রজেক্ট (আইইউপিএইচপিএসপি)-এর আওতায় যে কাজগুলো চলমান রয়েছে, তা হলো—বায়ু ও শব্দদূষণ রোধ, অতিমাত্রার তাপ রোধ, জলবায়ু পরিবর্তনে ইতিবাচক কাজ (যেমন বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি, ছাদবাগান), মোবাইল ও পাবলিক টয়লেট নির্মাণ, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া সম্পর্কে জনসচেতনতা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে হাত ধোয়ার স্থান, সুপেয় পানির স্থান, গরমের সময় বিশ্রামাগার তৈরি ইত্যাদি। এসব কাজ বাস্তবায়নের পাশাপাশি মানুষের আচরণ পরিবর্তনের জন্য প্রশিক্ষণ, অবহিতকরণ কর্মশালা, ক্যাম্পেইন উদ্বুদ্ধকরণ বিভিন্ন ধরনের মেসেজসহ লিফলেট, পোস্টার, ব্রশিয়ার, বাস ও অন্যান্য পরিবহনে ব্র্যান্ডিং কার্যক্রম চলমান আছে। মানুষের আচরণের ইতিবাচক পরিবর্তনই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নিরাপদ পৃথিবী বিনির্মাণে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। আর এ লক্ষ্যেই বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে স্থানীয় সরকার বিভাগ ইম্প্রুভমেন্ট অব আরবান পাবলিক হেলথ প্রিভেন্টিভ সার্ভিসেস (আইইউপিএইচপিএস) শীর্ষক প্রকল্পের মাধ্যমে সরাসরি এ কাজগুলো বাস্তবায়ন করছে। প্রকল্প কর্তৃপক্ষ এসব কাজ বাস্তবায়নে নগরবাসীর আন্তরিক ও দায়িত্বশীল ভূমিকা আশা করছে। এখন দেখা যাক ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নিরাপদ পৃথিবী বিনির্মাণে কী ধরনের চ্যালেঞ্জ আছে আর তার উত্তরণের উপায় কী?
পরিবেশ সংরক্ষণ ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ
নিরাপদ পৃথিবীর প্রথম শর্ত হচ্ছে একটি সুস্থ পরিবেশ। বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, শব্দদূষণ, মাটিদূষণ আমাদের জীবনকে প্রতিনিয়ত ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে। এজন্য মানুষকে পরিবেশ-সচেতন হতে হবে, প্লাস্টিকের ব্যবহার কমাতে হবে এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য পণ্য ব্যবহারে মনোযোগীসহ সবাইকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে; শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও যানবাহনে দূষণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করার পাশাপাশি শহর ও গ্রামে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি জোরদার করতে হবে। কেননা পরিবেশ সুস্থ রাখলে পৃথিবী হবে বাসযোগ্য আর ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পাবে টিকে থাকার নিরাপদ ভরসা।
নেতিবাচক জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা
অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণ, বন উজাড় এবং অপরিকল্পিত উন্নয়ন আমাদের জলবায়ুকে চরম অস্থির করে তুলছে। এজন্য আমরা যে পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করতে পারি—নবায়নযোগ্য জ্বালানির জন্য সোলার, উইন্ড, বায়োগ্যাস ব্যবহার বাড়াতে হবে। জ্বালানি সাশ্রয়ী জীবনযাপন গ্রহণ করা প্রয়োজন। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আন্তর্জাতিক জলবায়ু চুক্তিগুলো কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। এসব উদ্যোগ পৃথিবীকে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করতে সহায়তা করবে।
শান্তি, শৃঙ্খলা, সহনশীলতা ও মানবিক মূল্যবোধ
