শৃঙ্খল ছাড়া সর্বহারার হারানোর কিছু নেই বলে যে নেতা বহু মানুষের যৌবন ভূলুণ্ঠিত করেছিলেন, তিনি তখনো সর্বহারা ছিলেন না, এখনো নেই। বরং এখন শাসক দলের সঙ্গে জোট করে বিকট ধনী। রাজনীতি যে ধনী হওয়ার উপায়, সেটা কমবেশি আমরা সবাই জানি, কিন্তু রাজনীতি করলে যে আলাদিনের চেরাগও ফেল মারে, এখন সেটা সবাই বুঝতে পারছে।
পাড়ার লোকটা, কতটা সাদামাটা ছিল তার জীবন! বাড়ি বলতে কিছু নেই, থাকলেও খুব মলিন। কিন্তু হঠাৎ একদিন দেখা গেল বাড়িটা প্রাসাদের মতো হয়ে গেল, লোকটি কেমন রাজা-বাদশাহর মতো চলাচল করে। অবশ্য এসব দেখার আগেই পাড়ার লোক জেনে গেছে লোকটা শাসক দলের সঙ্গে ওঠাবসা করছে, নেতার পেছনে হাত কচলাচ্ছে। একদিন তার মোটরসাইকেল হলো, তারপর গাড়ি হলো এবং এখন অতি দামি গাড়ি হলো। তারপর একদিন সে জনপ্রতিনিধি হলো এবং তার সম্পদ এখন উপচে পড়ছে।
আগামী ৭ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যারা লড়ছেন, তাদের সম্পদের হলফনামা জমা দিতে হচ্ছে নির্বাচন কমিশনে। পাড়া থেকে মহল্লা, মহল্লা থেকে উপজেলা, জেলা, বিভাগ এবং সেখান থেকে জাতীয় রাজনীতিতে পা রাখার একমাত্র সক্ষমতা অর্থ ও সম্পদ। কিন্তু এমপি হয়েই সম্পদের পাহাড় সৃষ্টি হওয়ার খবরগুলো যখন আসতে শুরু করেছে, তখন দেশের মানুষকে বুঝে নিতে হয়, এই লোকগুলোর পারিবারিক সম্পদ বা ব্যবসা কিছু না থাকলেও এখন তাদের আছে শুধু টাকা আর টাকা, জমি আর জমি এবং মানুষকে এটাও বলে দেওয়া হবে যে, সবই বৈধ টাকায় তৈরি।
যেমন ধরেন, নারায়ণগঞ্জ-২ আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম ওরফে বাবু ও তার স্ত্রীর সহায়-সম্পত্তি বহুগুণ বেড়েছে। ১৫ বছরের ব্যবধানে নজরুল ইসলামের অকৃষি জমি বেড়ে ৪২ গুণ হয়েছে। আর তার স্ত্রী শূন্য থেকে ৩৫৫ শতাংশ অকৃষি জমির মালিক হয়েছেন। এ খবরটি দিয়েছে প্রথম আলো। আবার কালের কণ্ঠ বলছে, নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন ভোলা-৩ আসনের সংসদ সদস্য হওয়ার পর প্রচুর অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন। সংসদ সদস্য হওয়ার আগে বার্ষিক ১০ লাখ টাকা আয় করা শাওনের এখন বার্ষিক আয় ১০ কোটি টাকার ওপর। রাজধানী ঢাকায় কিনেছেন একাধিক ফ্ল্যাট, অন্তত ১০ খণ্ড জমি। নিজের নির্বাচনী এলাকায় কিনেছেন পুকুর, বাগান, ভিটাসহ অন্তত ৭২৯ শতাংশ জমি।
কালবেলা প্রায় প্রতিদিনই এরকম খবর ছাপছে। একজন এমপি প্রার্থীর কথা বলা হয়েছে যে, ব্যাংকে তার টাকার পরিমাণ হাজারগুণ বেড়েছে। জমি, টাকা, সোনার পাহাড় একেকজন এমপি। অনেক এমপির চেয়ে তাদের স্ত্রীরা ধনী বেশি। অথচ তাদের সুনির্দিষ্ট কোনো আয়ের উৎস নেই। বলতে গেলে সবই অলৌকিক।
এগুলো দেখলেও আনন্দ লাগে। আমরা বুঝতে পারি দেশ কত এগিয়ে গেছে আসলে। খবরে বলা হচ্ছে, অনেক এমপি প্রার্থীর আয়ের বড় উৎস কৃষি খাত। অথচ এ দেশের কৃষক কত দরিদ্র এখনো। ভালো সাহিত্যিকরা এই হলফনামা ধরে ধরে চমৎকার সব ধারাবাহিক গল্প লিখতে পারেন চাইলে।
এমপি হতেই হবে। শাসক দলের হলে সবচেয়ে বেশি লাভ। তাই দেখা গেল দলীয় মনোনয়ন যত দেওয়া হলো, স্বতন্ত্র তার চারগুণ বেশি। এমপি হওয়ার জন্য মরিয়া একটা অবস্থা। ছোট, বড়, মাঝারি নেতা থেকে আমলা, ব্যবসায়ী, শিক্ষক, চিকিৎসক, অভিনেতা, খেলোয়াড়রা, সাংবাদিকও শামিল হয়েছেন শাসকদলীয় মনোনয়ন জেতার দৌড়ে। সবাই অবশ্য পাননি। যারা পেয়েছেন তারা চেরাগ পেয়ে গেছেন, এমনটাই আলোচনা সর্বত্র।
অতীতের কোনো নির্বাচনেই এত মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন না। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ এরই মধ্যে প্রাথমিকভাবে তার আসনগুলোর বিন্যাস করেছে। তবে জোটের হিসাব এখনো চূড়ান্ত হয়নি। সমঝোতা হয়নি জাতীয় পার্টি, নতুন দল আর জোটের সঙ্গে, হয়নি কিছু বিশেষ ব্যক্তির সঙ্গেও। বিগত কয়েকটি নির্বাচন আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে, এখন কে কত বছর ধরে রাজনীতি করে কত সম্পদের মালিক হয়েছেন।
নব্বইয়ের দশকেও ভালো ছাত্ররা রাজনীতি করতে পারে, তার সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে—এমন একটা ধারণা ছিল। কিন্তু ওটাই জীবিকা, এমনটা কেউ ভাবেনি। দেশে এখন এটিই সেরা পেশার একটি। আরেকটি হলো বিসিএস দিয়ে সরকারি চাকরি। দুটিতেই শুধু টাকা আর টাকা, ক্ষমতা আর ক্ষমতা। একটা সময় ছিল যখন ছাত্রসমাজ এ সমাজকে পাল্টানোর স্বপ্ন দেখত, তাই হয়তো রাজনীতি করত। কতটা পেরেছিল জানি না, হয়তো কিছুই পারেনি, তারপর হতোদ্যম হয়ে দেশ ছেড়েছে কেউ, কেউবা ব্যবসা করেছে, চাকরি করেছে এবং অনেকেই হয়তো কিছুই হতে পারেনি। তারা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি যে, রাজনীতিই ভালো জীবিকা।
বিত্তশালী হতে চাইলে, সমাজের সর্বনাশ করে নির্লজ্জভাবে অর্থ উপার্জন করতে চাইলে রাজনীতির মাধ্যমেই সেটা করা সম্ভব। জনপ্রতিনিধি হতে পারলেই অর্থ উপার্জনের অগাধ সুযোগ। এমনকি সংসদে গেলেই শুল্কমুক্ত গাড়ি, আমদানি করে চড়া দামে সেটা বেঁচে দিয়ে বড় দাও মারার সুযোগ। এই কমিটি, সেই কমিটিতে থাকলে টাকা, সরকারি প্লটসহ তদবির-বাণিজ্য, লাইসেন্স রাজ। সেইসঙ্গে থাকবে রাজনৈতিক ক্ষমতা, মাতব্বরির অগাধ লাইসেন্স। একবার হতে পারলেই অতীতের, সব কুকর্ম ধুয়েমুছে সাফ। আর কুকর্ম করলেই-বা মনে রাখছে কে? এমনিতেই মানুষের স্মৃতিশক্তি স্বল্পকালীন। আর হাতে কিছু ধরিয়ে দিলেই তারা খুশি। এ-হেন রাজনীতিতে আসা নিশ্চয়ই জীবনে লক্ষ্য হওয়া স্বাভাবিক।
আমরা প্রায়ই বলি ভালো ও শিক্ষিত মানুষের রাজনীতিতে আসা উচিত। তাতে রাজনৈতিক জগতের গুণগত উন্নতিসাধন হবে আর রাজনৈতিক দলগুলো দেশের স্বার্থে যথাযথ ও ঠিক পদক্ষেপ করতে পারবে। সমস্যা হলো, রাজনীতির উন্নতিসাধন তো দূরস্থান, বর্তমান রাজনীতির দুরবস্থা এমন যে, একজনের চারিত্রিক ও নৈতিক মান ধরে রাখাই কঠিন। অর্থাৎ সিস্টেমটাই এমন যে, এর ভেতর একবার যে ঢুকবে সিস্টেম তাকে বদলে ফেলবে, সিস্টেমের বদল সে করতে পারবে না। অসহায় সৎ মানুষ এটি বোঝে বলেই তারা রাজনীতিতে আসে না। কারণ সে জানে সিস্টেম তাকে গিলে খেয়ে ফেলবে।
কিন্তু যাদের সেই ভয় নেই তারা ছুটছে এই রাজনীতিতে। আরেকটা কারণ এই যে, যারা একটু যৌক্তিক ভাবনা ভাবতে চান, বলতে চান তাদের জন্য রাজনীতি নয়। রাজনীতিতে সক্রিয় যারা তাদের স্বাধীন ভাবনাচিন্তার ক্ষমতা নেই। দলীয় লাইন ছাড়াও নেতা-নেত্রীরা যা বলেন, সেটাই জপ করতে হয়; সেটাতে যৌক্তিকতা থাকুক বা না থাকুক। স্বাধীন চিন্তার ঝুঁকি বেশি। স্বাধীন চিন্তা করতে গেলেই দল থেকে পত্রপাঠ বিদায়।
রাজনীতি করলেই আয়। মন্ত্রী, এমপি বা কোনো একটি ছোটখাটো জনপ্রতিনিধি হতে পারলে তো কথাই নেই, রাতারাতি একেবারে চূড়ান্ত ধনী। দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করার ব্রত নিয়ে এখন আর কেউ রাজনীতিতে আসে না। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের পর আমরা ভেবেছিলাম এক নতুন বাংলাদেশ দেখব যেখানে রাজনীতিবিদরা জাতিকে গঠনমূলক রাজনীতি উপহার দেবেন। তা আর হয়নি।
যে ছাত্রনেতারা মানুষের ভালোবাসা পেয়েছিলেন তারা রাতারাতি চাঁদাবাজিতে নেমে পড়লেন। ১৯৯১-এর নির্বাচনের পর গণতান্ত্রিক আমলে তা আরও পল্লবিত হলো। এখন তো সেটা একদম প্রাতিষ্ঠানিক। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা, পরিবারকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য মোক্ষম জায়গা রাজনীতি। আর তা করতে গিয়ে নানা ধরনের ভ্রষ্টাচারে লিপ্ত হয়ে পড়লেন রাজনীতিকরা। যত দিন যাচ্ছে, লুণ্ঠনের মানসিকতা তত বাড়ছে। দেশের জন্য সর্বস্ব ত্যাগের রাজনীতি আজ ব্যক্তিস্বার্থে সীমিত। সমাজের সর্বস্তরে অনাচার, ভ্রষ্টাচারের দরুন বাংলাদেশের সত্যিকারের উন্নয়ন আজ মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রাজনীতিতে এক সময় যে শালীনতা ছিল, আজ তাও অনেকটাই নেই। সেজন্য বর্তমান রাজনীতির কথা বললেই ভ্রষ্টাচারের গন্ধ পাওয়া যায়। এ রাজনীতি দেশের সার্বিক রাজনৈতিক সংস্কৃতিরই আয়নাস্বরূপ। শুধু রাজনৈতিক সংস্কৃতি কেন, সামাজিক সংস্কৃতিকেও তা প্রতিফলিত করে। তাই আমরা আজ যা দেখছি তা হয়তো কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। একটি নিম্ন রাজনৈতিক ও কূপমণ্ডূক সমাজের প্রতিচ্ছবি মাত্র।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন