মনজুরুল আহসান বুলবুল
প্রকাশ : ১৯ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম
আপডেট : ১৯ জুন ২০২৩, ০৮:৫৮ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

সাংবাদিক পেটানোদের রাজনৈতিক সমর্থন বন্ধ করতে হবে

মনজুরুল আহসান বুলবুল। পুরোনো ছবি
মনজুরুল আহসান বুলবুল। পুরোনো ছবি

বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য হলো, স্বাধীন বাংলাদেশে কোনো সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার হয়নি। ৪০ বছর ধরে এ পেশায় নিয়োজিত থেকে দেখছি, সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের তালিকা শুধুই বাড়ছে। এখন পর্যন্ত তিনটি সাংবাদিক হত্যা মামলার ঘটনায় আংশিক আইনি সমাধান আমাদের সামনে এসেছে। কিন্তু এগুলোর একটিও পূর্ণাঙ্গ বিচার বলা যাবে কি না, সেটি আলোচনাসাপেক্ষ।

তিনটি আংশিক বিচার হওয়ার একটি হচ্ছে হারুন-অর-রশিদ খোকন হত্যাকাণ্ড। তার হত্যা মামলার পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট আর বিচার এক বিষয় নয়। এমন আরেকটি হত্যা মামলা হলো, সাংবাদিক মানিক সাহা হত্যাকাণ্ড। এটি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে, রায়ও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তার রায় সাংবাদিকরা গ্রহণ করেননি, পরিবাররাও গ্রহণ করেনি। কারণ এটি ত্রুটিপূর্ণ। আরেকটি হত্যাকাণ্ড হলো, গৌতম দাস। সমকালের ফরিদপুর প্রতিনিধি ছিলেন তিনি। তার হত্যা মামলায় নিম্ন আদালতের রায় হয়েছে। কিন্তু উচ্চ আদালতে এটি চূড়ান্ত নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে। যাদের বিরুদ্ধে রায় দেওয়া হয়েছিল, তারা জেল থেকে বের হয়ে গেছে, না হয় মারা গেছে। এগুলো দুঃখজনক বিষয়।

সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডে নিয়োজিত তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ ৯৮ বারের মতো সময় নিয়ে কোনো অপরাধী ধরতে পারেনি। তদন্ত প্রতিবেদনও দাখিল করা হয়নি। এটা থেকে বোঝা যায় যে, বাংলাদেশে সাংবাদিক হত্যার কোনো বিচার হয় না। এই কথাটি শুধু আমি বলি না; সারা পৃথিবী বলে। ওয়ার্ল্ড ফ্রিডম ফোরামের যে ম্যাপ রয়েছে, তাতে বলা হয়, বাংলাদেশের গণমাধ্যমের ক্ষেত্রে আংশিক স্বাধীন দেশ বাংলাদেশ। কেন বাংলাদেশকে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ‘পার্শিয়ালি ফ্রি’ বলা হয়, তা আমাদের ভাবতে হবে। কারণ এ দেশে সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচার হয় না।

নাদিম হত্যাকাণ্ডটি খুবই মর্মান্তিক। আমরা যারা সাংবাদিকতা করি তারা ঝুঁকি নিয়েই এ পেশায় আসি। আমরা ঝামেলার মধ্যেই সাংবাদিকতা করি। বাড়ি থেকে বের হবো এবং পেশাগত দায়িত্ব পালন করার পর আমাদের বাড়ি ফিরতে দেওয়া হবে না, হত্যা করা হবে—এমন ঝুঁকি আর কোনো পেশায় নেই। নাদিমের বেলায় তাই ঘটেছে। আমরা খুব আতঙ্কিত যে, এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার হবে কি না। আমরা তদন্তের পর বিচার দাবি করি। কিন্তু আমার কিছু সুনির্দিষ্ট দাবি আছে। প্রথমত, এই যে ক্ষমতাধর চেয়ারম্যান, যিনি খুনের দায়ে চিহ্নিত, তার বিরুদ্ধে আরও মামলা আছে। আওয়ামী লীগের কাছে আমার প্রথম দাবি, তার মতো একটা লম্পট চরিত্রের মানুষকে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করা। এতে আওয়ামী লীগের কোনো ক্ষতি হবে না। আমি চাই তাকে বরখাস্ত করা হোক।

আমি আওয়ামী লীগকে ধন্যবাদ জানাই কারণ, এরই মধ্যে তারা অভিযুক্ত চেয়ারম্যান ও তার ছেলেকে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার করেছে। এ হত্যাকাণ্ডে তাদের নাম এসেছে, অভিযুক্ত সবাইকে বহিষ্কার করা হোক। আদালতে যদি তারা নির্দোষ প্রমাণিত হয়, শুধু তখন তাদের পদ ফিরিয়ে দেওয়া হোক। আমার দ্বিতীয় সুপারিশ হলো, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় যেন তাকে ইউপি চেয়ারম্যানের পদ থেকে বরখাস্ত করে। এমন লম্পট চেয়ারম্যান না থাকলে স্থানীয় সরকারের কোনো ক্ষতি হবে না। তৃতীয়ত, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে দাবি জানাই, দ্রুত খুনিদের আইনের আওতায় আনা হোক। গ্রেপ্তারের পর দ্রুত বিচার করাটাও আমার একান্ত দাবি। সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের মতো ৯৮ বার সময় নেওয়া হলে সেটা হবে আমাদের দুর্ভাগ্য।

চতুর্থত, প্রাথমিকভাবে স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় তথ্য মন্ত্রণালয়ের যে কল্যাণ ট্রাস্ট আছে, সেখান থেকে দ্রুততম সময়ে একটি দরখাস্ত এনে নাদিমের পরিবারকে সর্বোচ্চ সহায়তা দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী যে কল্যাণ ট্রাস্ট করেছেন, সেখান থেকে তাকে সাহায্য করা যেতে পারে।

