আমাদের প্রতিবেশী দুই দেশ। একটি ভারত আরেকটি মিয়ানমার। সীমানার ষোলো আনার মধ্যে পনেরো আনাই ঘিরে রেখেছে ভারত। এক আনা মিয়ানমারের। দেশের সীমানা পার হলেই বিদেশ ভারত। এই ভারত আমাদের মুক্তিযুদ্ধে জীবন দিয়ে, আশ্রয় দিয়ে সহায়তা করেছে। আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছি।
আপদে-বিপদে সবার আগে এগিয়ে আসে প্রতিবেশী। মামা-চাচারা যত ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ই হোক, তারা দূরে থাকলে আর ঘরে আগুন লাগলে প্রতিবেশীই সবার আগে এগিয়ে আসবে। প্রতিবেশী কোন জাতের, কোন ধর্মের, ধনী না গরিব তা দেখবে না। তাই প্রতিবেশীই সবচেয়ে বড় স্বজন।
এত ভূমিকা টানছি, কিছু মানুষের কিছু আচরণ, কিছু কথাবার্তা দেখেশুনে বিস্মিত হচ্ছি। আসন্ন দুর্গাপূজা উপলক্ষে ভারতে বিশেষ করে কলকাতায় বাংলাদেশ থেকে সাড়ে তিন হাজার টন ইলিশ রপ্তানির অনুমতি দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সরকারের আইনকানুন মেনেই রপ্তানি হবে। কিন্তু এ নিয়ে একটি মহল সমালোচনা, বিরোধিতায় নেমেছে। তাদের বক্তব্য দেশে বেশি দামের কারণে ইলিশ খাওয়া যাচ্ছে না, এর মধ্যে আবার রপ্তানি কেন? ভারতের সঙ্গে এত কীসের পিরিত? ইত্যাদি ইত্যাদি।
এ দেশে কিছু মানুষের ভারত বিরোধিতা মজ্জাগত। রক্তের সঙ্গে মেশানো। ভারতের নাম শুনলেই তাদের মগজ জ্বলে যায়। কী কারণ জানি না। অথচ বিপদে এগিয়ে আসছে প্রতিবেশী ভারতই। কয়েকটি উদাহরণ দিলেই খোলাসা হবে।
দেশজুড়ে ডেঙ্গুজ্বরে বিপর্যস্ত মানুষ। ডেঙ্গু চিকিৎসার সাধারণ ওষুধ প্যারাসিটামলের সংকট দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে দেখা দিয়েছে স্যালাইন সংকট। শিরায় দেওয়ার স্যালাইন বাজারে নেই। কয়েকগুণ বেশি দামেও পাওয়া যাচ্ছে না। স্বাভাবিক অবস্থায় যে স্যালাইনের দাম ১০০ টাকা, সেটা বিক্রি হচ্ছে ৫০০ টাকা করে। বাজার নিয়ন্ত্রণ রাখতে সরকার স্যালাইন আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রাথমিকভাবে সাত লাখ ব্যাগ স্যালাইন আমদানি করার কথা জানায় এবং দ্রুততার সঙ্গে আনতে হলে সেটা প্রতিবেশী ভারত থেকে আনতে হবে। এর অংশ হিসেবে ২০ সেপ্টেম্বর বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে ৫৩ হাজার ২৫০ ব্যাগ স্যালাইন দেশে এসেছে। আরও আসার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। শুল্কায়নসহ প্রতি ব্যাগের দাম পড়েছে ৮০ টাকা। এর সঙ্গে পরিবহনসহ অন্যান্য খরচ যুক্ত হবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমদানিকৃত স্যালাইন ১০০ টাকার মধ্যেই বিক্রি হবে।
এই যে জীবন রক্ষাকারী জরুরি ওষুধ দ্রুত আনতে হলো, সেটার জন্য সবার আগে ভারতই এগিয়ে এসেছে। যারা সারাক্ষণ ভারত বিরোধিতা করেন, তারা কি এটা অস্বীকার করবেন? দেশে ডিমের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চার কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দেয় চার প্রতিষ্ঠানকে। পরে আরও ছয় কোটি ডিম আমদানি করার কথা জানানো হয়। সরকার নির্ধারণ করে দিয়েছে একটি ডিম সর্বোচ্চ ১২ টাকা বিক্রি করতে হবে। আমদানিকৃত ডিম সে দামেই বিক্রি হবে। যদিও ডিম কোথা থেকে আমদানি করা হবে সেটা বলা হয়নি। আমদানিকারকরা পৃথিবীর যে কোনো দেশ থেকেই ডিম আমদানি করতে পারেন। কিন্তু তারা আনছেন ভারত থেকেই। কারণ পাশের দেশ ভারতে ডিম যেমন সস্তা, তেমনি আমদানি খরচও কম। দেশের বাজারে যেখানে খুচরা পর্যায়ে এক ডজন ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৬০, সেখানে ভারতে ৩০টি ডিম ১০০ টাকা (ভারতীয় টাকায়)। শুল্ক খরচসহ আমদানিকৃত ডিম সরকার নির্ধারিত দামেই বিক্রি করা হবে বলে জানান আমদানিকারকরা। ভোক্তা যদি কমদামে পণ্য পায়, তাহলে সে বেশি দামে কিনবে কেন? যারা ভারত বিরোধিতা করছেন, তারা কি আমদানিকৃত ডিম কিনবেন না? খাবেন না?
