সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
প্রকাশ : ১৮ জানুয়ারি ২০২৪, ০৩:৫২ এএম
আপডেট : ১৮ জানুয়ারি ২০২৪, ০৯:২২ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

সরকারের মাথাব্যথা অর্থনীতি, বিএনপি নয়

সরকারের মাথাব্যথা অর্থনীতি, বিএনপি নয়

৭ জানুয়ারি যখন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন একেবারে নিশ্চিত তখন বিএনপি নেতারা বলতে শুরু করলেন, এ নির্বাচন ঠেকানো বা প্রতিহত করার কথা তারা বলছেন না। বরং নির্বাচনের পর কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।

নির্বাচন শেষে সরকার গঠিত হয়েছে, মন্ত্রীরা কাজ শুরু করেছেন এবং সাধারণ মানুষও আন্দোলন নামের আগুন সন্ত্রাস থেকে মুক্ত হয়ে যার যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আওয়ামী লীগ নির্বাচন করে সেরেছে। বিএনপি যখন নিজের আন্দোলনের ওপর নিজেই আস্থা হারিয়ে কোণঠাসা হয়ে গিয়েছিল, তখন একটা তত্ত্ব বাজারে ছেড়েছিল যে, নির্বাচন ঠেকাতে আমেরিকা একটা কিছু করবে। তবে সেটাও যখন হয়নি তখন বলেছে, নির্বাচনের পর স্যাংশন আসবে। কিন্তু তার লক্ষণ এখনো স্পষ্ট নয়।

এমন এক বাস্তবতায় সামাজিকমাধ্যম জুড়ে বিএনপি শিবিরে হতাশা যে, আমেরিকাও কিছু করল না। গত মঙ্গলবার ডাক, টেলিযোগাযোগ, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের সঙ্গে বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাসের হাস্যোজ্জ্বল ছবি তাদের আরও বেদনার্ত করেছে। দল, দলের নেতৃত্ব এবং আন্দোলন নিয়ে অনেকটাই সংশয় আর বিভ্রান্তিতে নিপতিত হয়েছে দলের সব স্তরের কর্মী ও সমর্থক।

কিন্তু এ কথা বলা যাচ্ছে না যে, আন্দোলনের এমন ব্যর্থ পরিণতিতে দলের মূল কাঠামোয় কোন ধাক্কা আসবে। নির্বিঘ্নে নির্বাচন হয়ে যাওয়া যদি একটি বজ্রপাত হয়, তার অভিঘাত তো লেগেছেই। কিন্তু সেটা কোথায়? দলের গতিপ্রকৃতিতে অসন্তোষের আভাস মিললেও সেটা সেভাবে প্রকাশিত নয় ততটা। টানা চতুর্থবার ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। তার প্রবল প্রতিপক্ষ বিএনপি। কিন্তু এবারের মতো এত আন্দোলন কখনো করেনি বিএনপি। ২০১৩ থেকে ২০১৫-এর মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত অনেক সহিংস আন্দোলন করেছে দলটি, তবে সেটি ছিল মূলত জামায়াতের নেতৃত্বে এবং যেটির লক্ষ্য ছিল যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরোধিতা করার আদর্শ থেকে। কিন্তু এবার মিছিল, মিটিং, মানববন্ধন করে মানুষকে যতটা আন্দোলনে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা ছিল, সেটা সেই সময়টায় ছিল না। কিন্তু ২৮ অক্টোবরের ঢাকার সহিংস কর্মসূচির পর দলটি আবারও হরতাল, অবরোধ ও আগুনের পথেই গিয়েছে।

বিএনপির ভাবনা ছিল একদিকে তাদের এ আন্দোলন এবং অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর চাপে সরকার নতজানু হয়ে একটা কিছু করবে। নির্বাচন তো বানচাল করবেই, এমনকি বিএনপিকে ক্ষমতায় আরোহণ করিয়ে ছাড়বে; এমন একটা বিশ্বাস দলের প্রায় প্রতিটি স্তরে দানা বেঁধেছিল। কিন্তু শেখ হাসিনা সব চাপ উপেক্ষা করে নির্বাচন করেছেন এবং এখন পর্যন্ত ক্রিজে আছেন দুর্দান্তপ্রতাপে।

বিএনপিসহ তার মিত্ররা নির্বাচন বর্জন করেছে এবং তারা নিজেদের সফলও মনে করছে যে, তাদের বর্জনের ডাকে মানুষ সাড়া দিয়েছে, কারণ ভোটার উপস্থিতি কম ছিল। নির্বাচন কমিশন ৪১ শতাংশ ভোটার উপস্থিতির কথা বলছে, যা বিএনপি মানছে না। কিন্তু নির্বাচন তো অবৈধ হয় না। কারণ বাংলাদেশের আইনে ভোটার উপস্থিতি কোনো নির্ণায়কই নয়।

সাংবিধানিকভাবে এ নির্বাচন বৈধ, যা বিদেশি দেশগুলোও বলছে। যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচনের সমালোচনা করলেও সরকারের সঙ্গে কাজ করে যাওয়ার অঙ্গীকার করেছে। জাপানের বিবৃতি ছিল আরও বেশি স্পষ্ট সমর্থন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন খুবই সতর্ক প্রতিক্রিয়া দিয়েছে।

তাহলে বিএনপি এখন কী করবে? প্রধান নেত্রী বন্দি অবস্থায় কারাগারের বাইরে একটি বাসায় আছেন। দলের এখনকার মূল নেতৃত্ব লন্ডনে বসে বাস্তবতার বাইরে। ২০১৪ সালে যা করেছিল, এবার ২০২৪ সালেও একই কাণ্ড করল দলটি। বর্জন করে নির্বাচন প্রতিহত করার আন্দোলনে মানুষ সম্পৃক্ত হয়নি। নির্বাচন ঠেকাতে না পেরে এখন এই সরকারকে অস্বীকার করেছে বিএনপি। নতুন করে নির্বাচনের দাবি তুলেছে দলটি। কিন্তু এতে সরকারকে তো তার পথ থেকে সরানো সম্ভব হচ্ছে না।

২০১৪, ’১৮ ও ’২৪—তিন সময়ে তিন ধরনের কৌশল প্রয়োগ করে নির্বাচন করেছে আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনার রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা কৌশলের কাছে হেরে এখন নিজের অস্তিত্ব ধরে রাখার চেষ্টায় বিএনপি। দলটি এখনো মনে করছে আমেরিকার দিক থেকে স্যাংশন আসবে। কিন্তু বাস্তবতা কি তাই বলে? নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, সবার সঙ্গে বন্ধুত্বের পাশাপাশি বিভিন্ন বন্ধু দেশের উদ্বেগগুলোকে সরকার মূল্য দেয়। সরকার কারও দিক থেকে কোনো চাপও অনুভব করছে না বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, নির্বাচন নিয়ে বহু চাপ, গভীর চাপ, মধ্যম চাপ, নানা ধরনের চাপ ছিল, সব চাপ উতরে নির্বাচন হয়ে গেছে।

বঙ্গভবনে নবনির্বাচিত সরকারের মন্ত্রিপরিষদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত, যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত রাষ্ট্রগুলোসহ প্রায় সব দেশের রাষ্ট্রদূতরা ছিলেন। বলতেই হবে যে, অর্থাৎ বর্তমান সরকারকে স্বাগত জানাতে তারা সবাই গিয়েছিলেন।

তাই দেখা যাচ্ছে, বিএনপি নিজে বা তাদের প্রচেষ্টায় বিদেশ থেকে কোনো চাপ সেভাবে সরকারের সামনে নেই। আছে যেটা তা হলো অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ। সরকার নিজেও জানে যে, অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা, সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও বৈদেশিক সম্পর্ক উন্নয়ন করেই পথ চলতে হবে তাকে। তবে সবার ওপরে আছে অর্থনীতি। সামষ্টিক অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন ঠেকানো, ডলারের সরবরাহ ও দাম ঠিক রাখা এবং ব্যাংক ও আর্থিক খাতকে রাহুমুক্ত রাখার মতো বড় ভাবনা সরকারের মাথায়।

২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে নানা চড়াই-উতরাইয়ের ভেতর দিয়ে গেছে দেশের অর্থনীতি। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দৃঢ় ছিলেন একটি জায়গায় যে, অবকাঠামোগত উন্নয়ন থেকে পিছিয়ে আসা যাবে না। তার প্রথম নজর ছিল বিদ্যুৎ খাতে এবং সেখানে তিনি সাফল্যও পেয়েছেন। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহে সরকার কুইক রেন্টালের আশ্রয় নেয়, যা নিয়ে এখন সমালোচনা হচ্ছে ব্যাপকভাবে। সড়ক অবকাঠামো খাতেও এসেছে বড় সাফল্য।

