বৃহস্পতিবার, ০৯ অক্টোবর ২০২৫, ২৪ আশ্বিন ১৪৩২
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
প্রকাশ : ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৩:৩৪ এএম
আপডেট : ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৭:৩৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেভাবে চলছে

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেভাবে চলছে

দেশের অগ্রগণ্য পাবলিক তথা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতি একটা প্রবল বিতৃষ্ণা তৈরি হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়। এই বিতৃষ্ণার কারণ কী? কিছু খবরের দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক। প্রথমেই সর্বশেষটি দিয়ে শুরু করা যাক—যেখানে বলা হয়েছে শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে অনিয়মসহ নানা অভিযোগের তদন্ত চলছে পাঁচ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) জানিয়েছে, প্রাথমিক তদন্তে কয়েকজনের অনিয়মের প্রমাণও পাওয়া গেছে।

দ্বিতীয় খবর হলো, ইমাম নিয়োগ নিয়ে উত্তাল কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। কেন্দ্রীয় মসজিদে ইমাম নিয়োগ বোর্ডকে কেন্দ্র করে বিভক্ত হয়ে পড়েছে শিক্ষক-কর্মকর্তা ও ছাত্রলীগ। শিক্ষক, কর্মকর্তাদের একাংশ নিয়োগ বোর্ড বাতিলের দাবি জানিয়েছে। শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. মামুনুর রহমান অভিযোগ করেছেন, নিয়োগ নিয়ে উপাচার্য ও ছাত্রলীগের বিভিন্ন অডিও ভাইরাল হয়েছে। ইমাম নিয়োগ বাণিজ্য নিয়েও সম্প্রতি চ্যাট ভাইরাল হয়েছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়েই ছাত্রলীগ নেত্রী কর্তৃক এক নবীন ছাত্রীকে সহিংস র‌্যাগিংয়ের ঘটনায় শেষ পর্যন্ত উচ্চ আদালতকে হস্তক্ষেপ করে বিচার নিশ্চিত করতে হয়েছিল।

ছাত্রলীগ নেতাদের ধর্ষণকাণ্ডে উত্তালই আছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। ধর্ষকদের বিরুদ্ধে, হলে অবৈধভাবে অবস্থানকারী ছাত্রলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা উপাচার্য তো নিচ্ছেনই না, উল্টো আন্দোলনরত পড়ুয়াদের দুজনকে বহিষ্কার করেছেন।

সহস্র ত্রুটি সত্ত্বেও দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাছে প্রত্যাশা ছিল যে এগুলো সামাজিক ন্যায় ও জাতীয় মানবসম্পদ সৃষ্টিতে বড় অবদান রাখবে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, এসব থেকে দূরে চলে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো। এখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দেখা হচ্ছে অন্য চোখে—ব্যক্তিগত উন্নতির সোপান হিসেবে এবং সেটা রাজনীতির মাধ্যমে। সেই রাজনীতি আবার শুধুই শাসক দলের রাজনীতি। তাহলে ছাত্রনেতাদের রাজার মতো চলাফেরা করা আর শিক্ষকদের পদ-পদবি পাওয়া সব নিশ্চিত। ব্যাপকতর চিন্তা-গবেষণা নয়, রাজনীতিই আসল দর্শন।

উচ্চশিক্ষার এ সংকোচন ও লঘুকরণের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর পন্থা আমাদের বিদ্বৎসমাজ ভেবে ওঠেননি, এটা তাদের ব্যর্থতা। অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয় এখন কোনো বিদ্বৎসমাজই তৈরি করছে না। কিছু কাগুজে আলোচনা হয়, যেমন এই লেখা। আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মূল উপকরণ স্লোগান-মিছিল-অবরোধ এবং তজ্জনিত হিংসা আর অনাচার। ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির কল্যাণে শাসককুলের কোনো সমস্যা হচ্ছে না, বলির পাঁঠা হচ্ছে সাধারণ ছাত্র-শিক্ষকের দল।

