সম্প্রতি দেশের পাঁচটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ নির্বাচনগুলো বাংলাদেশের আগামী দিনের রাজনৈতিক বাস্তবতায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসের সংসদের দ্বাদশ নির্বাচনকে সামনে রেখে এ নির্বাচনগুলো সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের জন্য একটি বড় পরীক্ষা ছিল। বাংলাদেশের বিভিন্ন বন্ধুরাষ্ট্র, যারা আগামী সংসদ নির্বাচনকে সুষ্ঠু এবং অংশগ্রহণমূলক দেখতে চায়, তারা এই নির্বাচনগুলোকে খুব গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করেছিল। কারণ বিরোধী দলের পক্ষ থেকে বর্তমান সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় মর্মে যে বক্তব্য প্রদান করা হচ্ছে, সেই বক্তব্য সঠিক কি না তা যাচাইয়ের একটি পরীক্ষা ছিল এই নির্বাচনগুলো।
গাজীপুর সিটি করপোরেশন থেকে শুরু করে পরবর্তী সময়ে বরিশাল ও খুলনা এবং সর্বশেষ রাজশাহী ও সিলেটে নির্বাচনের পরিস্থিতি বিবেচনা করলে এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, প্রতিটি সিটি করপোরেশনে নির্বাচন অত্যন্ত সুষ্ঠু এবং প্রতিযোগিতামূলক হয়েছে। আমার বক্তব্যের সঙ্গে হয়তো অনেকেই দ্বিমত পোষণ করবেন। কারণ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) পক্ষ থেকে এই নির্বাচনগুলো বয়কট করা হয়েছিল। তাদের বাদ দিয়ে নির্বাচন কতটা প্রতিযোগিতামূলক হয়েছে? এটি যেমন একটি বাস্তবতা, ঠিক তেমনিভাবে দিনের পর দিন অযৌক্তিকভাবে কোনো রাজনৈতিক দল যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে, তাহলে তার দায়িত্ব তাদেরই নিতে হবে। ফলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব শুধু নির্বাচন কমিশন এবং সরকারের ওপর চাপিয়ে দিয়ে দায়মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়। এ কথা ঠিক যে, পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির কোনো মেয়র প্রার্থী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেননি। কিন্তু প্রতিটি নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে বিপুলসংখ্যক বিএনপিদলীয় নেতা-সমর্থক নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন। যদিও দলের তরফ থেকে তাদের বহিষ্কার করা হয়েছে। তারপরও তারা মাঠে ছিলেন এবং অনেক ক্ষেত্রে তাদের অনেকে বিজয়ী হয়েছেন। এ থেকে বোঝা যায় যে, বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নির্বাচন বয়কটের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেও স্থানীয় পর্যায়ে বিএনপি নেতাকর্মীরা নির্বাচনের ব্যাপারে যথেষ্ট আগ্রহী ছিলেন। আমরা যদি প্রতিটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দিকে তাকাই, তাহলে দেখব যে প্রতিটি সিটি করপোরেশনে বিএনপির বহিষ্কৃত প্রার্থীদের মধ্যে অনেকেই কাউন্সিলর পদে বিজয়ী হয়েছেন। এর থেকে বোঝা যায় যে, সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলো ব্যাপক উৎসাহ এবং উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি হলো—প্রতিটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রায় ৫০ শতাংশের অধিক ভোট পড়েছে। যেখানে বিরোধী দলের পক্ষ থেকে প্রার্থী না দিয়ে নির্বাচন বয়কটের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে, সেই অবস্থার প্রেক্ষাপটে ৫০ শতাংশের ওপরে মানুষ ভোটাধিকার প্রয়োগ করার মাধ্যমে যে বার্তাটি প্রদান করতে চেয়েছে, সেটি হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষ ফের নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর আস্থা রাখতে শুরু করেছে। নির্বাচন কমিশনের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতেই মানুষ ফের ভোটকেন্দ্রে এসে নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করা শুরু করেছে যেটি বাংলাদেশের ভবিষ্যতের রাজনীতির জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক একটি বার্তা। এখন যে প্রশ্নটি গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হচ্ছে সেটি হলো বাংলাদেশের আগামী দিনের রাজনীতিতে এই পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের গুরুত্ব কতটুকু? এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, এই নির্বাচনগুলোর গুরুত্ব খুবই অপরিসীম। বিশেষ করে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক রয়েছে এমন রাষ্ট্রগুলো যারা বাংলাদেশের রাজনীতিতে আগামী দিনের নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন ধরনের মতামত প্রদান করেছে, তাদের কাছে এই নির্বাচন একটি শক্ত বার্তা প্রদান করেছে। যারা আগামী দিনে বাংলাদেশে সুষ্ঠু এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চান, তারা নিশ্চয়ই এ ধরনের নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি তাদের সমর্থন প্রদান করবেন। যেহেতু নির্বাচন কমিশন সার্বিকভাবে নির্বাচনকে সফল এবং সুষ্ঠু করতে সক্ষম হয়েছে, ফলে তারা নিজেদের কার্যক্রমে গর্ববোধ করতেই পারে। তা ছাড়া একই সঙ্গে এই নির্বাচন আরেকটি বার্তা প্রদান করেছে, তা হলো বর্তমান সরকারের অধীন সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব। স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোর প্রতি জনগণের প্রচুর উৎসাহ এবং উদ্দীপনা লক্ষ করা গেছে। যেহেতু স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়ে জনপ্রতিনিধিদের নির্বাচন করা হয়, জনগণ এ ধরনের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার মাধ্যমে নির্বাচনকে একটি উৎসবমুখর পরিবেশে রূপ দেয়। ফলে একটি রাজনৈতিক দল বছরের পর বছর নির্বাচন বয়কট করে যদি আন্দোলন করতে থাকে, তাহলে স্থানীয় পর্যায়ে তাদের নেতাকর্মীদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা তৈরি হতে পারে। এ ধরনের হতাশা দলকে যেমন সাংগঠনিকভাবে দুর্বল করে তুলতে পারে, ঠিক তেমনিভাবে আগামী দিনে দলের যে কোনো রাজনৈতিক সংগ্রামে দলকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যেম বিরোধী দল স্থানীয় পর্যায়ে তাদের শক্তি পরীক্ষা করার একটি সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু সেই সুযোগটি তারা হাত ছাড়া করেছে। পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে যদি তাদের প্রার্থী বিজয়ী হতে পারত, তাহলে সিটি করপোরেশনগুলোতে আগামী দিনে সরকারবিরোধী আন্দোলন পরিচালনা করা তাদের পক্ষে সহজ হতো। তবে এ কথা ঠিক যে, দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকার কারণে জনগণের মধ্যে বিরোধী দল সম্পর্কে এক ধরনের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়েছে। ফলে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেই যে তাদের প্রার্থী বিজয়ী হতো, বিষয়টি সে রকম নয়। তবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে নিজেদের অবস্থান যাচাই করার একটি সুযোগ থেকে তারা বঞ্চিত হয়েছে। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন দল এবং উপদল থাকলেও কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তকে মেনে যেভাবে পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলের নেতাকর্মীরা ভোটে অংশগ্রহণ করেছে, সেটি আওয়ামী লীগের জন্য একটি ইতিবাচক দিক। যেহেতু ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, আওয়ামী লীগের এই ধরনের সাংগঠনিক শক্তি আওয়ামী লীগকে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে সাহায্য করবে—এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। স্থানীয় পর্যায়ে অনেক ক্ষেত্রেই দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হতে দেখা গিয়েছিল। মনোনয়ন পাওয়া না পাওয়ার বেদনা অনেক নেতাকে নেতিবাচক ভূমিকা পালন করতে সহায়তা করেছে। রাজশাহী এবং বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের দ্বন্দ্বের বিষয়টি পত্রিকার মাধ্যমে আমরা জেনেছি। কিন্তু উভয় সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নির্দেশনায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ যেভাবে নিজেদের সুসংগঠিত করার মাধ্যমে বিজয় ছিনিয়ে নিয়েছে, তা প্রশংসার দাবি রাখে।
পরিশেষে সাম্প্রতিক সময়ে অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়া পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে—এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। ভোটারদের ভোট প্রক্রিয়ার প্রতি আস্থা নির্বাচন ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করবে। আমরা অনেকেই ভোটার অনুপস্থিতি নিয়ে বিভিন্ন ধরনের কথা বলেছি। ভোটারদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচন কখনোই অর্থবহ হয় না। ফলে এই নির্বাচনগুলোতে জনগণ যেভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছে, সেটি আগামী দিনের জন্য ইতিবাচক বার্তা। একই সঙ্গে নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে তাদের সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে। গত পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কোথাও তেমন কোনো বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেনি। কোথাও কারও বিরুদ্ধে ভোট চুরির অভিযোগে ভোট বন্ধ হয়নি। জনগণ উৎসবমুখর পরিবেশে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছে। এ বিষয়টি রাজনীতিতে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে বলে আমি বিশ্বাস করি। এই পাঁচটি নির্বাচনের অভিজ্ঞতা নির্বাচনবিষয়ক সব অনুঘটকের মধ্যে নির্বাচন কমিশন এবং সরকারের প্রতি আস্থা বৃদ্ধি করতে সহায়তা করবে। একই সঙ্গে নির্বাচন বয়কটের মাধ্যমে নিজেদের রাজনীতির দেউলিয়াত্ব প্রকাশ না করে সব রাজনৈতিক দলের উচিত উন্মুক্ত মানসিকতা নিয়ে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করা এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সুসংগত করার জন্য একসঙ্গে কাজ করা। একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে প্রাতিষ্ঠানিক আকার প্রদান করার দায়িত্ব শুধু সরকারের নয়। সরকারের যেমন দায়িত্ব আছে, ঠিক তেমনিভাবে বিরোধী দলের একই রকম দায়িত্ব আছে। অতএব সরকার এবং বিরোধী দল একসঙ্গে মিলে যদি কাজ করে এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে তাহলে গণতন্ত্র সুসংহত হবে।
লেখক: অধ্যাপক, লোক প্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন