মুফতি আরিফ খান সাদ
প্রকাশ : ১৯ জানুয়ারি ২০২৪, ০৪:১৯ এএম
আপডেট : ১৯ জানুয়ারি ২০২৪, ০২:২০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ

শীতার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ালে মিলবে সওয়াব

শীতার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ালে মিলবে সওয়াব

দেশজুড়ে পৌষের শেষে মাঘ মাসের ‘বাঘ পালানো’ শীত হাড়ে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে। হাড় কাঁপানো শৈত্যপ্রবাহে বিপর্যস্ত দেশের সাধারণ মানুষ। বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলে হিমেল বাতাসের সঙ্গে চলছে কুয়াশার দাপট। প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের হচ্ছে না কেউ। অনেক জায়গায় দেখা মিলছে না সূর্যের। ঘন কুয়াশায় দুর্ঘটনারও শিকার হয়েছেন কাজের সন্ধানে ছুটে চলা মানুষ। শীতের তীব্রতায় কাঁপছে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল। শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচতে লোকজন শুকনো খড়, কাঠ, ঘাস ও শুকনো ময়লা-আবর্জনার স্তূপে আগুন জ্বালিয়ে শরীরে তাপ পোহাচ্ছেন। শীতের প্রবাহ টের পাচ্ছে রাজধানীবাসীও। শহরাঞ্চলে উষ্ণ কাপড়ের সমাহার থাকলেও কনকনে শীতে শীতবস্ত্রহীন অসহায় লোকজন, ফুটপাতে রাতযাপন করা লোকজন এবং পথশিশুরা তরতর করে কাঁপতে শুরু করে। খেটেখাওয়া মানুষের কাছে শীত নিবারণের জন্য ভালোমানের পোশাক বা কম্বল এসবের দাম সাধ্যের বাইরে। এমন হাড়কাঁপানো শীতে অসহায়, দরিদ্র ও ছিন্নমূল মানুষের দুঃখ-দুর্দশার এসব চিত্রই আমাদের সামনে ভেসে ওঠে। অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানহীন এসব দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের নিজস্ব সক্ষমতা দিয়ে হিমশীতল ও হাড় কাঁপানো শীতের সীমাহীন কষ্ট লাঘব করা সম্ভব হয়ে ওঠে না অনেক সময়। এমন সময় মানবিক দায়বোধ থেকে চলে আসে কিছু দায়িত্বের প্রসঙ্গ। অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো ধনীদের কর্তব্য। এটা যেমন মানবিক বিষয়, তেমনি ধর্মীয় বিষয়। ইসলামে শীতকালেও রয়েছে হুকুকুল্লাহ ও হুকুকুল ইবাদ তথা বিশেষ কিছু ইবাদত এবং সামাজিক-মানবিক দায়িত্ব। এসব বিষয় পালন করলে মিলবে অফুরন্ত সওয়াব।

পৃথিবীতে দুই শ্রেণির মানুষের বসবাস—ধনী ও দরিদ্র। কোরআনের দাবি হলো, প্রথম শ্রেণির মানুষরা দ্বিতীয় শ্রেণির মানুষকে সাধ্যানুযায়ী খেদমত করবে, প্রয়োজন পূরণ করবে। দরিদ্রদের জীবন আনন্দ ও সুখময় করতে সাহায্য করবে। নিজেরা আল্লাহর পক্ষ থেকে যে অগণিত নেয়ামতে ধন্য হয়েছে, তার কিছু অংশ অভাবী ও নিঃস্বদের দান করবে। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘তারা আল্লাহর ভালোবাসায় মিসকিন, এতিম ও বন্দিদের খাবার দান করে।’ (সুরা দাহর : ৮)। মানুষের অন্যতম মৌলিক প্রয়োজন হলো পরিধেয় কাপড়। ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে কাপড় অপরিহার্য বিষয়। প্রয়োজনের প্রশ্নে শীত মৌসুমে পরিধেয় বস্ত্র ও বাসস্থানের সংস্কার উপযোগী বস্ত্র সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। শীতে কাতর লোকরা কাপড়ের অভাব অনুভব করে সর্বাধিক। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘যে মুসলমান অন্য কোনো মুসলমানকে বস্ত্রহীন অবস্থায় বস্ত্র দান করবে, আল্লাহতায়ালা তাকে জান্নাতের সবুজ বর্ণের পোশাক পরাবেন। খাদ্য দান করলে তাকে জান্নাতের ফল খাওয়াবেন, পানি পান করালে জান্নাতের শরবত পান করাবেন।’ (আবু দাউদ: ১৬৮২)। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত—রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘কোনো মুসলমান অন্য মুসলমানকে কাপড় দান করলে যতক্ষণ ওই কাপড়ের টুকরো তার কাছে থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত দানকারী আল্লাহর হেফাজতে থাকবে।’ (তিরমিজি: ২৪৮৪)।

প্রকৃতিতে ঋতুর পালাবদল মহান আল্লাহর হুকুমেই ঘটে। তিনি এতে রেখেছেন মানুষের জন্য প্রভূত কল্যাণ। শীতের এ প্রবাহও আল্লাহর হুকুমে হয়। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসুল (সা.) বলেন, ‘জাহান্নাম আল্লাহর কাছে অভিযোগ করে বলে, আমার এক অংশ অন্য অংশকে খেয়ে ফেলেছে। তখন আল্লাহ তাকে দুবার শ্বাস ফেলার অবকাশ দেন। শীতে একটি, গরমে একটি। এর ফলেই তোমরা প্রচণ্ড গরম ও তীব্র ঠান্ডা অনুভব করো।’ (বুখারি : ৪৩৭; মুসলিম : ৬১৭)। তাই শীতের পরিবেশেও একজন মুমিনের কিছু নির্দেশনা রয়েছে। পবিত্র কোরআনেও শীতের আলোচনা এসেছে। সুরা কুরাইশে বলা হয়েছে, ‘কুরাইশ সম্প্রদায় যেহেতু অভ্যস্ত; যেহেতু তারা শীত ও গ্রীষ্মকালের ভ্রমণে অভ্যস্ত।’ (সুরা কুরাইশ : ১-২)। মক্কার কুরাইশ সম্প্রদায় শীতকালে ইয়েমেনের আদন বন্দরে ও গ্রীষ্মকালে ফিলিস্তিনের গাজায় ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী বাণিজ্যনগরীতে ভ্রমণ করত। শীতে আরবের লোকেরা যেভাবে পার্থিব ব্যবসার উন্নতি করত, তেমনি আমরা চাইলেই পরকালীন ব্যবসায় অর্থাৎ পুণ্য-সম্পদে সমৃদ্ধ করতে পারি।

বসন্তকালে যেভাবে গাছগাছালি ও প্রকৃতি পত্রপল্লবে সমৃদ্ধ থাকে, পশুপাখি যত ইচ্ছা খেয়ে তাদের স্বাস্থ্যের উন্নতি করতে পারে, ঠিক তেমনি মুমিন শীতকালের দীর্ঘ রাতকে ইবাদতে কাটিয়ে এবং দিনকে রোজায় কাটিয়ে লাভ করতে পারে প্রভূত আত্মিক উন্নতি। শীতকালকে ‘ইবাদতের বসন্তকাল’ বলা হয়। আবু সাইদ খুদরি (রা.) নবীজি (সা.) থেকে বর্ণনা করে বলেন, ‘শীতকাল মুমিনের বসন্ত।’ (মুসনাদে আহমদ : ১১৬৫৬)। অন্য হাদিসে এসেছে, ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) বলেন, ‘ইবাদতকারীদের জন্য শীতকাল হলো গনিমতস্বরূপ।’ (হিলইয়াতুল আউলিয়া : ১/৫১)। অর্থাৎ শীত এমন গনিমত (যুদ্ধলব্ধ সম্পদ), যা কোনো রক্তপাত বা চেষ্টা মেহনত কিংবা কষ্ট ছাড়াই অর্জন হয়েছে। সবাই কোনো ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই এ গনিমত স্বতঃস্ফূর্তভাবে লাভ করে। কোনো প্রচেষ্টা বা পরিশ্রম ছাড়া তা ভোগ করে। সওয়াব বা পুণ্য অর্জনের বিচারে শীতকালকে বিশেষভাবে প্রাধান্য দিতে হয়। শীতের রাতে আমলের বিশেষ মর্যাদার কথা বর্ণিত হয়েছে হাদিসে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আমি কি শীতকালে গনিমতের কথা জানাব না? তা হচ্ছে—শীতকালে দিনে রোজা রাখা এবং রাতে নামাজ আদায় করা।’ (তিরমিজি : ৭৯৫)। হজরত ইবনে মাসউদ (রা.) বলতেন, ‘শীতকালকে স্বাগতম। কেননা তা বরকত বয়ে আনে। শীতের রাত দীর্ঘ হয়, যা কিয়ামুল লাইলের (রাতের নামাজ) সহায়ক এবং দিন ছোট হওয়ায় রোজা রাখা সহজ।’ (শুয়াবুল ইমান, বাইহাকি : ৩৯৪০)