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় যে বিশাল গলদ এবং পক্ষপাতিত্ব আছে তা রেখেই চলছে আমাদের উচ্চশিক্ষার সব চেষ্টা। সবাই জানে যে, এগুলোতে এখন শিক্ষক নিয়োগ যতটা হয়, তার চেয়ে বেশি হয় ভোটার নিয়োগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. কামরুল হাসান মামুনের একটি লেখা পড়ছিলাম। সেখানে তিনি বলছেন, ‘বিদেশে একজন আন্ডারগ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থীকে ভর্তি করতে অনেক কিছুর প্রয়োজন হয়। শুধু একটি ভর্তি পরীক্ষাই সব নয়। শিক্ষার্থীকে নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা পুঁজি করে একটি রচনা লিখতে হয়, স্কুলের শিক্ষক এবং স্কুলের কাউন্সিলরের সুপারিশপত্র দিতে হয়, বাবা-মায়ের আয়-রোজগারের বিষয় জানাতে হয়, যেই প্রতিষ্ঠানে দরখাস্ত করবে সেখানে কেন পড়তে চায় সেটার ওপর বিশেষভাবে রচনা লিখতে হয়। তারপর আবার অ্যাডমিশন অফিস থেকে সাক্ষাৎকার নেয়।’ এরপর তিনি বললেন, ‘আর আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ হয় ২০ মিনিটের একটা সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে। কত অবহেলা! অথচ একজন শিক্ষক নিয়োগ মানে ৩০-৩৫ বছর ধরে হাজার হাজার শিক্ষার্থী পড়াবে।’

তো ভোটার যদি নিয়োগের লক্ষ্য হয়ে থাকে, তাহলে শিক্ষকের মান কেমন হবে সেটা অনুমেয়। আবার তারাই যদি জানে গবেষণা আর লেখাপড়ার চেয়ে রাজনীতি উত্তম, তাহলে পরিবেশ ভালো হবে কেমন করে?

দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি আর নিয়োগ বাণিজ্য একেবারে স্বাভাবিক অভিযোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের বিরুদ্ধে। ২০২১ সালের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা চিন্তা করুন। উপাচার্য অধ্যাপক এম আব্দুস সোবহানকে তার শেষ কর্মদিবসে পুলিশ পাহারায় ক্যাম্পাস ছাড়তে হয়েছিল। শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালার পরিবর্তন করে নিজ মেয়ে ও জামাতাকে নিয়োগ, রাষ্ট্রপতিকে অসত্য তথ্য দিয়ে অবসরগ্রহণ, বিভিন্ন নিয়োগে স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতিসহ বিস্তর অভিযোগ নিয়ে বিদায় নিয়েছিলেন তিনি।

এর আগে ২০১৯ সালে আমরা দেখেছি শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য খোন্দকার নাসিরউদ্দিনকে ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল রাতের অন্ধকারে। দিনাজপুর হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (হাবিপ্রবি) উপাচার্য প্রফেসর ড. মু. আবুল কাশেম মেয়াদ শেষ হওয়ার ১৮ দিন আগেই গোপনে কাউকে কিছু না জানিয়ে রাতের আঁধারে ক্যাম্পাস ত্যাগ করে চলে যান।

এগুলো কোনো পরিবেশ, কোনো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের? অথচ এসবই চলছে। আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের এমন অবস্থা কেন? প্রতিষ্ঠান প্রধানদের প্রতি ছাত্রছাত্রীদের এমন মনোভাব কেন সৃষ্টি হয়? উপাচার্যরা উৎখাত হন শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মচারীদের আন্দোলনের মুখে, কিন্তু সমস্যাকে কখনো উৎখাত করা সম্ভব হয় না।

আগেই বলেছি, আবারও বলতে হচ্ছে যে, দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সমস্যা আলোচনা করতে গেলে রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে শাসক দল, এর ছাত্র সংগঠনের ভূমিকা এবং শিক্ষকদের কদর্য রাজনীতি আলোচনায় আসবেই। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যতই বলি যে, আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো রাজনীতিমুক্ত হোক, সেটা হচ্ছে না। এমনকি রাজনীতিকরাও মাঝেমধ্যেই এমন সদিচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু বাস্তব বড় গোলমেলে। ক্যাম্পাসে রাজনীতি থাকবেই, কিন্তু সেটা কোন রাজনীতি?

প্রশ্ন হলো সেই রাজনীতি কি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থের চেয়ে বড় হয়ে দেখা দেবে? কেন এমন পরিস্থিতি হবে যে, শিক্ষকরা লেখাপড়া শেখানো ও গবেষণার চেয়ে দলাদলি বেশি করবেন? কেন লেখাপড়ার ভুবনে ছাত্রছাত্রীরা দাঙ্গা-হাঙ্গামায় নিয়োজিত থাকবে? ক্যাম্পাসে কেন বহিরাগতদের উৎপাত হবে? ক্যাম্পাসে কেন ছিনতাই হবে? কেন ধর্ষণ হবে একের পর এক? কেন খুন হবে যেমন করে হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবু বকর আর বুয়েটের আবরার? কেন শিক্ষক নিগ্রহ হয়? কেন পুলিশ ডাকতে হয়?