সরকারপ্রধান নিজে এবং তার মন্ত্রীরাও বলছেন এক নম্বর সমস্যা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করে দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের জন্য সহনীয় স্তরে নিয়ে আসা। ১০ মাস ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে আছে। সাধারণ নাগরিকদের সব আলোচনায় এখন সবার ওপর স্থান পাচ্ছে দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক দাম। এ অবস্থা চলছে সেই করোনাকাল থেকে। মূল্যস্ফীতির হার গত ডিসেম্বরে ৮ শতাংশের ঘরে নামিয়ে আনার একটা লক্ষ্য ছিল। তবে তা অর্জিত হয়নি। সামষ্টিক অর্থনীতির সব সূচকই ভাবনার কারণ হলেও মূল্যস্ফীতিকেই ধরা হচ্ছে সরকারের এক নম্বর চ্যালেঞ্জ হিসেবে। গুটি কয়েক কোম্পানির হাতে জিম্মি পুরো পণ্য বাজার। এদের মুনাফাখোরি মনোবৃত্তি, বাজারে এদের একচেটিয়াত্ব এবং এদের প্রতি নীতিনির্ধারণী জায়গা থেকে নানা প্রশ্রয় বাজারকে অস্থির করে রেখেছে। সিন্ডিকেটের কারসাজির কথা খোদ সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রীও অস্বীকার করেননি। বর্তমান মন্ত্রীও বলছেন। তবে সরকারের নীতির জায়গা থেকে দেখলে প্রথম কাজ হবে জ্বালানি তেলের দাম কমানো। সেটা করা গেলে পণ্য পরিবহনের খরচ কমে দামটাও কমত। আরেকটা হলো আমদানি করে দাম সামাল দেওয়া। কিন্তু সেটাও হচ্ছে না ডলার সংকট ও ডলারের অত্যধিক দামের কারণে।

ব্যাংক খাতের বড় বড় দুর্নীতি আর অনিয়মগুলো সরকারের জন্য বড় চিন্তা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ রাজনৈতিক নেতৃত্বের দুর্বলতায় বেসিক ব্যাংকের আবদুল হাই বাচ্চু, ফারমার্স ব্যাংকের চিশতি, পিপলস লিজিংয়ের পি কে হালদার আর হলমার্কের তানভীর সৃষ্টি হয়েছে। একজন একক ব্যক্তির হাতে আটকে গেছে অনেক ব্যাংক। ব্যাংক খাতে সুশাসন ফিরিয়ে আনাই বড় চ্যালেঞ্জ। অনেকে মনে করেন, শুধু এ খাতে শৃঙ্খলা আনতে পারলে বাকি সবটিতেই সাফল্য পাবে সরকার।

তাই বিএনপির আন্দোলন তথা বিএনপিকে বড় সমস্যা হিসেবে দেখছে না সরকার। বিএনপির কথায় বিদেশি শক্তিও সেভাবে সহযোগিতার পথ থেকে সরে গিয়ে সরকারের সঙ্গে বৈরী আচরণ করবে বলে প্রতীয়মান হয় না। নির্বাচনে ভোটদানে জনগণকে বিরত রাখার যে চেষ্টা তারা চালিয়েছিল, তাতে সফল হলেও সরকার গঠনের পথে কোনো প্রতিবন্ধকতাই সৃষ্টি করতে পারেনি।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

নাবিকদের বুকে টেনে নিলেন চসিক মেয়র

প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগের দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল বুধবার

মোটরযান গতিসীমা প্রণয়নে সরকারকে অভিনন্দন জানাল রোড সেইফটি কোয়ালিশন

হেরোইনসহ মাদককারবারি আটক

কনডেম সেলে বন্দি রাখা অবৈধ ঘোষণায় হাইকোর্টকে আসক-এর সাধুবাদ 

বিদেশে বসে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদকে উসকে দেওয়া হয় : দীপু মনি

২৫ বছর অপেক্ষার পর বিএনপি থেকে জাপায় এসেছি : রুনা খান

মৃত বাড়ি গিয়ে খাবার খেয়ে অজ্ঞান, হাসপাতালে ৭

নিয়োগ দিচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, থাকছে না বয়সসীমা

জালালাবাদ গ্যাসের বিরুদ্ধে অভিযোগ, মুখ খুললেন ব্যারিস্টার সুমন

১০

গোসল করতে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরলেন যুবক

১১

রাতে ঢাকাসহ ৮ জেলায় ঝড়ের শঙ্কা

১২

বিএনপির পর্তুগাল শাখার নতুন কমিটির অভিষেক ও পরিচিতি সভা অনুষ্ঠিত

১৩

‘ক্ষমতা সবার হাতে নিরাপদ নয়’

১৪

রূপায়ণ সিটি ও ডেলকো বিজনেস অ্যাসোসিয়েট লিমিটেডের চুক্তি স্বাক্ষর

১৫

ভোটের পরিবেশ নষ্ট করলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা : রাজশাহীর ডিসি

১৬

ঢাবি অধিভুক্ত সাত কলেজের ২ ইউনিটের ফল প্রকাশ

১৭

অনুমোদনহীন ৫ ইলেক্ট্রোলাইট ড্রিংকস, মালিকদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা

১৮

কাবিখা প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগে চেয়ারম্যানসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা

১৯

মৃত কন্যার বিয়ের জন্য মৃত পাত্র খুঁজছেন বাবা-মা

২০
X