সপ্তাহের শেষ কর্মদিবসে শীতের ঝাঁকুনির সন্ধ্যায় ক্ষমতার উষ্ণতা। টানা চতুর্থ এবং মোট পঞ্চমবারের ক্ষমতার অভিষেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। তার বৃহস্পতি তুঙ্গের ঠিক ওই সময়টাতেই টানা পাঁচ মাস পর হাসপাতাল থেকে গুলশানের বাসায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। আর ৭৪ দিন পর পল্টনে দলীয় প্রধান কার্যালয়ের তালা ভেঙে ভেতরে ঢোকার বীরত্ব কয়েক নেতাকর্মীর। এই তিন ঘটনার একটির আরেকটির সঙ্গে সম্পর্ক না থাকলেও ঘটমান বর্তমান। দিনটির সেরা ঘটনা ও শিরোনাম।
স্থানিকে তেমন বাধা না থাকলেও বৈশ্বিকে যন্ত্রণাদায়ক সময়ে সরকারের নতুন এ অভিষেক। বাংলাদেশের নয়া সরকার নিয়ে পূর্ব-পশ্চিমে দুইতরফা নড়াচড়া প্রকাশ্যে। গুণমান-প্রকৃতি-বৈশিষ্ট্য-ধরন বা মডেল ইত্যাদি মিলিয়ে বাংলাদেশের এবারের নির্বাচনটি একবারেই আলাদা। দেশের ইতিহাসের গত ১১টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের একটির সঙ্গেও এবারেরটির তুলনা চলে না। বিশ্বব্যাপী কূটনীতি পাল্টে গেছে। দেশে দেশে রাজনীতিও বদলে গেছে। গণতন্ত্রের ধাঁচও একেক দেশে এককরকম। যে যার মতো গণতন্ত্র বানিয়ে নিয়েছে। তার ওপর স্নায়ুযুদ্ধ গোটা দুনিয়ার কূটনীতি-রাজনীতির খোলনলচে বদলে দিয়েছে। বাংলাদেশে স্থানীয় রাজনীতিতে শেখ হাসিনা প্রতিপক্ষকে কাবু করে নিজেকে এমন উচ্চমাত্রায় নিয়ে গেছেন, যেখানে শুধু সরকার নয়, তাকে বিরোধী দলও ঠিক করে দিতে হয়। রাজনৈতিকভাবে এ নিয়ে নানা বিশ্লেষণ। এটিকে তার সক্ষমতা খাস বাংলায় হেডম হিসেবে দেখার মানুষ আছেন। আবার কর্তৃত্ববাদ-স্বৈরাচার হিসেবে মূল্যায়নও আছে। তিনি বাংলাদেশে উত্তর কোরিয়া, রাশিয়া, চীনের আদলে একক কর্তৃত্বের নির্বাচন ও শাসন কায়েম হয়ে যাচ্ছেন বলে সমালোচনা তো আছেই। এর মধ্যেই তিনি সামনে ধাবমান। পেছনে বা দেশ-বিদেশে কে কী বলল তা কেয়ার করার সময় নেই। বিশ্বশক্তিগুলোর মন-মর্জিও সেই সমান্তরালে। কোনো রাখঢাক নেই।
শপথ নেওয়ার আগেই শেখ হাসিনার সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার বার্তা দিয়েছে চীন ও রাশিয়া। অন্যদিকে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে আগের অবস্থানে অটল রয়েছে বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। শেখ হাসিনাকে পাঠানো অভিনন্দন বার্তায় চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বলেছেন, আগামীতে সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় হবে। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের উচ্ছ্বাস আরও চড়া। অন্যদিকে হোয়াইট হাউস থেকে বলা হয়েছে, তাদের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের নীতির কোনো নড়চড় হয়নি। নির্বাচনের আগে থেকেই বাংলাদেশ নিয়ে আন্তর্জাতিক দুটি ধারার প্রকাশ্য তৎপরতা। ক্ষেত্রবিশেষে যা অপতৎপরতা। নির্বাচনের পর দুই ধারার ধারাপাত আরও বেগবান। ভারত, চীন, রাশিয়াসহ কয়েক দেশ নির্বাচনের বেসরকারি ফলাফলের পর পরই শেখ হাসিনার টানা চতুর্থবারের বিজয়ে উল্লসিত। এসব দেশের ঢাকায় কূটনীতিকরা শুধু সমর্থন-বিবৃতি নয়, গণভবনে সশরীরে ছুটে যেতেও দেরি করেননি। ৮ জানুয়ারি বেসরকারি ফল প্রকাশের পরই রাশিয়া, চীন, ভারত, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুরসহ বেশ কিছু দেশের রাষ্ট্রদূত শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। জাপান, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, আর্জেন্টিনা, ইন্দোনেশিয়া, রিপাবলিক অব কোরিয়া, ব্রুনাই দারুসসালাম, মালয়েশিয়া, মিশর, আলজেরিয়া, কুয়েত, লিবিয়া, ইরান, ইরাক, ওমান, কাতার, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূতরাও বাদ যাননি।
ভোট গ্রহণের আগ থেকেই বাংলাদেশের নির্বাচন প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হয়েছে বলে মন্তব্য পাওয়া গেছে রাশিয়ার পর্যবেক্ষকের কাছ থেকে। দেশটির কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনার আন্দ্রে ওয়াই শুটব বলেছেন, বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য উপায়ে সম্পন্ন হয়েছে। নির্বাচনের আয়োজনও চমৎকার ছিল। এই ঘোর সমর্থনের বিপরীতে অবস্থান জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের। তারা মনে করে, বাংলাদেশের নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন মর্মাহত হয়েছে এ নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দলগুলো অংশ না নেওয়ায়। নির্বাচনকালীন সহিংসতায় উদ্বেগ জানিয়েছে জাতিসংঘ। আওয়ামী লীগের পক্ষে-বিপক্ষে বিদেশি শক্তিগুলোর এসব ক্রিয়াকর্ম বাংলাদেশকে বিশ্ব কূটনীতির একটা হটস্পট বানিয়ে ফেলেছে। এই হটস্পটের হটচেয়ারে এরই মধ্যে পঞ্চম মেয়াদের হানিমুনে সরকার। দৃশ্যত বা বাহ্যত সরকার ফুরফুরে—নির্ভার হলেও ঝুটঝামেলা পাকছেই। রোজা বা ঈদের পর যুক্তরাষ্ট্র কিছু একটা না করে ছাড়বেই বলে আশা ছাড়ছে না বিএনপিসহ সরকারের প্রতিপক্ষগুলো।
আন্তর্জাতিক বা স্থানিক প্রতিপক্ষ বাদ দিলেও নতুন সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জ অনেক। টানা চতুর্থ দফায় আওয়ামী লীগের নতুন সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সামলানো। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, দুর্নীতি বন্ধ করা, বৈশ্বিক পরিস্থিতিসহ চ্যালেঞ্জগুলোকে আওয়ামী লীগের নতুন সরকার মোকাবিলা করেই এগোতে পারবে। সরকারের সেই ভাবনায় তাড়িত হওয়ার কিছু নমুনা রয়েছে। যার ছাপ অর্থ, বাণিজ্যসহ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলোতে বড় পরিবর্তন। অঙ্গীকার বাস্তবায়ন ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার বিষয় নির্ভর করে দলনেতা ও সরকারের কৌশলের ওপর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে সেই অভিজ্ঞতায় পাকা। দ্রব্যমূল্য সব মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা, কর্মসংস্থান বাড়ানোসহ ১১টি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ইশতেহার দিয়েছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণসহ দলটির নির্বাচনী অঙ্গীকারগুলো বাস্তবায়নে বাণিজ্য, অর্থ, পরিকল্পনা, কৃষিসহ যে মন্ত্রণালয়গুলো প্রধান ভূমিকা পালন করবে, সেসব মন্ত্রণালয়ে পরিবর্তন আনা হয়েছে।
অর্থনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এ মন্ত্রণালয়ে পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রী দেওয়া হয়নি। আহসানুল ইসলামকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি প্রথমবারের মতো মন্ত্রিসভায় জায়গা পেলেন। প্রথমবার মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী হতে যাওয়া ১৪ জনের মধ্যে ১০ জনই ব্যবসায়ী। অর্থমন্ত্রী করা হয়েছে অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করা আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে। তিনি ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ সরকারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন। চাকরিজীবনে ছিলেন কূটনীতিক। আরও কিছু পদে সরকারের সাংঘাতিক ভাবনার স্পষ্টতা লক্ষণীয়। ওবায়দুল কাদের দলের সাধারণ সম্পাদক। এক যুগের বেশি সময় ধরে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন তিনি। এ মন্ত্রণালয়ের অধীনে পদ্মা সেতু, বঙ্গবন্ধু টানেল, মেট্রোরেলসহ বেশ কিছু মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। এসব প্রকল্প আওয়ামী লীগ নির্বাচনী প্রচারে ব্যবহার করেছে। ফলে এ মন্ত্রণালয়ে ধারাবাহিকতা চেয়েছে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব।
বাংলাদেশে যে কোনো সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অল্পদিনেই বিতর্কিত হওয়ার একটা প্রবণতা দেখা যায়। সে তুলনায় আসাদুজ্জামান খান কিছুটা ব্যতিক্রম। ১০ বছর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সামলেছেন। এ ছাড়া স্বল্পভাষী হওয়ায় তাকে নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়নি।
গত দুই মেয়াদে আইন মন্ত্রণালয় সামলাচ্ছেন আনিসুল হক। এবারও তাকে এ পদের জন্য বিবেচনা করেছেন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা। আইন অঙ্গনে তার বাবা প্রয়াত সিরাজুল হকের পরিচিতি ব্যাপক। তাজুল ইসলামকে মন্ত্রিসভায় রেখে ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হয়েছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ সবসময় প্রধানমন্ত্রীর অধীনে রাখা হয়। ফলে এ মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রী দেওয়া হয়। এক দশক ধরে নসরুল হামিদ এ দায়িত্ব পালন করছেন। এবারও তাকে একই পদে রেখে দেওয়া হয়েছে। তবে শুধু বিদ্যুৎ বিভাগের দায়িত্ব পেলেন তিনি। তেল-গ্যাস-বিদ্যুতে ক্ষমতা ম্যাটার করে বলে একটা কথা প্রচারিত। ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ কেন ক্ষমতায় আসতে পারেনি, কদিন আগে গ্যাসের কথা উল্লেখ করে তা আবারও বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। আগের কেবিনেটের কৃষিমন্ত্রী, আওয়ামী লীগের এবারের ইশতেহার কমিটির প্রধান ড. আব্দুর রাজ্জাককে বাদ দেওয়ার পেছনেও রহস্য আছে।
সরকার ও দলকে আলাদা করার একটা আলোচনা ছিল আওয়ামী লীগে। বিদায়ী মন্ত্রিসভায় এর প্রভাব ছিল। কিন্তু এখন মনে করা হচ্ছে সামনে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুই ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার প্রস্তুতি আঁচ করা যাচ্ছে। খুব হিসাব কষে অনিবার্যভাবে পররাষ্ট্রের আগের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী দুজনকেই বাদ দেওয়া হয়েছে। নির্বাচনের আগে দলের কর্মকাণ্ডে সক্রিয় থাকা কিছু কিছু নেতাকেও পুরস্কার হিসেবে এবার সরকারে নেওয়া হয়েছে। সামনেও তাদের অনেক কাজ অপেক্ষমাণ। বুদ্ধি-পরামর্শের জন্য উপদেষ্টা নিয়োগে দেরি করা হয়নি। মসিউর রহমান, গওহর রিজভী, তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, সালমান এফ রহমান, মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক আগেও ছিলেন। নতুন যোগ করা হয়েছে কামাল আবদুল নাসের চৌধুরীকে। মন্ত্রীদের শপথের পরপরই নতুন উপদেষ্টাদের নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী রুলস অব বিজনেসের ক্ষমতাবলে এসব উপদেষ্টা নিয়োগ দিয়েছেন। উপদেষ্টারা মন্ত্রীর পদমর্যাদা, বেতনভাতা ও আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা পাবেন। এ ছাড়া অবসরপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিনকে মন্ত্রীর পদমর্যাদায় ‘অ্যাম্বাসাডর অ্যাট লার্জ’ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আগেও তিনি এ পদে ছিলেন।
বলার অপেক্ষা রাখছে না, মন্ত্রিসভা গঠন নিয়ে আগামীর রাজনীতি-কূটনীতি নিয়ে সরকারের চিন্তা-ভাবনার হোমওয়ার্ক হয়েছে অনেক।
প্রধানমন্ত্রীর নতুন অভিষেকের সময়টাতেই ঘড়ি ধরা সময়ে বিএনপি চেয়ারপারসনকে হাসপাতাল থেকে গুলশানের বাসভবন ফিরোজায় নিয়ে আসার পেছনের রাজনীতি এরই মধ্যে ওপেন সিক্রেট। বঙ্গভবনে যখন শপথ চলছিল তখন রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতাল থেকে নেতাকর্মীদের ‘খালেদা জিয়ার ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই’ স্লোগানে সিক্ত হয়ে তার বাসায় ফেরা। এর আগে দিনের মধ্যভাগে পল্টনে বিএনপির কয়েক নেতার তালা ভেঙে অফিসে ঢোকার নাটকীয় বীরত্ব। রীতিমতো সার্কাস। তাদের যেন জানাই ছিল—সরকার আজ বাধা দেবে না। বাসররাতে বা হানিমুনে দুলহান শালা-শালীদের কানমলাতেও রাগ না করার ড্রাই রান যেন।
লেখক: ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন