জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায় শুধু গাইতেন না, তিনি একই সঙ্গে সুর করতেন, গান লিখতেন এবং কবিতা লিখতেন। শুধু লিখতেন না, মন দিয়ে উপলব্ধি করেই লিখতেন। তার একটি বহুলশ্রুত গানে আছে—‘এ কোন সকাল, রাতের চেয়েও অন্ধকার/ ও কি সূর্য নাকি, স্বপনের চিতা/ ও কি পাখির কূজন, নাকি হাহাকার’। জটিলেশ্বরের সময়টিও ছিল জটিল। তার গানগুলো মূলত লেখা হয়েছে এবং রেকর্ড হয়েছে ষাটের দশক থেকে আশির দশক পর্যন্ত সময়ে। ওই সময়ে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বহু দেশ স্বাধীনতা সংগ্রামে লিপ্ত ছিল, প্রাণ দিতে হয়েছে নিরীহ শিশু নারী ও স্বাধীনতাকামীদের। অথচ তখনো মানুষ সভ্য হয়েছে বলে মনে করেছে। দুঃখের বিষয়, আজও পৃথিবীর নিরীহ মানুষের নিষ্পেষিত হওয়া এতটুকু কমেনি, বরং আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। এক জনপদের চলমান অত্যাচার-নির্যাতনের কথা মানুষ ভুলে যাচ্ছে আরেক জনপদে নতুন করে আগুন জ্বলে ওঠার কারণে। তাই বারবার জটিলেশ্বরের ওই গানের কলিগুলো মস্তিষ্কে প্রবেশ করছে।
১৯৬৭ সালে আরব-ইসরায়েলের মধ্যে যে যুদ্ধ হয়েছিল, সেই যুদ্ধে ইসরায়েলের বিপক্ষে আরব পক্ষে প্রাথমিকভাবে যোগ দিয়েছিল মিশর, সিরিয়া ও জর্ডান। এ যুদ্ধ ইতিহাসে ‘সিক্স ডে ওয়ার’ বা ছয় দিনের যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত। সেই তীব্র যুদ্ধে ইসরায়েলের নিহত হয়েছিল ৯৮৩ জন এবং আরব পক্ষে নিহত হয়েছিল ১৮ হাজারের কাছাকাছি। ওই যুদ্ধে দুপক্ষেরই যারা নিহত হয়েছিল, তাদের অধিকাংশই ছিল যুদ্ধরত। ১৯৭৩ সালের আবার আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে ২ হাজার ৮০০ ইসরায়েলি নিহত হয়, আরবপক্ষে নিহত হয় ১৫ হাজার মানুষ। কিন্তু বর্তমান ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধে এরই মধ্যে নিহত হয়েছে প্রায় ১০ হাজার ফিলিস্তিনি এবং ১ হাজার ৪০০ ইসরায়েলি। ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ ছিল ছয় দিনের এবং ইয়ম কিপ্পুর যুদ্ধ বলে পরিচিত ১৯৭৩ সালের যুদ্ধটি চলেছে ১৯ দিন। পক্ষান্তরে বর্তমান যুদ্ধটি ৭ নভেম্বর এক মাস পূর্ণ হবে এবং এ যুদ্ধ কবে সমাপ্ত হবে তা বলা মুশকিল। ওই যুদ্ধে ফিলিস্তিন একা ছিল না। প্রায় গোটা আরব এবং তিউনিশিয়া, লিবিয়া, সুদান জড়িয়ে পড়েছিল। এমনকি পাকিস্তান এয়ারফোর্সও হামলা চালিয়েছিল ইসরায়েলে। আর আজকের যুদ্ধে জড়িয়ে আছে ফিলিস্তিনের হামাস, লেবাননের হিজবুল্লাহ এবং ছিটেফোঁটা ইয়েমেনের হুতি গোষ্ঠী। তাদের কোনো রাষ্ট্রীয় শক্তি নেই। সরাসরি যোগদান না করলেও রাষ্ট্র হিসেবে তাদের সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে ইরান। অন্যদিকে ইসরায়েলের রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের পূর্ণ সমর্থন। এখন যুদ্ধটি আসলে একতরফা; ইসরায়েল মারছে, গাজার অধিবাসীরা মরছে। হঠাৎ দু-একটি রকেট হামলা প্রতিহত করতে হচ্ছে ইসরায়েলকে। রোববার প্যালেস্টাইন অথরিটি বা পিএর প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি অব স্টেট অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের রামাল্লায় এক ঘণ্টারও কম সময় আলোচনা হয়। এ মিটিংয়ে আব্বাস মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেটকে অনুরোধ করেন অতিসত্বর যুদ্ধবিরতির ব্যবস্থা করতে। ব্লিঙ্কেন সাফ জানিয়ে দেন, তারা মানবাধিকারের প্রশ্নটি দেখবেন, কিন্তু কোনো যুদ্ধবিরতি চান না। উল্লেখ্য, প্যালেস্টাইন কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের গাজার ওপর কোনো কর্তৃত্ব নেই। গাজা ২০০৭ সাল থেকে শাসন করছে হামাস। মাহমুদ আব্বাসের সঙ্গে হামাসের সম্পর্ক মোটেই ভালো নয়। বরং আব্বাসকে হামাস পশ্চিমাদের সহায়ক বলে মনে করে। কিন্তু মানবিক বিপর্যয় গাজায় এতটাই চরমে পৌঁছেছে যে, প্যালেস্টাইন অথরিটি এবং জর্ডান জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে যুদ্ধবিরতির জন্য। এদিকে গাজা সম্পূর্ণরূপে বিদ্যুৎহীন। আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে যে খাদ্য সরবরাহ করা হচ্ছে, তা গাজার সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত উত্তরের এলাকাগুলোতে ঢুকছে না। গাজা সম্পূর্ণরূপে ঘিরে ফেলেছে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী। চলছে গ্রাউন্ড অপারেশন। আরও মর্মান্তিক বিষয় হলো, গাজা সিটি এলাকা থেকে হামাস যোদ্ধারা সাধারণ মানুষকে সরে যেতে দিচ্ছে না। তাদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে চেষ্টা করছে। মিশরের সঙ্গে গাজার সীমান্ত দিয়ে যে বেসামরিক নাগরিকদের পালিয়ে বাঁচার ব্যবস্থা হয়েছিল, তাও শনিবার থেকে বন্ধ করে দিয়েছে ইসরায়েল। এখন শুধু গাজাবাসীর ক্ষুধায়, তৃষ্ণায় অথবা বোমার আঘাতে মৃত্যুর অপেক্ষা ছাড়া আর কিছু করার নেই। এদিকে গাজা যুদ্ধের তীব্রতায়, ছোট ছোট দেবশিশুর রক্তাক্ত দেহ দেখে বিশ্ব ভুলে গেছে আরেক চলমান মর্মান্তিক যুদ্ধের কথা। ইউক্রেনের যে চারটি অঞ্চল রাশিয়া দখল করে নিয়েছে, সেখান থেকে এরই মধ্যে হাজার হাজার মানুষ হয় পশ্চিম ইউক্রেনে অথবা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে শরণার্থী হয়ে আশ্রয় নিয়েছে, নিচ্ছে। সুন্দর সাজানো সংসার ও জীবন ছেড়ে যারা পালিয়েছে, তারা পেছনে ফেলে আসা বহু মানুষের মৃত্যু সংবাদ গ্রহণ করছে। রাশিয়া ইউক্রেনে হামলার মাত্রা বৃদ্ধি করেছে। শুধু সামরিক না, বেসামরিক মানুষও প্রাণ দিচ্ছে। ওদিকে ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ইউক্রেনের যুদ্ধের গুরুত্ব কমে গেছে। গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কংগ্রেসকে অনুরোধ করেছিলেন ইউক্রেন, ইসরায়েল এবং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য ১০৬ বিলিয়ন ডলার ছাড় দিতে। রিপাবলিকান এবং ডেমোক্র্যাট দুপক্ষেরই ইউক্রেন যুদ্ধে নিরাপত্তাজনিত ব্যয়ের ব্যাপারে সায় আছে। কিন্তু সেদিক থেকে নজর এখন ইসরায়েলের দিকে ঘুরে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের জনগণেরও মতের পরিবর্তন ঘটছে দ্রুত। গত সপ্তাহে গ্যালুপের একটি জরিপ প্রকাশ হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, ৪১ শতাংশ আমেরিকান বলছে, যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের বিষয়ে অতিরিক্ত ব্যয় করছে। এই মত গত জুন মাসে ইসরায়েল যুদ্ধের আগে ছিল ২৯ শতাংশ মানুষের। একই সময়ে যারা মনে করত যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের জন্য পর্যাপ্ত করছে না, তাদের সংখ্যা ২৮ থেকে ২৫ শতাংশে নেমে এসেছে। অর্থাৎ শুধু বিশ্ববাসীর নয়, রাশিয়ার সঙ্গে প্রক্সি ওয়ারের সবচেয়ে বড় শক্তি যুক্তরাষ্ট্রের নজরও ইউক্রেন থেকে সরে গেছে। এবার আসি আরেকটি খবরে। এ সংবাদ খুব একটা শিরোনামে স্থান পায়নি। সম্প্রতি পাকিস্তান সরকার সে দেশে থাকা আফগান শরণার্থীদের জোরপূর্বক আফগানিস্তানে ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশন ইউএনএইচসিআরের হিসাব অনুযায়ী, পাকিস্তানে প্রায় ৪০ লাখ আফগান রিফিউজির বসবাস। এর মধ্যে ৭০ হাজার রিফিউজি পাকিস্তানে প্রবেশ করেছিল তালেবানদের হাত থেকে রক্ষা পেতে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র সৈন্য প্রত্যাহারের পর। অন্যদিকে ১৭ লাখ মানুষ প্রবেশ করেছিল বিভিন্ন সময়ে জীবন বাঁচাতে। পাকিস্তান সরকার বলেছে, শুধু প্রুফ অব রেজিস্ট্রেশন আছে, তারাই পাকিস্তানে অবস্থান করতে পারবে। কিন্তু মুশকিল হলো, এই প্রুফ অব রেজিস্ট্রেশন পাওয়া আর হাতে চাঁদ পাওয়া সমান কথা। অতি অল্পসংখ্যক মানুষের এই রেজিস্ট্রেশন রয়েছে। পাকিস্তানের পুলিশ আফগানদের গ্রেপ্তার করছে এবং জোরপূর্বক আফগানিস্তানে পাঠিয়ে দিচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে থানায় নিয়ে মারধর এবং প্রুফ অব রেজিস্ট্রেশন কার্ড জব্দ করা হচ্ছে। ২০১৬ সালে একবার এই রেজিস্ট্রেশন থাকা হাজার হাজার আফগানকে নির্যাতন ও হয়রানি করা হয়, ফেরত পাঠানো হয়। কিন্তু এবার তা আরও বড় আকারে ঘটছে। বেশ কয়েকটি কারণে পাকিস্তান তালেবানদের দেশ থেকে তাড়াতে চাচ্ছে। প্রথমত, পাকিস্তানের অর্থনীতি একেবারে ভেঙে পড়েছে। পাকিস্তানে এখন আইএমএফের হিসাব অনুযায়ী বেকারত্বের হার ৮ শতাংশ। দ্রব্যমূল্য আক্ষরিক অর্থেই সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। দ্বিতীয়ত, পাকিস্তানের সঙ্গে আফগান তালেবানদের সম্পর্ক এখন চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। দুই দেশের সীমান্তে প্রায়ই সংঘর্ষ এবং হতাহতের ঘটনা ঘটছে। পাকিস্তান সব মানবতার বিবেচনা ত্যাগ করে এখন জাতীয় স্বার্থকে বড় করে দেখতে চাইছে। ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনের হিসাব অনুযায়ী, দারিদ্র্য, পুষ্টিহীনতা এবং সহিংসতার কারণে পাকিস্তানে বসবাসরত আফগানদের মৃত্যুর ঝুঁকি ২৫ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে ছোট একটি বিবৃতি দিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে মাত্র। কে আর খোঁজ রাখে! ঢাকা পড়েছে সুদান-সংকট। সুদানে নিয়মিত সেনাবাহিনী এবং র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সের মধ্যে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত ৯ হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। যেখানে শুধু যুদ্ধই নয়, ৫০ লাখ মানুষ নিজ ভূমি থেকে বিতাড়িত হয়ে অন্যত্র খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিয়েছে। এমন আরও ছোট-বড় সংকট পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে আছে। বড় দেশগুলো যার যার সুবিধা অনুযায়ী হস্তক্ষেপ করছে অথবা নীরব থাকছে। পৃথিবী বিংশ শতাব্দী থেকে বের হয়ে একবিংশ শতাব্দীতে এসে অনেক গতিময় হয়েছে। প্রযুক্তি বিস্ময়কর অবস্থানে চলে গেছে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স অনেক বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিকেও হার মানাচ্ছে। দেশে দেশে ডিজিটাল মুদ্রা চালু হচ্ছে। মানুষের হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থা প্রায় সম্পন্ন। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, মানুষ সংঘাত-সংঘর্ষ, নির্মমতা-স্বার্থপরতা তার হৃৎপিণ্ড থেকে এতটুকু সরাতে পারেনি! বরং ক্ষেত্রবিশেষ তার ভেতরের পশুত্বকে প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক করে ফেলেছে। তাই বারবার জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের সেই গানের কলিই মনে আসছে, ‘এ কোন সকাল রাতের চেয়েও অন্ধকার’।
লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক