অরুণ কুমার বিশ্বাস
প্রকাশ : ২৯ মার্চ ২০২৪, ০২:৪৮ এএম
আপডেট : ২৯ মার্চ ২০২৪, ০৯:৩০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

একজন অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান

একজন অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান

প্রফেসর ড. জিয়া রহমান, ডিন, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর আমাদের মাঝে নেই। তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ২৩ মার্চ শনিবার ভোর সাড়ে ৪টার দিকে নগরীর একটি প্রাইভেট হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। খবরটা শুনে প্রথমে আমি বিশ্বাসই করতে পারিনি, কারণ মৃত্যুর আগের দিনই তিনি আমাদের ক্লাস নিয়েছেন, দীর্ঘ প্রায় সোয়া দুই ঘণ্টা। পুরোটা সময় তিনি স্বভাবসুলভ হাস্যোজ্জ্বল ছিলেন, আন্তরিক ভঙ্গিমায় পোডিয়ামে দাঁড়িয়ে পায়চারি করতে করতে পড়িয়েছেন ক্রিমিনোলজি বিষয়ক নানান থিওরি, বাংলাদেশের সঙ্গে তার সাযুজ্যতা ইত্যাদি প্রসঙ্গ। স্যারের সঙ্গে আমার পরিচয় যে খুব বেশি দিনের এমন নয়, তবে টেলিভিশন টকশোতে দেশের অপরাধ প্রবণতা, সামাজিক অস্থিরতা, অপরাধের ধরন ও কারণ, অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার বিশ্লেষণধর্মী চাঁছাছোলা ঋজু কথোপকথন আমাকে আবিষ্ট করত। মনে হতো স্যারের আরও অনেক কিছুই হয়তো বলবার আছে, যা তিনি বলতে গিয়েও কখনো কখনো নিজেকে সামলে নেন, ‘আনকাট’ বলতে চান না বা পারছেন না। স্যার প্রায়ই বলতেন, এই যে আমাদের অপারগতা, মেনে নেওয়ার সংস্কৃতি বা নিয়ত আপসকামিতা, এসব থেকেই নগরজীবনে জন্ম নেয় দুর্লঙ্ঘ্য ‘সোশ্যাল সিকনেস’ বা অ্যানোমি (এমিল ডুর্কহেইম), যা কি না অনেক সময় আমাদের অকালপ্রয়াণ, আত্মহনন বা অপমৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

ড. জিয়া রহমান শুধু আমার শিক্ষক নন, তিনি আমার চোখে একজন আইকনিক ফিগার, যার হাত ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের গোড়াপত্তন হয়। বরাবরই তুখোড় ছাত্র ছিলেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সোশিওলজি বিভাগে তিনি স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর উভয় পরীক্ষাতেই প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন। তারপর উচ্চশিক্ষার্থে তিনি চলে যান কানাডার ক্যালগ্যারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। দুবছর মাস্টার্স সম্পন্ন করেন, তারপর করেন ডক্টরাল রিসার্চ।

ভাগ্যক্রমে মাস কয়েক আমি তার ছাত্রত্ব গ্রহণের সুযোগ পেয়েছি। ‘ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড ক্রিমিনাল জাস্টিস’ বিষয়ে প্রফেশনাল মাস্টার্স করতে গিয়ে আমি এই সুযোগ পাই এবং বলতে দ্বিধা নেই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই বিরলপ্রজ শিক্ষকদের মধ্যে জিয়া স্যার অন্যতম, যারা কি না পড়াশোনা এবং অধ্যাপনা দুটোকেই জীবনের একমাত্র ব্রত হিসেবে বেছে নিয়েছেন। এখানে প্রসঙ্গত বলা যায়, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ছিলাম। সেই গেল শতকের শেষদিকে প্রবাদপ্রতিম শিক্ষক শ্রদ্ধেয় কবীর চৌধুরী, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, খোন্দকার আশরাফ হোসেন, কাশীনাথ রায়, ড. ফকরুল আলম এবং সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম স্যারের ক্লাসও আমি পেয়েছি। তখনই বুঝতে পেরেছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন টারশিয়ারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে সার্বিক বিবেচনায় অনন্য! পরে ইংল্যান্ডে পড়তে গিয়ে আমার মনে হয়েছে, তাদের তুলনায় আমরা খুব একটা পিছিয়ে নেই। কারণ এখানে ড. জিয়া রহমানের মতো নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক আছেন। চাইলেই তিনি কানাডায় থেকে যেতে পারতেন অথচ তিনি ফিরে এসেছেন। কারণ তিনি বাংলাদেশকে ভালোবাসেন। দেশের প্রতি তার ভীষণ কমিটমেন্ট রয়েছে। স্যারকে অন্তরের অন্তস্তল থেকে অভিবাদন জানাই।

বলা বাহুল্য, অপরাধবিজ্ঞান এদেশে অপেক্ষাকৃত নতুনতর একটি বিষয়। অনেকেই এখনো জানেন না বা মানেন না, অপরাধবিজ্ঞান বিষয়েও উচ্চতর পড়াশোনা বা গবেষণা করা যায়! প্রফেসর ড. জিয়া রহমান সেক্ষেত্রে একটি বৈপ্লবিক অধ্যায়ের সূচনা করেছেন—একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন হিসেবে গুরুভার দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি যখন আমাদের ক্লাস নিতেন মনেই হতো না, তিনি আজ অপ্রস্তুত বা অপ্রতিভ হয়ে এসেছেন, বরং সোশিওলজিক্যাল নানাবিধ থিওরি পড়ানোর সময় তিনি এতটাই সপ্রতিভ থাকতেন যে, আমার অন্তত মনে হতো জিয়া স্যার নিজেই একজন ‘মাল্টিসেক্টরাল বা মাল্টিফ্যাচিটেড থিওরিস্ট’।

আমি গোয়েন্দাগল্প লিখি, স্যারকে বিষয়টি বললাম। এও জানালাম যে, আমি সরকারের যে-সেক্টরে কাজ করি সেটি ট্রেড-বেইজড মানিলন্ডারিং বা হোয়াইট-কলার ক্রাইমে ভরপুর একটি জায়গা। স্যার, যদি কখনো সুযোগ হয়, এ বিষয়টি ক্রিমিনোলজি বিভাগের পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করবেন। স্যার হেসে বললেন, চেষ্টা করব, আর সেক্ষেত্রে তুমি নিশ্চয়ই আমার সহকর্মী হবে। কারণ স্মাগলার এবং অসৎ ব্যবসায়ীরাই ঋণপত্র জালিয়াতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার করছে। ওরা দেশের শত্রু। আমিও সানন্দে হেসে স্যারকে অনুসমর্থন জানালাম।

একটি বিষয় এখানে উল্লেখ না করলেই নয়, এই ক’মাসে যেটুকু বুঝেছি, প্রফেসর ড. জিয়া স্যারের মতো বন্ধুবৎসল, সদাহাস্যময় এবং দিলখোলা মানুষ খুব একটা দেখা যায় না। পড়াতে গিয়ে তিনি মাঝেমধ্যে আবেগতাড়িত হতেন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই তিনি আবার নিজেকে শুধরে এবং সামলে নিতেন, বলতেন, দেশটাকে একটু বেশি ভালোবাসি তো তাই দু-চারটা হক কথা মুখ ফসকে বেরিয়ে যায়। প্লিজ, টেক ইট ওনলি অ্যাজ অ্যান ‘একাডেমিক ডিসকাশন’। স্যারের সমুদ্রসম অধীত জ্ঞান, মনীষা, জিগীষা এবং প্রাতিস্বিকতা আমাকে সত্যি মুগ্ধ করেছে। ও আরেকটি কথা, স্যার পড়াতে গিয়ে প্রায়ই তার স্লাইডস শেষ করতে পারতেন না, কারণ তাকে, বস্তুত, কোনো বাঁধাধরা পাঠ্যসূচিতে আবদ্ধ করা যেত না। তিনি প্রসঙ্গক্রমে অনেক কথা বলতেন। বস্তুনিষ্ঠ উপমা, উৎপ্রেক্ষা এবং উদাহরণ টানতেন, যা কি না কেবল একজন ঋদ্ধিমান ও শুদ্ধতম শিক্ষকের পক্ষেই সম্ভব। স্যারকে অশেষ সালাম জানাই।

জিয়া স্যারকে এবারের বইমেলায় আমি একটা বই উৎসর্গ করেছিলাম। শিরোনাম, মনে পাপ ছিল। যারা লেখালেখি করেন তারা নিশ্চয়ই জানেন, একটি বই লেখকের কাছে সন্তানতুল্য, সেই সন্তানটিকে কারও নামে উৎসর্গ করা খুব সহজ কাজ নয়। ‘মনসিজ’ অঢেল শ্রদ্ধা-সম্মান থাকলেই কেবল তা করা সম্ভব। বুঝতেই পারছেন, স্যার আমার কাছে কতখানি আদরণীয় ছিলেন!

অপরাধ ও সমাজবিজ্ঞান ছাড়াও ড. জিয়া রহমান গ্লোবালাইজেশন ও লেবার ইস্যুজ, পৃথিবীব্যাপী লেবার মুভমেন্ট, ইন্টারন্যাশনাল টেরোরিজম, ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম, ইয়ুথ ক্রাইম, রিসার্চ মেথডোলজি, আরবান সোশিওলজি, পলিটিক্যাল সোশিওলজি ইত্যাদি বিষয়ে গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। শুধু কেতাবি বা বুকিশ নলেজ নয়, যে কোনো বিষয়ে তিনি বাস্তবিক উদাহরণ টেনে তা ব্যাখ্যা করতেন, আর যে-বিষয়টি সমাজসচেতন মানুষ হিসেবে আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগত, স্যার খুব সহজ, সরল ও প্রাঞ্জল ভাষায় সাহসিকতার সঙ্গে সমাজে বিদ্যমান সমস্যাগুলো (অ্যানোমির বাস্তবসম্মত কারণ) চিহ্নিত করতেন এবং তার জুতসই কারণ ব্যাখ্যা করতেন। অনেকেই পাঠদান করেন, কিন্তু সবাই তো আর শিক্ষার্থীদের কাছে প্রিয় শিক্ষক হয়ে উঠতে পারেন না! তিনি পেরেছিলেন। কারণ যা তিনি বুকে ধারণ করতেন, তা-ই তিনি মুখেও প্রকাশ করতেন। এই সততাই তাকে শিক্ষক হিসেবে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিল।

সবশেষে বলি, জীবন সংক্ষিপ্ত এবং অনিশ্চয়তায় পরিপূর্ণ। কে কখন চলে যাবে কেউ বলতে পারে না। স্যারের জীবন হয়তো তত দীর্ঘ হয়নি। তবে যথোচিত বিস্তৃতি লাভ করেছিল—এ কথা হলপ করে বলা যায়। পরপারে ভালো থাকবেন স্যার, অনেক ভালো। আর আমাদের আশীর্বাদ করবেন, আমরাও যেন আপনার মতো সত্যে অবিচল এবং কর্তব্যে অটল থাকতে পারি।

লেখক: সাহিত্যিক, প্রথম সচিব (শুল্ক)

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

কালবেলায় সংবাদ প্রকাশ, সেই আ.লীগ নেতা কারাগারে

গুচ্ছের এ ইউনিট ভর্তি পরীক্ষা / জবিতে মোট উপস্থিতি ৮৩ শতাংশ

জায়েদকে ফিরিয়ে আনছেন ডিপজল

হেলিকপ্টারে উঠতে গিয়ে পড়ে গেলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়

মিল্টন সমাদ্দারকে গ্রেপ্তারের দাবিতে মানববন্ধন

আবারও দাম বাড়ল পেঁয়াজের

হাসপাতালে ডাক্তারকে পাওয়া না গেলে ব্যবস্থা : স্বাস্থ্যমন্ত্রী

ভূমিকম্পে কাঁপল জাপান

ভারত সিরিজকে বিশ্বকাপ প্রস্তুতির ভালো সুযোগ হিসেবে দেখছেন জ্যোতি 

সর্বোচ্চ তাপমাত্রায় পুড়ছে চুয়াডাঙ্গা

১০

রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির চেয়ারম্যানকে ডার্মাটোলজি জার্নালিস্ট ফোরামের শুভেচ্ছা

১১

সেভ দ্য চিলড্রেনে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ, থাকছে না বয়সসীমা

১২

সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড ভাঙার আশঙ্কা যে ৬ জেলায় 

১৩

মেসি ফ্যানদের স্কোয়াডে রাখবেন না কোচ  

১৪

হিটস্ট্রোকে আরএফএল কোম্পানির মাঠকর্মীর মৃত্যু

১৫

ফিলিস্তিনিদের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে সাড়া দিয়েছে ইসরায়েল

১৬

বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠাতে ব্রিটিশ বাংলাদেশিদের প্রতিমন্ত্রীর আহ্বান

১৭

আমার অভিভাবকরা

১৮

কচুরিপানা পরিষ্কার করতে খালে নামলেন প্রাণ গোপাল

১৯

ফের কমলো সোনার দাম

২০
*/ ?>
X