ফেব্রুয়ারির ৫ তারিখে তাৎক্ষণিক নতুন কোনো ঘটনা নেই, বহুকথিত প্রাদেশিকতার বয়ানই বড় হয়ে ওঠে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে মুসলিম লীগের কর্তাব্যক্তিদের মাথায় একাধিক অজুহাতসূচক শব্দ ভূতের মতো চেপে বসেছিল। প্রথমত তাদের জানা ছিল যে, জবরদস্তিতে পাকিস্তান আদায় করতে গিয়ে দুই প্রদেশ ভেঙে এবং দুই পাকিস্তানকে এক করে যে সীমান্ত রেখাহীন উদ্ভট রাষ্ট্র তৈরি করা হয়, তার ভিত ছিল নড়বড়ে। তাই ভারতীয় কংগ্রেসি নেতাদের বুলি ছিল, উদ্ভট রাষ্ট্র পাকিস্তান টিকবে না। আর পাকিস্তানি নেতাদের মুখে পাল্টা লাগাতার বুলি—‘পাকিস্তান টিকে থাকতেই এসেছে’ (Pakistan has come to stay)। এ যেন আপন দুর্বলতা ঢাকতে নিজেকে প্রবোধ দেওয়া, অন্তরে শক্তি জোগানো। দুই. এর আগে প্রাদেশিকতা নিয়ে কিছু কথা পূর্ববর্তী অধ্যায়ে বলা হয়েছে মূলত প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিনের প্রাদেশিকতাবিরোধী বয়ান উপলক্ষে তার ঢাকা সফরের সময় (জানুয়ারি, ১৯৫২)। এখন সে সম্পর্কে কিছু ভিন্ন কথা দিনলিপির বিশেষ দিনের বয়ানে। যেমন ফেব্রুয়ারির ৫ তারিখে করাচির স্বনামখ্যাত ‘ডন’ পত্রিকায় ‘প্রাদেশিকতা’ শিরোনামে একটি সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। সবাই জানেন ‘ডন’ সরকারি নীতির সমর্থক দৈনিক, একে সরকারি মুখপত্রও বলা চলে, যেমন পূর্ববঙ্গে দৈনিক ‘আজাদ’। তবে এ দুয়ের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে, ‘আজাদ’ বর্ণচোরা। মাঝেমধ্যে তার রং বদলায় স্থানীয় পরিস্থিতির বিচারে। এ ব্যাপারে ‘মর্নিং নিউজ’কে বরং শতভাগ ‘সরকারি মুখপত্র’ বলা চলে। একুশের তুঙ্গ দিনগুলোতে ‘আজাদ’ যখন অবস্থা বুঝে নিয়ে ঝোপ বুঝে কোপ মেরেছে, তখন ‘মর্নিং নিউজ’ গায়ের ঘাম ঝরিয়ে দিনের পর দিন ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে মিথ্যা খবর, প্রতিবেদন ও সম্পাদকীয় নিবন্ধ ছেপেছে। সেসবের মর্মার্থ—এ আন্দোলন ভারতের প্ররোচনায় চলছে এবং পূর্ববঙ্গের হিন্দুরাই এ আন্দোলন চালাচ্ছে। তিন. হ্যাঁ, প্রাদেশিকতা নিয়ে মুসলিম লীগ ও পাকিস্তান শাসকদের যে সংকীর্ণ কূট রাজনীতির কথা বলা হচ্ছিল, তাতে পশ্চিম পাকিস্তানের ইন্ধন ছিল অপেক্ষাকৃত বেশি। বিশেষ করে সম্প্রদায়বাদী, বাংলাবিরোধী সংবাদমাধ্যমগুলোর। সেই ধারাতেই মনে হয় ইংরেজি দৈনিক ‘ডন’ ৫ ফেব্রুয়ারি এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে প্রধানমন্ত্রীর চেয়েও নিকৃষ্ট ভাষায় লেখে যে, ‘প্রাদেশিকতা পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় শত্রু। আর পূর্ব পাকিস্তানে ভাষার প্রশ্ন নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে যুবকদের শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।’ ‘ডন’ পত্রিকার মতে, এ আন্দোলনের মাধ্যমে জাতির জনক কায়েদ-এ-আজমকে অসম্মান করা হচ্ছে। জাতির জনক যখন তার ঢাকা সফরে প্রাদেশিকতার বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছিলেন, তখন কোনো প্রতিবাদ প্রকাশ পায়নি। কিন্তু তার অবর্তমানে এখন তা পাচ্ছে। ‘ডন’ জানতে চায়, কাদের প্ররোচনায় এ ধরনের রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতা চলছে। প্রাদেশিকতা তথা রাষ্ট্রদ্রোহের আড়ালে ভাষা আন্দোলনের বিরুদ্ধে শাসক ও পশ্চিম পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা পূর্ববঙ্গের ছাত্রসমাজকে ভীতসন্ত্রস্ত করতে পারেনি, আন্দোলন থেকে তাদের টলাতে পারেনি। একুশে ফেব্রুয়ারির ঘোষিত কর্মসূচি যথাযথভাবে পালনের জন্য শুধু রাজধানী ঢাকা নয়, গোটা প্রদেশের ছাত্র-যুবসমাজ প্রস্তুতি নিতে থাকে। বাদ পড়েনি মেয়েদের স্কুল-কলেজ বা কারিগরি শিক্ষায়তন। এককথায় প্রাদেশিকতার হুমকি দমাতে পারেনি ছাত্রছাত্রী ও যুবসমাজকে। এখানেই বড় পরাজয় পাকিস্তানি প্রশাসনের।
লেখাটি ভাষাসংগ্রামী, কবি, রবীন্দ্রগবেষক ও প্রাবন্ধিক আহমদ রফিক রচিত ‘একুশের দিনলিপি’ গ্রন্থ থেকে সংক্ষেপে উদ্ধৃত (চলবে)