শীতকাল আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের ইবাদতের এক বিশেষ মৌসুম। সালফে সালেহিন তথা পূর্ববর্তী সৎকর্মশীল ব্যক্তিরা শীতকালকে গনিমত হিসেবে গ্রহণ করতেন। শীতকাল এলে হজরত ইয়াহইয়া ইবনে মুয়াজ (রহ.) বলতেন, শীতের রাত দীর্ঘ। ঘুমিয়ে তাকে খাটো কোরো না এবং ইসলাম পবিত্র-পরিচ্ছন্ন, গুনাহর দ্বারা তাকে কলুষিত কোরো না। বিশিষ্ট সাহাবি হজরত মুয়াজ (রা.) মৃত্যুকালে কেঁদে কেঁদে বলেন, গ্রীষ্মকালের দুপুরের শীতল পানি আর শীতকালের রাতের নামাজের জন্য আমি কাঁদছি। অর্থাৎ গ্রীষ্মকালে তিনি রোজা রাখতেন এবং শীতকালে রাত জেগে নামাজ আদায় করতেন। ইমাম মালেক (রহ.) উল্লেখ করেন, সাফওয়ান ইবনে সুলাইম (রহ.) শীতকালে ঘরের ছাদে উঠে তাহাজ্জুদ পড়তেন আর গ্রীষ্মকালে ঘরের ভেতরে পড়তেন। পূর্ববর্তী অনেক বুজুর্গানে দ্বীন সম্পর্কে বর্ণিত রয়েছে, তারা শীতকালে গ্রীষ্মকালীন পোশাক ও গ্রীষ্মকালে শীতকালীন পোশাক পরে রাতে তাহাজ্জুদ পড়তেন। (লাতায়িফুল মায়ারিফ : শীত অধ্যায়)

সাহাবা ও তাবেইনদের মধ্যে শীতের আগমনের ফলে ইবাদতের ব্যাপক উদ্দীপনা সৃষ্টি হতো। ইবাদতের নবোদ্যম নিয়ে শীতকে তারা স্বাগত জানাতেন এবং এটাকে অমূল্য গনিমত মনে করে লুফে নিতেন। তারা একে অন্যকে ইবাদতের প্রতি উৎসাহ দিতেন। হজরত উবাইদ ইবনে উমাইর (রা.) বলেন, ‘কোরআন তেলাওয়াতের জন্য তোমাদের রাত দীর্ঘায়িত করা হয়েছে। সুতরাং কোরআন পড়তে থাকো। রোজা রাখার জন্য তোমাদের দিনকে ছোট করা হয়েছে। সুতরাং দিনের বেলা রোজা রাখো। শীতের রাতে জাগ্রত থেকে ইবাদত করা (সওয়াবের ক্ষেত্রে) গ্রীষ্মের দিনে রোজা রাখার সমান।’ (লাতায়িফুল মায়ারিফ পৃষ্ঠা : ৩২৭)। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, ‘শীতকালকে মোবারকবাদ। এতে বরকতের ঝরনাধারা নাজিল হয়। রাত দীর্ঘ হয় কিয়ামুল্লাইলের জন্য। আর দিন ছোট হয় রোজা রাখার জন্য।’ (লাতায়িফুল মায়ারিফ, পৃষ্ঠা : ৩২৭)

