বই হচ্ছে মানুষের সেই বন্ধু যার জাগতিক কোনো শরীর নেই কিন্তু সে ধারণ করতে পারে সমগ্র মহাবিশ্বকে। যার পরতে পরতে লুকায়িত আছে এক অনন্ত অসীম ঐশ্বর্য। যে সেই অপার ঐশ্বর্যে ডুব দিয়েছে একাগ্র সাধনায়, সে পেয়েছে বইয়ের নিজস্ব সত্তার আসল অকৃত্রিম ভান্ডার, সে হয়ে উঠেছে বইয়ের অবিচ্ছেদ্য প্রেমিক।
ব্যক্তি জাগতিক রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আমার কথা বলার সুযোগ নেই কিন্তু তার চিন্তা, তার দর্শনের সঙ্গে আমার আলাপ করার সুযোগ রয়েছে, ব্যক্তি বিভূতিভূষণ, বার্ট্রান্ড রাসেল, লালন ফকির, হুমায়ুন আজাদ, কাজী নজরুল ইসলাম; এমন সবার সঙ্গে, সবার দর্শনের সঙ্গে আমাদের কথা বলার একমাত্র পথ হচ্ছে বই। তাদের রচিত বই তাদের চিন্তা, দর্শন তৎকালীন সময়ের সমাজ, জীবন সব বিষয় সম্পর্কে ধারণা প্রদান করে, যা আমরা কেবল তাদের রচিত বইয়ের মাধ্যমেই পেতে পারি। সেজন্য বইয়ের গুরুত্ব আমার কাছে সর্বোচ্চ ও সর্বাধিক।
বাংলা একাডেমি প্রতি ফেব্রুয়ারি মাসে আয়োজন করে অমর একুশে বইমেলার। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ২১ তারিখ বাংলা ভাষার জন্য আত্মোৎসর্গের যে বীরত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে, সেই স্মৃতিকে অম্লান রাখতেই এ মাসে আয়োজিত এই বইমেলার নামকরণ করা হয় ‘অমর একুশে বইমেলা’।
মূলত এই বইমেলা প্রথম শুরু হয়েছিল ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। চিত্তরঞ্জন সাহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন বর্ধমান হাউস প্রাঙ্গণে বটতলায় এক টুকরো চটের ওপর কলকাতা থেকে আনা ৩২টি বই সাজিয়ে বইমেলার গোড়াপত্তন করেন। এই ৩২টি বই ছিল চিত্তরঞ্জন সাহা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ (বর্তমান মুক্তধারা প্রকাশনী) থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশি শরণার্থী লেখকদের লেখা বই। এ বইগুলো স্বাধীন বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের প্রথম অবদান। সেই যে পথচলা শুরু আর থেমে থাকেনি এই বই নামক প্রাণের রথযাত্রা, যা আজও প্রতি ফেব্রুয়ারি মাসে (ভাষার মাসে) বাংলা একাডেমি আয়োজন করে যাচ্ছে অমর একুশে বইমেলা।
সময়ের পরিক্রমায় বইমেলার পরিসর বেড়েছে। ২০১৪ সাল থেকে এর বড় একটি অংশকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ফলে ঐতিহ্যের শিকড় আরও বিস্তৃত হয়েছে। যে মেলা একুশের মহান ঐতিহ্যকে ধারণ করে এত বিশাল আকার ধারণ করেছে, তা এখন আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল স্থান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পাদপীঠে স্থান পেয়েছে। যেখান থেকে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও বাঙালির মুক্তির ডাক দিয়েছিলেন। এখানেই রয়েছে স্বাধীনতা স্তম্ভ ও শিখা চিরন্তন। আরও রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ম্যুরাল ও স্বাধীনতা-জাদুঘর।
অমর একুশে বইমেলা দেখিয়ে দেয় বাঙালির চিন্তার সক্ষমতা। সৃষ্টিশীলতা ও মননের বিবেচনায় সমাজের খোলা জানালা। অধ্যাপক আলী রীয়াজ তার উল্লিখিত নিবন্ধে বলেছেন—বইমেলায় গেলে পাশাপাশি সাজানো বইয়ের দিকে তাকালে বইমেলার আরেকটি বৈশিষ্ট্য সহজেই চোখে পড়ার কথা, তা হলো সহিষ্ণুতা। একই বিষয়ে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী, প্রতিদ্বন্দ্বী বক্তব্যের বইয়েরা নির্বিবাদে সহাবস্থান করে, যেমন সমাজে থাকার কথা, রাষ্ট্রে থাকার কথা। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ১৯৭২ সালে যে মেলার সূচনা হয়েছিল, গত কয়েক দশক ধরে যা অব্যাহত থেকেছে, তার মর্মবস্তু যদি কিছু থাকে তা হচ্ছে এই পরস্পরবিরোধী বক্তব্যের সহাবস্থান।
একটি আধুনিক সমাজে পাঠক হলো সার্বভৌম সত্তা। কোন বই তারা গ্রহণ করবে আর কোনটি প্রত্যাখ্যান করবে, তা তাদের এখতিয়ারের বিষয়। ভিন্নমত, ভিন্নযুক্তি, ভিন্নভাষা অপরাধ নয়। বরং অভিব্যক্তি প্রকাশের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সব মানদণ্ডে ভিন্নমত গ্রহণযোগ্য বিষয়। সমাজে চিন্তার স্বাধীনতা রুদ্ধ হলে সেই সমাজে অন্ধকার নেমে আসতে বাধ্য।
যখন আমি বিভূতিভূষণের অশনিসংকেত পড়ি তখন আমি ১৯৪৩ সালে সংঘটিত বাংলার দুর্ভিক্ষকে খুব কাছ থেকে দেখতে পারি। যখন আমি বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দ মঠ পড়ি তখন আমি ১১৭৬ (১৭৭০) সালের দুর্ভিক্ষকে খুব কাছ থেকে অনুভব করতে পারি। যখন আমি নীলিমা ইব্রাহীমের আমি বীরাঙ্গনা বলছি বইটি পড়ি তখন আমি মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক আমাদের মা-বোনদের ওপর করা পাশবিক নির্যাতনের চিত্র সম্মুখ থেকে দেখতে পাই। যখন আমি জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিনগুলি পড়ি তখন আমি সমগ্র মুক্তিযুদ্ধকে সম্মুখ থেকে দেখতে পারি। তাই একটি সঠিক বই আমাদের যে সঠিক তথ্য বা সঠিক দৃশ্য অনুভব করায়, তা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ যার সঙ্গে অন্য কিছুর তুলনা চলে না। তাই আমাদের উচিত পরিবারের সবাইকে নিয়ে বইমেলায় এসে সবাইকে উপহার হিসেবে বই দেওয়া। বই পড়ার বিষয়ে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করা। বই হয়ে উঠুক আমাদের জীবনের সবচেয়ে কাছের আপনজন, কাছের প্রিয়জন।
লেখক: গবেষক