কিছুদিন আগে পেঁয়াজের কেজি ১০০ টাকা পৌঁছল। সরকার পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেওয়ায় ভারত থেকে পেঁয়াজ আসার পরদিন থেকেই দাম কমে গেল। পেঁয়াজ এখন ৭০ টাকা কেজি। মাসকয়েক আগে কাঁচামরিচের কেজি হাজার টাকা হয়ে গেল। ভারত থেকে কাঁচামরিচ আমদানি হওয়ার পরদিন থেকেই দাম কমা শুরু হলো। এখন দেড়শ টাকা কেজি কাঁচামরিচ।
এভাবে যে নিত্যপণ্যই দাম বাড়ে সেটা আমদানির সুযোগ দিলেই দাম কমে যায়। আর প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে আমদানি করলে খরচ কম পড়ে বলে দেশের বাজারে কম দামে বিক্রি করা সম্ভব হয়। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পণ্যের দাম বাড়িয়ে মানুষের টাকা লুটে নেয় একটি চক্র। এটা সরকারসহ সবাই জানে। শক্তিশালী এই সিন্ডিকেট সরকার ভাঙতে পারে না। ফলে সরকারকে আমদানির অনুমতি দিতে হয়। সরকারের আমদানির অনুমতিতে কোথাও বলা হয় না যে ভারত থেকে আমদানি করতে হবে। পৃথিবীর যে কোনো দেশ থেকেই আমদানি করতে পারে। কিন্তু আমদানিকারকরা পাশের দেশ ভারতকেই বেছে নেন। এর প্রধান কারণ পরিবহন খরচ কম, স্থলপথে দ্রুততার সঙ্গে পণ্য নিয়ে আসা যায়। পচনশীল পণ্য হলেও দিনে দিনে সেটা দেশে পৌঁছে যাবে। এটা সম্ভব হয় প্রতিবেশী হওয়ার কারণেই তো!
আসন্ন দুর্গাপূজা উপলক্ষে ৩ হাজার ৯৫০ টন ইলিশ রপ্তানির অনুমতি দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ৭৯টি প্রতিষ্ঠানকে আটটি শর্তে রপ্তানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান ৫০ টন করে ইলিশ রপ্তানি করবে। ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত এ অনুমতি কার্যকর থাকবে। গত ১ সেপ্টেম্বর কলকাতার ফিশ ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন কলকাতায় বাংলাদেশ উপহাইকমিশনের মাধ্যমে ৫ হাজার টন ইলিশের চাহিদার কথা জানায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় অনুমতি দেয়। ভারতে ইলিশ রপ্তানির যারা বিরোধিতা করছেন, তাদের কাছে প্রশ্ন—ইলিশ কি ভারতকে ফ্রি দিচ্ছে, না রপ্তানি করা হচ্ছে?
এটা ব্যবসায়িক বিষয়। ইলিশের চাহিদা বাঙালির কাছে। আমরা যেমন ইলিশ খেতে পছন্দ করি, পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরাও পছন্দ করেন। ভারতের অন্য রাজ্যে বা অবাঙালিরা ইলিশ খায় না। আমাদের আছে বলেই উৎসব উপলক্ষে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের কিছু দেওয়া হচ্ছে। তাও রপ্তানি। বিনে পয়সায় নয়। প্রতিবেশী হিসেবে তারা এটা পেতে পারে না? আমাদের বিপদেও তো ভারত থেকে নিত্যপণ্য নিয়ে আসি। পেঁয়াজ-কাঁচামরিচ থেকে শুরু করে সর্বশেষ স্যালাইনও আনতে হচ্ছে। ভারতও এগুলো ফ্রি দিচ্ছে না। টাকা দিয়েই আমদানি করতে হচ্ছে।
পরস্পরের বিপদে এগিয়ে আসাই প্রতিবেশীর কাজ। করোনা মহামারির টিকা আবিষ্কারের পর ভারতই বাংলাদেশকে সবার আগে টিকা দিয়েছে। আমরা এটা অবশ্যই কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করব।
শুধু শুধু ভারত বিরোধিতা একটা মানসিক রোগ। এটা সৎ প্রতিবেশীসুলভ আচরণ হতে পারে না। যারা এটা করেন তারা হীন রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্যে করেন। পাকিস্তান ভারতকে শত্রু মনে করে। পাকিস্তানের মানুষ ভারতের বিরোধিতা করে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষদের তো এমন হওয়ার কথা নয়। আমার মনে হয়, এ দেশে পাকিস্তানপন্থি যারা রয়ে গেছে, যারা মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি, তাদের বংশধররাই ভারত বিরোধিতা করে থাকে। এর বাইরে আর কিছু মনে হয় না।
লেখক : সাংবাদিক
মন্তব্য করুন