

তপশিল ঘোষণার পরও নির্বাচন নিয়ে সংশয়-শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। খোদ রাজধানীর বুকে দিনদুপুরে ঢাকা-৮ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী শরিফ ওসমান হাদি মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। তপশিল ঘোষণার পরদিনই একজন প্রার্থীর গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা নজিরবিহীন। হাদির গুলিবিদ্ধ হওয়া রাজনৈতিক মহল ও জনমনে অনেক কঠিন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। কোনো মহল নির্বাচন বানচাল করার ছক তৈরি করছে কি না, সেই প্রশ্নও উঠেছে। ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ওসমান হাদি আসন্ন নির্বাচনে শুধু একজন প্রার্থী ছিলেন না, তিনি ছিলেন জুলাই গণঅভ্যুত্থানের একজন যোদ্ধা। প্রার্থী গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম নয়। প্রথম ধাপে বিএনপির প্রার্থী ঘোষণার পর চট্টগ্রামের একটি আসনের প্রার্থী এরশাদউল্লাহ গণসংযোগের সময় গুলিবিদ্ধ হন। ওই ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে একজন নিহত হন। এসব ঘটনায় নির্বাচন নিয়ে কোনো অদ্ভুত আঁধার দেশকে গ্রাস করবে কি না, এ প্রশ্ন উঠতেই পারে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসিরউদ্দীন ১১ ডিসেম্বর জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে ১২ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদ ও একই দিনে গণভোটের তারিখ ঘোষণা করেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বহুল প্রত্যাশিত এ ঘোষণাকে স্বাগত জানায়। দলগুলোর প্রতিক্রিয়া ছিল, সিইসির ঘোষণায় নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তার অবসান হয়েছে। এ ঘোষণা রাজনৈতিক ইতিহাসে বড় ও উল্লেখযোগ্য ঘটনা। তবে তপশিল ঘোষণার ২০ ঘণ্টার মধ্যে ওসমান হাদির গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনাকে প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি অশনিসংকেত হিসেবে দেখছে। জামায়াত এ ঘোষণার উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। উদ্বিগ্ন এনসিপি নেতারাও। এনসিপি নেতাদের নিরাপত্তা নিয়েও বিভিন্ন মহল থেকে উদ্বেগের কথা জানানো হয়েছে।
নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে ভারতে পালিয়ে যাওয়া কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক মন্ত্রী, এমপি ও বিভিন্ন নেতাদের উসকানিতে দেশে নানামুখী তৎপরতা মোকাবিলা করা। শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে দলের অনেক নেতা সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে অব্যাহতভাবে উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। তাদের অনেকে আসন্ন নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিচ্ছেন। তপশিল ঘোষণার পর লক্ষ্মীপুর জেলা নির্বাচন কার্যালয়ে আগুন দেওয়ায় ঘটনা ঘটেছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে মাঝেমধ্যেই ঝটিকা মিছিল বের হচ্ছে। তপশিলের প্রতিবাদে রাতের বেলায় একটি মহাসড়কে অবরোধ সৃষ্টি করা হয়েছিল। নির্বাচনের তারিখ যতই এগিয়ে আসবে, এ ধরনের তৎপরতা বাড়তেই থাকবে, বিষয়টি সহজেই অনুমান করা যায়। প্রধান উপদেষ্টা স্বয়ং ক্ষমতাচ্যুত শক্তি নির্বাচন বানচাল করতে চাইছে বলে রাজনৈতিক দলগুলোকে সতর্ক করেছেন। হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, এর পেছনে বিরাট শক্তি কাজ করছে। ষড়যন্ত্রকারীদের উদ্দেশ্য হচ্ছে নির্বাচন হতে না দেওয়া। তারা প্রশিক্ষিত শুটার নিয়ে মাঠে নেমেছে। ষড়যন্ত্রকারীরা তাদের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করেছে। উল্লেখ্য, হাদি হত্যার চেষ্টার প্রধান অভিযুক্ত ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতা।
তবে নির্বাচন নিয়ে এক ধরনের দোলাচলের মধ্যে একটি বিষয়ের জল্পনা-কল্পনা ও অনিশ্চয়তার অবসান হতে যাচ্ছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ১৭ বছর নির্বাসিত জীবনের অবসান ঘটিয়ে ২৫ ডিসেম্বর দেশে ফিরছেন। ১২ ডিসেম্বর রাতে দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠক শেষে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ তথ্য জানান। তপশিল ঘোষণার এক দিন পর তারেক রহমানের দেশে ফেরার তারিখ জানানো হলো। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরেও তারেক রহমান এখন পর্যন্ত কেন দেশে ফিরছেন না, এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই রাজনীতিতে নানা ধরনের কথা বলাবলি হচ্ছিল। গুঞ্জন-গুজবের ডালপালা বিস্তার লাভ করে চলছিল। যদিও দল থেকে বিভিন্ন সময় বলা হয়েছে যে, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সময় হলেই দেশে ফিরবেন। তবে কয়েক মাস ধরে বলা হচ্ছিল, তারেক রহমান শিগগিরই দেশে ফিরবেন। এর মধ্যে ফেসবুক পোস্টে দেওয়া তারই একটি বক্তব্য দেশে ফেরার অনিশ্চয়তা বাড়িয়ে দেয়, যা নতুন করে তার দেশে না ফেরার জল্পনা আরও জোরালো করে। ফেসবুকের ওই পোস্টে তারেক রহমান বলেছিলেন, ‘দেশে ফেরার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ অবারিত ও একক নিয়ন্ত্রণাধীন নয়।’ তার এ বক্তব্যের পর প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোর সমালোচনার মুখে বিএনপি নেতারা আভাস দিচ্ছিলেন, ‘নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে ফিরছেন না তারেক রহমান।’ তবে তারেক রহমানের ফিরে আসার খবর দলের নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করবে, বিএনপি রাজনীতিতে গতি বাড়াবে—এ কথা বলাই যায়। ২৩ নভেম্বর থেকে বিএনপি চেয়ারপারসনের সংকটাপন্ন অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা, তারেক রহমানের অনুপস্থিতি আগামী নির্বাচনে ক্ষমতাপ্রত্যাশী প্রধান রাজনৈতিক দলটিকে এক ধরনের সংকটের মধ্যে ফেলে দেয়। তারেক রহমানের অনুপস্থিতিতেই দুই দফায় বিএনপি নির্বাচনে ২৭২ আসনে প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করে। প্রথম দফা তালিকা ঘোষণার পর বেশ কয়েকটি আসনে মনোনয়নবঞ্চিতরা বিক্ষোভ করেন। বঞ্চিতদের কর্মী-সমর্থকরা সড়ক অবরোধসহ বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি পালন করেন। এর মধ্যে দ্বিতীয় দফা তালিকা ঘোষণা করা হয়েছে। এবারও বেশ কয়েকটি আসনে মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবি ওঠে। তবে আসন ভাগাভাগি নিয়ে বিএনপির ওপর চটেছে মিত্র দলগুলো। বিএনপি ২৮টি আসনে প্রার্থী মনোনয়ন দেয়নি। ধারণা করা হচ্ছে, এসব আসন শরিকদের জন্য রাখা হয়েছে। এখন পর্যন্ত শরিকদের আসনের বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো ঘোষণা না দেওয়ায়, শরিক দলের এক নেতা বলেছেন, ‘মনে হচ্ছে বিএনপি একলা চলো নীতি গ্রহণ করেছে। জামায়াত যেখানে বন্ধু বাড়াচ্ছে সেখানে বিএনপি মিত্রদের ছেঁটে ফেলছে। এটা পুরোপুরি একটা আত্মঘাতী জায়গা। এটি দলগুলোকে ক্ষুব্ধ করার পাশাপাশি অনাস্থা ও অবিশ্বাসের জন্ম দিয়েছে। এটি বাড়তে দিলে ঝুঁকিপূর্ণ রাজনৈতিক দূরত্ব বাড়তে পারে।’ এ বক্তব্য গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতা বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হকের (সমকাল, ১১ ডিসেম্বর)। তবে শরিক দলগুলোর ক্ষোভের পর বিএনপি তাদের সঙ্গে বসে আসন ভাগাভাগির বিষয়ে সমঝোতা করবে, গণমাধ্যমে এমন খবর বেরিয়েছে।
তপশিল ঘোষণার আগে রাজনৈতিক দলগুলো প্রার্থী ঘোষণা করে নিজ নিজ দলকে পুরোপুরি নির্বাচনমুখী করে তোলে। বিএনপি ২৭২ আসনে প্রার্থী ঘোষণার পর বাকি ২৮ আসনের দিকে এখন মিত্র দলগুলোর দৃষ্টি নিবন্ধ হয়ে আছে। জামায়াতে ইসলামী অনেক আগেভাগে ৩০০ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করে গণসংযোগে বেশ এগিয়ে আছে। গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের নবগঠিত দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এরই মধ্যে ১২৫ আসনে প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে। তপশিল ঘোষণার পর প্রার্থীরা যখন নির্বাচনী দৌড়ে পুরোপুরি ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, ঠিক তখনই ওসমান হাদির গুলিবিদ্ধ হয়ে জীবন সংশয়ের ঘটনায় নির্বাচনী পরিবেশ নিয়ে নতুন করে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এ ঘটনা নিঃসন্দেহে প্রার্থীদের আতঙ্কিত করবে। ভয়ের ছায়া তাদের গ্রাস করে থাকবে। প্রকাশ্য দিবালোকে হাদিকে মাথায় গুলি করার ঘটনা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দিকে নতুন করে আঙুল তুলেছে।