নিরাপদ পৃথিবী মানেই শান্তি, শৃঙ্খলা, সহনশীলতা ও মানবিক মূল্যবোধের পৃথিবী। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সব স্তরে শান্তি, শৃঙ্খলা, সহনশীলতা ও মানবিক মূল্যবোধের শিক্ষা থাকা অত্যাবশ্যক। পরিবারে মানবিক শিক্ষা, সামাজিক মূল্যবোধ ও সহনশীলতা গড়ে তোলা জরুরি। এ ছাড়া ঘৃণা, সহিংসতা ও বৈষম্যমুক্ত সমাজ গড়তে স্কুল, কলেজ এবং গণমাধ্যমকে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে হবে। সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সংঘাত নিরসনে সংলাপ ও কূটনীতির পথকে। মনে রাখতে হবে, সহনশীলতা ও সহমর্মিতা শান্তির পৃথিবী বিনির্মাণের প্রধান ভিত্তি।
প্রযুক্তির নিরাপদ ও দায়িত্বশীল ব্যবহার
ডিজিটাল পৃথিবী যেমন সুবিধা এনে দিয়েছে, তেমনি তৈরি করেছে নানা ঝুঁকি—সাইবার অপরাধ, ভ্রান্ত তথ্য, গোপনীয়তা লঙ্ঘন ইত্যাদি। এ ক্ষেত্রে শিশু ও তরুণদের প্রযুক্তি ব্যবহারে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে; সাইবার নিরাপত্তা আইন ও নীতিমালা কঠোরভাবে প্রয়োগ করা প্রয়োজন; প্রযুক্তিকে মানবকল্যাণে ব্যবহার করার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। কারণ, দায়িত্বশীল প্রযুক্তি ব্যবহার পৃথিবীকে আরও নিরাপদ করবে।
দুর্যোগ প্রস্তুতি ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা
ভূমিকম্প, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়সহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি বাড়ছে। ফলে দুর্যোগ প্রস্তুতি সম্পর্কে জনগণকে নিয়মিত অবহিত করতে হবে; আশ্রয়কেন্দ্র, উদ্ধার সামগ্রী ও জরুরি সেবা ব্যবস্থাকে আরও আধুনিক ও শক্তিশালী করতে হবে; বিজ্ঞানভিত্তিক প্রারম্ভিক সতর্কীকরণ ব্যবস্থা সম্প্রসারণ করা জরুরি। কারণ, সঠিক প্রস্তুতি জীবনের ক্ষতি কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
সামাজিক নিরাপত্তা ও ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা
অর্থনৈতিক বৈষম্য, দারিদ্র্য ও বেকারত্ব সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করে। ফলে সবার জন্য মানসম্মত শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে হবে; নারী, শিশু, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধীদের নিরাপত্তা ও অধিকার রক্ষা করতে হবে। যেখানে সামাজিক ন্যায়বিচার থাকবে, সেখানে শান্তি ও নিরাপত্তা স্বাভাবিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে।
আইন মেনে চলা ও জবাবদিহি
একটি নিরাপদ পৃথিবী গঠনে নাগরিকদের আইন মেনে চলা এবং রাষ্ট্রের স্বচ্ছ জবাবদিহি অত্যন্ত জরুরি। কারণ, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাকে দক্ষ, মানবিক ও দুর্নীতিমুক্ত হতে হবে; নাগরিকদের দায়িত্বশীল আচরণ, ট্রাফিক আইন মানা, অপরাধ দমনে সহযোগিতা করা প্রয়োজন, যেখানে আইন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়, সেখানে নিরাপত্তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাড়ে।
নিরাপদ পৃথিবী হঠাৎ করে তৈরি হয় না। এটি গড়ে ওঠে সচেতন মানুষ, দায়িত্বশীল সমাজ ও কার্যকর রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মাধ্যমে। ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক, সামাজিক, জাতীয় ও বৈশ্বিক প্রতিটি উদ্যোগে নিরাপত্তা, মানবিকতা এবং পরিবেশ-সচেতনতা রাখতে হবে। আমরা যদি আজই ইতিবাচক পরিবর্তনের পথে এগিয়ে যাই, তবে আগামী প্রজন্মের জন্য রেখে যেতে পারব এক শান্তিময়, সুশৃঙ্খল, সুন্দর ও নিরাপদ পৃথিবী।
লেখক: বিহেভিয়ার চেঞ্জ কমিউনিকেশন স্পেশালিস্ট, ইম্প্রুভমেন্ট অব আরবান পাবলিক হেলথ প্রিভেন্টিভ সার্ভিসেস প্রজেক্ট (আইইউপিএইচপিএসপি), স্থানীয় সরকার বিভাগ
মন্তব্য করুন