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর দেওয়া স্বায়ত্তশাসনের অপব্যবহার করে করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন আর প্রতিষ্ঠান নেই। এই আইন অবশ্য সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কার্যকরও নেই। ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির কারণে এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন অনেক বেশি সরকারি। সরকারের টাকায় বিশ্ববিদ্যালয় চলে, শিক্ষক-কর্মচারীরা বেতন পান। সমস্যা এখানেই। বিশ্ববিদ্যালয় ‘স্বশাসিত’ থাকবে, এ ধারণাই আর এখন নেই। দলবাজি রাজনীতি এবং সেই রাজনীতিতে সরকারদলীয় শিক্ষক ও ছাত্ররাজনীতির ভেতর নানা গ্রুপিং এমন এক জটিলতার সৃষ্টি করেছে যে, এগুলো এখন আর উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান তো দূরের কথা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবেই থাকছে না।

সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যরা নিজ নিজ ক্যাম্পাসে সরকারদলীয় রাজনীতির অঘোষিত সভাপতি। ক্যাম্পাসের ভেতরে বাইরের নানা পদ-পদবি, শিক্ষক ও কর্মচারী-কর্মকর্তা নিয়োগ, ক্যাম্পাসের ভেতর নির্মাণকাজ—এসব নিয়ে এমন গ্রুপিং আর লবিং শুরু হয় যে, প্রভাষক থেকে উপাচার্য পর্যন্ত সবাই যে যার জায়গা থেকে শুধু পাওয়ার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকেন। শাসক দলের ছাত্র সংগঠনের বড় ও পাতি নেতারা ব্যস্ত থাকেন কার পকেটে কত অর্থ এলো তা নিয়ে।

পুরো মডেলটাই বদলে গেছে। সারা দিন রাজনীতি, দলবাজি আর গ্রুপিং নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয় উপাচার্য, শিক্ষকদের। আমাদের উপাচার্যরা নিজেদের সেখানে নিয়ে গেছেন যে কোনোভাবেই হোক। এখন আর ফেরার পথ যেন নেই। এ মডেলেই চলছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু কিছু কথা তো বলতেই হয়। আমাদের শিক্ষকরা, উপাচার্যরা যদি স্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণা থেকে সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালনা করতে চান, তাহলে সেটা পরিষ্কার করুন। জনগণের টাকা নিয়ে যাচ্ছেতাই করবেন আর বলবেন আপনারা বিশ্ববিদ্যালয় চালাচ্ছেন, সেই অধিকার নিশ্চয়ই দেওয়া হয়নি আপনাদের।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ডিএনসিসি এলাকায় টাইফয়েডের টিকা পাবে ১৩ লাখ শিশু

অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে রেমিট্যান্স এসেছে ৬৯ কোটি ডলার

৭ বছর পর শহীদ জিয়ার মাজার জিয়ারত করলেন খালেদা জিয়া

ফার্মগেটে ককটেল বিস্ফোরণ

কালবেলার সংবাদের পর স্বপ্নের রঙিন ঘরে শাহারবানু

আখিরাতের কল্যাণ নিশ্চিতে কাজ করছে জামায়াত : মুজিবুর রহমান

রাজধানীতে তারেক রহমানের সাক্ষাৎকারের রেকর্ডেড ভিডিও প্রদর্শন

জবাব দিতে পিএসসিকে আলটিমেটাম

অসদাচরণের অভিযোগে বদলি চিকিৎসক দম্পতি

সড়কের পাশে ময়লার ভাগাড়, দুর্গন্ধে অতিষ্ঠ মানুষ

১০

শহীদ জিয়ার মাজারে দোয়া করলেন খালেদা জিয়া

১১

নোয়াখালী বিভাগ চাইলেন ‘কাবিলা’

১২

বেথ মুনির রেকর্ডে অস্ট্রেলিয়ার দুর্দান্ত জয়

১৩

‘বিষাক্ত মদ’ পানে সংরক্ষিত ইউপি সদস্যের স্বামীর মৃত্যু

১৪

বিদায় নিচ্ছে মৌসুমি বায়ু, বৃষ্টি নিয়ে নতুন তথ্য

১৫

ঢাকা উত্তর সিটিতে জন্মনিবন্ধন ছাড়াই টাইফয়েড টিকা মিলবে

১৬

শহীদ জিয়ার মাজার জিয়ারতে খালেদা জিয়া

১৭

জাতীয় পর্যায়ে রানার্স আপ নারী ফুটবল দলকে গণসংবর্ধনা

১৮

দুই বছর আগের মামলায় নতুন করে ‘আসামি’ সাংবাদিক

১৯

বদলির আদেশের ৩ সপ্তাহ পরও অফিস করছেন রাসিক সচিব

২০
X