শীতে যেন বান্দার অজুতে কষ্ট না হয়, সেজন্য চামড়ার মোজায় মাসেহের সময়সীমা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। শীতে চামড়ার মোজা পরিধান করা এবং অজুর সময় পা না ধুয়ে মোজার ওপর মাসেহ করা আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার জন্য বিশেষ ছাড়। বান্দা হিসেবে মালিকের এ ছাড় গ্রহণ করা। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহর সাধারণ বিধানের পাশাপাশি ছাড়ের বিধানগুলোর ওপর আমল করা তিনি পছন্দ করেন।’ (মুসনাদে আহমদ : ৫৮৩২)। চামড়ার মোজায় মাসেহ করা শরিয়তের গুরুত্বপূর্ণ বিধান। পূর্ণ অজু অবস্থায় মোজা পরিধান করার পর অজু নষ্ট হওয়ার সময় থেকে নিয়ে বাড়িতে অবস্থানকালে (ইকামত) এক দিন এক রাত আর সফর অবস্থায় তিন দিন তিন রাত মাসেহ করার বিধান আছে। অজুতে পা ধোয়ার পরিবর্তে তিন আঙুল ভিজিয়ে, উভয় মোজার ওপর টাখনু পর্যন্ত টান দেওয়া। যদিও বছরজুড়েই এ আমল করা যায়। তবে শীতে এর সুযোগ বেশি। হজরত আলি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) মোজার ওপর মাসেহের মেয়াদ মুকিমের জন্য এক দিন এক রাত এবং মুসাফিরের জন্য তিন দিন তিন রাত নির্ধারণ করেছেন।’ (মুসলিম : ২৭৬)

অতএব, আসুন শীতের এই হিমেল পরিবেশে বিশেষ ইবাদতের প্রস্তুতি গ্রহণ করি এবং পরস্পরের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে অর্জন করি সৃষ্টির পক্ষ থেকে দোয়া এবং স্রষ্টার পক্ষ থেকে সওয়াব। শীতের উষ্ণতায় যদি সঞ্চয় করে নিতে পারি পরকালের সম্পদ, ক্ষতি কী?

লেখক: মুহাদ্দিস ও ইসলামী চিন্তাবিদ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

চিকিৎসার জন্য সস্ত্রীক সিঙ্গাপুর গেলেন মির্জা আব্বাস

গাজার কেউ সুরক্ষিত নয় : জাতিসংঘ

স্বাস্থ্যকর খাবার নিশ্চিত করতে নেদারল্যান্ডস ও বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগ

ই-স্বাক্ষরযুক্ত স্মার্ট অ্যাকাডেমিক ক্রেডেনশিয়ালকে স্বাগত জানাই

বিদ্যুৎ বিল নিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে ইবি শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ

আন্তর্জাতিক ধারাভাষ্যে রোজেল আহমেদের অভিষেক

দেড় লাখ টাকা বেতনে ওজোপাডিকোতে চাকরির সুযোগ

ছাত্রলীগের ওপরে কোনো সন্ত্রাস নেই, ছাত্রলীগ নেতার বক্তব্য ভাইরাল

টাইগারদের বিশ্বকাপ দল ঘোষণা

মার্কিন কোনো ইস্যুকেই কেয়ার করি না : ওবায়দুল কাদের

১০

সোশ্যাল মিডিয়ায় স্টান্টবাজি করে অতিরিক্ত পপুলার হতে নাই : হিল্লোল

১১

প্রথমবারের মতো বড় পর্দায় আসছে কাজী নজরুলের জীবনী

১২

নির্ধারিত সময়ে হচ্ছে না বিশ্বকাপের দল ঘোষণা

১৩

২৩ নাবিক নিয়ে চট্টগ্রামের উদ্দেশে এমভি আবদুল্লাহ

১৪

নির্বাচনী সভার বিরিয়ানি মাদ্রাসায় দিলেন ম্যাজিস্ট্রেট

১৫

আবহাওয়ায় শুধুই দুঃসংবাদ

১৬

বিদায়বেলায় এমবাপ্পে-খেলাইফির হাতাহাতি!

১৭

গাজায় যাওয়া ট্রাকভর্তি ত্রাণ ফেলে দিচ্ছে ইসরায়েলিরা

১৮

হাইকোর্টে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইলেন বিএনপি নেতা আলাল

১৯

ঢাকায় ডোনাল্ড লু

২০
X