তপশিল ঘোষণার বেশ আগে থেকে নির্বাচন সামনে রেখে আন্ডারওয়ার্ল্ড সক্রিয় হয়ে ওঠে। সীমান্ত দিয়ে অস্ত্র ঢোকার খবর বেরিয়েছে সংবাদপত্রে। গণঅভ্যুত্থানের পর বিভিন্ন থানা ও পুলিশ ফাঁড়ি থেকে লুট হওয়া অস্ত্রের মধ্যে এখনো পর্যন্ত প্রায় দুই হাজার অস্ত্র উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। সীমান্ত দিয়েও অস্ত্র ঢোকা এবং আন্ডারওয়ার্ল্ডের তৎপরতা নির্বাচনী পরিবেশকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের কিছু নীতি ও ভুল পদক্ষেপ বর্তমান অবস্থা তৈরি করেছে। সরকারপ্রধান প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস ‘ইতিহাসের সেরা নির্বাচন’ আয়োজনের কথা বললেও শুরু থেকে নির্বাচনের বিষয়টি প্রধান অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনায় নেননি। সেইসঙ্গে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট দক্ষতা দেখাতে পারেননি। শিক্ষার্থী-জনতার অভ্যুত্থানের পর সংস্কারের আকাঙ্ক্ষা ও বিদ্যমান ব্যবস্থার পরিবর্তন, রাজনৈতিক মহল ও রাজনীতিবহির্ভূত সবার প্রত্যাশার মধ্যে ছিল। তবে সংস্কারের ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার এত বেশি এজেন্ডা নিয়ে ফেলে, যার কোনো প্রয়োজনই ছিল না। এ প্রসঙ্গে মিডিয়া সংস্কার, নারী সংস্কার ও স্বাস্থ্য খাত সংস্কারের কথা উল্লেখ করা যায়। এসব সংস্কার কমিশনের কোনো হদিস এখন আর জানা যাচ্ছে না। সংস্কারের নামে সময়ক্ষেপণেরও অভিযোগ রয়েছে।
নির্বাচন বিলম্বিত করার চেষ্টাও অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে ছিল। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কয়েকজন উপদেষ্টা ক্ষমতা টেনে নিয়ে যাওয়ার পক্ষেই ছিলেন। প্রফেসর ইউনূসের সরকার দায়িত্ব নেওয়ার ১৬ মাস পর নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা করা হলো। বর্তমান সময়ের জরুরি বিষয়টি হচ্ছে নির্বাচনের আগে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা। এটি করা না গেলে একটি ভালো নির্বাচন করা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। ১৩ ডিসেম্বর দৈনিক কালবেলার প্রধান শিরোনাম ছিল, ‘ভোটের মাঠে ভয়ের ছায়া’। খবরে বলা হয়েছে, ‘দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অবৈধ অস্ত্রধারীরা, ফিল্মি স্টাইলে চলছে একের পর এক গুলি, আতঙ্ক ছড়িয়েছে নির্বাচনী প্রচারে, নির্বাচনী মাঠে বিরূপ পরিবেশের শঙ্কা, সেপ্টেম্বরে ২৯৭টি খুনের মামলা, অক্টোবর ৩২০টি।’ দৈনিক কালবেলার খবর শুধু নির্বাচনী পরিবেশ নিয়ে নয়, জনমনেও নিরাপত্তাহীনতার শঙ্কা তৈরি করে বৈকি।
শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনামলে জনগণ ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। তিনটি একতরফা ও জালিয়াতের নির্বাচন ভোট ব্যবস্থাকেই ধ্বংস করে দেয়, যা গণতন্ত্রের কফিনেও পেরেক ঠুকে দিয়েছে। চব্বিশের রক্তক্ষয়ী গণঅভ্যুত্থানের পর জনগণ ভোট দেওয়ার অপেক্ষায় আছে। ১১ ডিসেম্বর তপশিল ঘোষণার মধ্য দিয়ে নির্বাচনের ট্রেনের যাত্রা শুরু করে দিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। বহু প্রতীক্ষিত নির্বাচন এখন জনগণের প্রত্যাশার মধ্যে অবস্থান করছে। আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনী ট্রেনের গন্তব্যে পৌঁছানোর কথা। চালকের আসনে বসা নির্বাচন কমিশন কি এই ট্রেন নির্বিঘ্নে-নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছে দিতে পারবে, সে প্রশ্ন নির্বাচন পর্যন্ত থেকেই যাবে। বলা যায়, প্রত্যাশার মধ্যে নির্বাচন আছে, তবে নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত এ নিয়ে উদ্বেগও রয়েছে।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক
মন্তব্য করুন