নাদিম তিনটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করত। সেগুলো হলো—বাংলানিউজ, ৭১ টিভি ও মানবজমিন। এ তিনটি প্রতিষ্ঠানকে এ দুঃসময়ে তার পরিবারের পাশে দাঁড়াতে অনুরোধ জানাই। তার কী পাওনা আছে, কী বেতন আছে, কী ভাতা আছে সেগুলো আমরা দেখতে চাই না। যে তিনটি প্রতিষ্ঠানে সে কাজ করত, এ দুঃসময়ে তারা পরিবারটির পাশে ভালোভাবে দাঁড়াবে, এটাই কাম্য। পরবর্তী সময়ে আমাদের দায়-দায়িত্ব হচ্ছে, খোঁজখবর নিয়ে দেখা তার স্ত্রী-সন্তানরা কেমন আছে।

নাদিমের পরিবারকে প্রধানমন্ত্রীর ‘সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনী’ থেকে যদি বাড়ি এবং জমি দেওয়ার প্রয়োজন হয়, সেটি দেওয়ার অনুরোধ জানাই। তার তিনটি ছেলেমেয়ে আছে; যাদের ভেতরে দুজন লেখাপড়া করে। তারা যেন পড়াশোনা শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে, সে পর্যায় পর্যন্ত তাদের পাশে দাঁড়ানোর অনুরোধ জানাই।

সাংবাদিক সমাজকে নাদিম হত্যার পাশাপাশি অন্যান্য সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে আন্দোলন করে যেতে হবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বলব, যদি নির্বাচনের আগে বাংলাদেশে সাংবাদিক হত্যার বিচার করার দৃষ্টান্ত স্থাপন করা যায়, তাহলে দেশে এবং বিদেশে সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। যদি কোনো সাংবাদিক আক্রান্ত হয় তার অফিস তার পাশে দাঁড়াবে কি না, সেটি বড় প্রশ্ন। প্রথম কথা হলো, প্রতিষ্ঠানগুলোকে আইন অনুযায়ী বেতন-ভাতা দিতে হবে। জীবন বীমা করা থাকতে হবে। এরপর আমি সরকারের কাছে দাবি জানাব, ঝুঁকি নিয়ে সাংবাদিকতা করার পর যেন এমন দুর্ঘটনা না হয়। কারণ ওই চেয়ারম্যানের মতো প্রভাবশালী মানুষজন ক্ষমতাবান হয় বলেই তারা সাংবাদিক পেটানোর সাহস পায়। কাজেই সরকারকে অনুরোধ করব, যারা সাংবাদিককে নির্যাতন করে, সাংবাদিকদের হত্যা করে তাদের কোনোভাবেই দলীয় সমর্থন না দিতে। প্রভাবশালীর সমর্থন না থাকলে সাংবাদিক পেটানোর সাহস থাকবে না। এ ছাড়া সাংবাদিক পেটালে বিচার হয়, এই নজির স্থাপন করতে পারলে ৭০ থেকে ৮০ ভাগ সাংবাদিক নির্যাতন বন্ধ হয়ে যাবে। সাংবাদিকদের নির্যাতন করলে বা হত্যা করলে কোনো বিচার হয় না—এ ধারণা পরিবর্তন করতে হবে। এ বিষয় প্রতিষ্ঠা করা গেলে বড় ধরনের অপরাধ কমে যাবে এবং আমরা কিছুটা নির্বিঘ্নে সাংবাদিকতা চালিয়ে যেতে পারব।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

এসএমসিতে চাকরির সুযোগ, আজই আবেদন করুন

সিদ্ধিরগঞ্জে বিস্ফোরণে নাতির পর নানির মৃত্যু

ঢাকায় বিজিবি-বিএসএফ সীমান্ত সম্মেলন আজ

আজ ঢাকার আবহাওয়া কেমন থাকবে, জানাল আবহাওয়া অফিস

২৬ আগস্ট : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

ডাকসু নির্বাচনে আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শুরু আজ

তিন সহযোগীসহ ‘মাদক সম্রাট’ শাওন গ্রেপ্তার

ফের সৈকতে ভেসে এলো মৃত ইরাবতী ডলফিন

মঙ্গলবার রাজধানীর যেসব এলাকার মার্কেট বন্ধ

২৬ আগস্ট : আজকের নামাজের সময়সূচি

১০

পাঁচ বাংলাদেশিকে ফেরত দিল বিএসএফ

১১

ক্ষমতায় গেলে এক কোটি কর্মসংস্থান করবে বিএনপি : টুকু

১২

ড. ইউনুস কি ভালো ভোট করতে পারবেন : মান্না

১৩

ষড়যন্ত্রকারীদের সতর্কবার্তা দিলেন আমিনুল হক

১৪

স্ত্রী-সন্তানসহ প্রবাসীর মৃত্যু, চাচাতো চাচা রফিকুল রিমান্ডে 

১৫

জবিতে ক্লাস ও পরীক্ষা মনিটরিং সিস্টেম চালু ১ সেপ্টেম্বর

১৬

স্থপতি মোশতাক আহমেদের বাবার মৃত্যুতে রাজউক চেয়ারম্যানের শোক

১৭

আফ্রিদির বিরুদ্ধে মামলার হুঁশিয়ারি, উকিল খুঁজছেন স্বপন

১৮

মুন্সিগঞ্জে ‘গত আগস্টে লুট করা অস্ত্র’ দিয়ে পুলিশের ওপর হামলা

১৯

গরিবের স্বপ্নেই থাকে ইলিশ

২০
X