মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি, আগামী দিনে যা ঘটবে তা জানতে চাওয়া। অর্থনীতি কেমন যাবে? শেয়ারবাজার কি আর চাঙ্গা হবে? জিনিসপত্রের দাম কি শুধু বাড়তেই থাকবে? রাজনীতি কোন পথে? নির্বাচন হবে? তত্ত্বাবধায়ক সরকার হবে? আমেরিকা বাংলাদেশকে এত চেপে ধরল কেন? তাদের ভিসা নীতিরইবা প্রভাব কী? স্যাংশন আসছে? এরকম অসংখ্য প্রশ্ন এখন মানুষের মধ্যে।
যারা রাজনীতি করেন, রাজনীতির খোঁজখবর রাখেন বা বিশ্লেষণ করেন, তাদের পেলে মানুষ জিজ্ঞেস করে অনেক কথা। সাংবাদিকরা এসব প্রশ্নের মুখোমুখি হন বেশি এবং নিজের তাড়নায়ও এসব নিয়ে লেখেন। বিভিন্ন সূত্র মারফত প্রাপ্য তথ্য থেকে এক প্রকার ব্যাখ্যা দিয়ে বোঝাতে চান আগামীতে কী কী ঘটতে পারে। রিপোর্টার বা সম্পাদকরা এক প্রকার ধারণাগত লেখা লেখেন বিভিন্ন তথ্য ও মন্তব্যের ভিত্তিতে। এটা অনেকটা অঙ্কের যোগফলের মতো। যদি তথ্য ঠিক থাকে, সূত্র ঠিক হয় তাহলে অনেক সময় এই স্পেকুলেশন বা অনুমান মিলে যায়। সাংবাদিকতার শুরু থেকেই এটা চলে আসছে। কিন্তু ফেক নিউজের দুনিয়ায় এ নিয়ে সংশয়ও কম সৃষ্টি হচ্ছে না। ধারণাগত রিপোর্ট বা মন্তব্য প্রতিবেদন না সত্য, না মিথ্যা। বলা যায় এই সত্য মিথ্যার মধ্যে এক আশ্চর্য সংযোগ স্থাপন যাকে পাঠকরা বিশ্বাসও করে না, আবার উড়িয়েও দেয় না। টেলিভিশন বা বেতারে এর সুযোগ কম। অনলাইনে বেশি বেশি হয়। তবে মুদ্রণ মাধ্যমেও কম হয় না। সমস্যা হলো, এগুলোতে মতামত উঠে আসে, কিন্তু সম্পাদকীয় পাতায় না হয়ে ছাপা হয় প্রথম পাতায়। বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে অনুমানমূলক সাংবাদিকতা অনেক বেশি হয় এবং এগুলো লিখে থাকেন স্বনামখ্যাত রিপোর্টার ও সম্পাদকরা। সামাজিকমাধ্যমের যুগে ভিউয়ার পেতে ক্লিকবেইট শিরোনাম দিয়ে বিশ্লেষণের নামে কত কিছু যে লেখা হয়, তার শেষ নেই। ফলে প্রকৃত তথ্য ও সূত্রনির্ভর অনুমানমূলক সাংবাদিকতার তার জায়গা স্থির করা কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে।
এসব অনুমাননির্ভর রিপোর্ট কি মানুষকে কল্পনায় ভাসায়? অস্থির সময়ে মানুষকে মনোজগৎকে আরও অস্থির করে? সাংবাদিকতা কি তবে ভবিষ্যৎ বলে দেওয়ার পেশাও? যখন সংবাদমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা এক বড় প্রশ্নের মুখে, তখন কি তবে এসব লেখার আর সুযোগ থাকে?
রিপোর্ট মানে হলো সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলা। কিন্তু অনুমাননির্ভর সাংবাদিকতা হয়তো সাদা ও কালোর মধ্যে ধূসরতা খোঁজে। যারা লেখেন তারা বলবেন এ ধূসরতার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে প্রকৃত সত্য কিংবা সত্যের কাছাকাছি কোনো তথ্য।
বিশ্বায়নের পর বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমেও বড় পরিবর্তন এসেছে। বাজার অর্থনীতি শহর আর গ্রামকে এখন আলাদা রাখতে পারছে না। সর্বত্রই শুধু প্রতিযোগিতা। সামাজিকমাধ্যমের কারণে শ্রেণি নির্বিশেষে মানুষ এখন তথ্যের মহাসড়কে। সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে মানুষ বদলে গিয়েছে অনেকটাই। দর্শক, শ্রোতা বা পাঠক এ মিডিয়া বাজারে এখন আর শুধু তথ্য গ্রহণ করে না, নিজেরাও তথ্য ছড়ায়।
দ্য নিউইয়র্ক টাইমস ২০১৮ সালে এ নিয়ে একটি বড় লেখা লিখেছিল। হোয়াট ইজ দ্য ফিউচার অব স্পেকুলেটিভ জার্নালিজম শীর্ষক লেখায় বলেছিল, ফেক নিউজের জমানায় অনুমাননির্ভর প্রতিবেদনকে মানুষ পুরোপুরি গ্রহণ করে না। তবে বাংলাদেশের বাস্তবতা আলাদা। এখানকার বিভাজিত সমাজে মানুষ তার মতাদর্শ অনুযায়ী লেখা গ্রহণ বা বর্জন করে। তারা সত্য খোঁজে কম। সংঘাতময় রাজনৈতিক পরিস্থিতি, অথনৈতিক মন্দাবস্থায় চড়া দ্রব্যমূল্য, মহামারি, দুর্ঘটনা, মারামারির এই দেশে মানুষ এমনিতেই এক প্রকার ট্রমায় থাকে। এ অবস্থায় সাধারণ সংবাদের পাশাপাশি আরও বেশি কিছুর একটা চাহিদা আছে মিডিয়া বাজারে। কিন্তু তার পরিবেশনা কেমন হবে সে নিয়ে গবেষণা নেই সেভাবে।
বাংলাদেশে গণমাধ্যমের আসল নিয়ন্ত্রণ মালিকদের হাতে। বলা হয় মালিকের রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক হাতিয়ার এ মাধ্যমে সাংবাদিকরা কাজ করেন ম্যানেজার বা এজেন্ট হিসেবে। মালিকের ব্যবসায়িক নীতি আর রাজনৈতিক দর্শনে এখন আর কোনো ফারাক নেই। সাংবাদিকরা সেই নীতির প্রয়োগে ব্যস্ত। ব্যতিক্রম আছে এবং সেটা সাংবাদিকদের জন্য এক নিরন্তর লড়াইও বটে।
বাংলাদেশের সাংবাদিকতার গৌরবোজ্জ্বল সময়ের কথা বললেই উঠে আসে অতীত। বিশেষ করে স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী সময়ের কথা বেশি বলা হয়। স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করা মানুষের কথা উঠে আসত কাগজে। বাংলাদেশে নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী গণতন্ত্রের সংগ্রামেও সাংবাদিকরা ছিলেন মানুষের কাতারে। তখন যারা লিখে লিখে বড় সাংবাদিক হিসেবে নাম করেছেন, তাদের অনেকের লেখাই আজকের বিচারে নীতি-নৈতিকতার মানদণ্ডে সমস্যাক্রান্ত।
গণতন্ত্রের যাত্রা শুরুর পর দেখা গেল সমস্যা জটিল হয়েছে। রাজনৈতিক পক্ষ-বিপক্ষ হয়ে সাংবাদিক ইউনিয়ন বিভক্ত হয়েছে, রাজনীতি, রাজনৈতিক ও দখলবাজ ব্যবসায়ী মালিক শ্রেণির আধিপত্য কায়েম হয়েছে। কিন্তু তবুও সাংবাদিকতা হচ্ছে, বহু আইনি প্রতিবন্ধকতায়ও অনিয়ম আর দুর্নীতির কথা সাহস করে লিখছেন এবং বলছেন সাংবাদিকরাই। সংসদের অকার্যকারিতায় আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বিতর্কের মঞ্চও গণমাধ্যমই।
মানুষের কাছে যখন তথ্যের ছড়াছড়ি, মতামতের প্লাবন তখন অনুমাননির্ভর সাংবাদিকতায় ঝুঁকি অনেক। অবস্থাটা অনেকটা শেয়ারবাজারের জুয়ার মতো। সত্য হয়ে যেতে পারে, অনুমান করে লেখা ফলেও যেতে পারে কিংবা সম্পূর্ণ অসফল হতে পারে ভবিষ্যদ্বাণী। মানুষ মিডিয়ার কাছে বর্তমানের বিশ্লেষণভিত্তিক ভবিষ্যতের আলামত চায়। সেটা করা সহজ নয়। খুব গভীরে গিয়ে বিষয় ও ঘটনাকে দেখতে সমর্থ না হলে, সূত্র ঠিক না হলে, তথ্য নির্ভরযোগ্য না হলে ভবিষ্যৎ অনুমান করা সহজ হয় না।
অনুমানমূলক সাংবাদিকতার চ্যালেঞ্জ সেখানেই। বড় কথা হলো, কোনো হাইপোথিসিসের জায়গা নেই। বলতে হবে তথ্যনির্ভর কথা। বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা চর্চার বাইরের সাংবাদিকতা এটি নয়। রাজনৈতিক মতাদর্শের জায়গায় এটি ‘অ্যাডভোকেসি’ সাংবাদিকতাও নয়।
দুর্ঘটনা, দাঙ্গা, মহামারি, বন্যা, যুদ্ধ, মৃত্যুর মতো ভয়ংকর তথ্যে ভরপুর দুনিয়ায় রাজনীতির ভবিষ্যৎ ব্যাখ্যা করা চ্যালেঞ্জিং। অনুমানমূলক সাংবাদিকতা স্বপ্ন জাগায়, কিন্তু সেটি কল্পনাসৃজিত নয়, সাহিত্যও নয়; তা আসলে সম্পূর্ণভাবে তথ্যের কাঁটাতারে বাঁধা ঘটনা। একটু বেশি কল্পনাপ্রবণ হলে, সাংবাদিকতা এবং অন্তর্নিহিত আবেগের ভারসাম্যবোধ নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। আলগা, অগোছালো, গন্তব্যহীন আবেগের চেয়ে যুক্তির বিচারবোধ বেশি প্রয়োজনীয়। সব ঘটনাকে সাংবাদিকের চোখ দিয়েই দেখার চোখ থাকলে অনুমান ঠিক হয় বেশি। সেটা মাথায় রাখলে তথ্যের বাইরে অন্য কিছু দিয়ে সাংবাদিক ভারাক্রান্ত হবেন না। অতিরঞ্জিত বলে মনে হবে না বাস্তবের বর্ণনা। তথ্য সংগ্রহের জন্য সাংবাদিককে রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষা করতে হয়। ঘনিষ্ঠতা অর্জন হলে, রাজনৈতিক নেতা তার মতামত সাংবাদিককে দিয়ে লিখিয়ে বা বলিয়ে নিতে চান। সেটা এক বড় চ্যালেঞ্জ। একটা বয়সের পর সাংবাদিকতা অভিমত প্রত্যাশা করে, তখন রিপোর্টের চেয়ে বেশি করতে হয় স্পেকুলেটিভ জার্নালিজম বা অনুমানমূলক সাংবাদিকতা। তার লক্ষ্য ঔচিত্য-অনৌচিত্যের দৃষ্টিকোণ থেকে পাঠককে শিক্ষিত করা ও সমাজের অন্যায়গুলোর প্রতি কর্তৃপক্ষ ও মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা।
অনুমানমূলক সাংবাদিকতায় নিজস্ব রাজনৈতিক মতামত চলে এলে তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয়। একটা কথা ঠিক যে, রাজনীতি ও সমাজ সম্পর্কে সাংবাদিকের নিজস্ব দৃঢ়মত থাকবেই। কিন্তু সেটা যেন হয় যৌক্তিক জায়গায় রেখে বিষয়কে ন্যায্যভাবে মানুষের কাছে উপস্থাপন করা।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন