মোস্তফা কামাল
প্রকাশ : ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ০২:১২ এএম
আপডেট : ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৭:২৬ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

নিত্যপণ্যে ঈদের দোষ গরমের ঘাড়ে

নিত্যপণ্যে ঈদের দোষ গরমের ঘাড়ে

হিমাগারে রাখা আলুর দামও বেশি পড়ছে। এ ছাড়া গত বছর আলুর যে সংকট হয়েছিল, তা কাটিয়ে ওঠার জন্য বাড়তি যে উৎপাদন দরকার ছিল, সেটা হয়নি। সামনে আলুর দাম আরও চড়ার লক্ষণ বুঝে সরকার দেশের বাজারে আলুর সংকট নিরসনে এটি আমদানির অনুমতি দিয়ে রেখেছে। কিছু আমদানিকারক সামান্য পরিমাণে আলু নিয়ে আসছেন বলে তথ্য আছে কৃষি বিভাগের কাছে।

রোজা-ঈদ শেষে এখন অজুহাত গরমের। নতুন করে তেল-পেঁয়াজের তালিকায় তাল মিলিয়েছে আলু, ডিম, আদা ও রসুনের তাল। চাল, ডাল, আটা, ময়দা, চিনি আছে আগে থেকেই। এ নিয়ে ব্যবসায়ীদের হাতে হাতে অজুহাত। এ নিয়ে যেন এক কুদরতি হিম্মত তাদের। নইলে আচানক কোনো ম্যাজিক। নিত্যপণ্যের চড়া দামের ব্যাপারে এখন যত দোষ গরম আর তাপপ্রবাহের। শীত-গরম, রোজা-পূজা, বন্যা-খরা কোনো ছুঁতাই তারা হাতছাড়া করে না। পারলে ওপরওয়ালাকেও ছাড় দেয় না।

সরকার থেকে ডাকদোহাই দেওয়া হচ্ছে অবিরাম। নৈতিকতার পাশাপাশি বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী ধর্মের ভয়ও দেখিয়েছেন। এসবে কেয়ার না করলে যে কিছু হয় না, তা ব্যবসায়ীদের জানা হয়ে গেছে। আর জানা-বোঝার কারণেই ঈদের পর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে দিয়ে সয়াবিন তেলের দাম ফের বাড়িয়ে দিতে পেরেছে। ঈদের আগে থেকে বাড়ছিল আলুর দাম। এক সপ্তাহের ব্যবধানে আলুর দাম আরও বেড়েছে কেজিতে ৫-৭ টাকা। রসুন-আদায়ও বেশ টোকা পড়েছে। ঈদের পর মূল্যবৃদ্ধির এ তালিকায় নাম লিখিয়েছে ডিমও। প্রতি ডজন ডিমের দাম বেড়েছে ১০-১২ টাকা। ডিমের দাম বাড়তে থাকলে মুরগি কেন বাদ পড়বে? এর বিপরীতে টানা কয়েক মাস ধরে বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যের দামে কমতির ধারা। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি নিরাপত্তাবিষয়ক অঙ্গসংগঠন ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচারাল অর্গানাইজেশনের (ফাও) হিসাব দেখিয়ে দিয়েছে।

তাদের হিসাব বলছে, ২০২৩ সালের জুলাই মাস থেকে বিশ্ববাজারে খাদ্যের দাম কমা শুরু হয়েছে। দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যের দাম ১৩ দশমিক ৪ শতাংশ, ভোজ্যতেলের দাম ১১ শতাংশ এবং মাংসের দাম দশমিক ৮ শতাংশ কমেছে। করোনা মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ২০২১-২২ সালে বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যের দামে ঊর্ধ্বগতি দেখা দিয়েছিল। বর্তমানে মূল্যহ্রাসের যে ধারা শুরু হয়েছে, বড় কোনো বৈশ্বিক বিপর্যয় না ঘটলে এ ধারা অব্যাহত থাকবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে এ বিষয়ক কথা আমলে নিতেই নারাজ বিজনেস কমিউনিটি। উপরন্তু, দাম চড়ানোর যাবতীয় অজুহাতে হাত পাকাতে পাকাতে তারা এখন ভর করেছেন গরমের ওপর। সেইসঙ্গে ডলার ক্রাইসিসের সুর তো আছেই। তেল, চিনিসহ ভোগ্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতার জন্য খুচরা দোকানি, পাইকার ও উৎপাদক কোম্পানির প্রতিনিধিদের মধ্যে পরস্পরকে দোষারোপ করে নিজের কাজ সারিয়ে ফেলার একটি চাতুরি বরাবরই আছে। দোকানিরা নিজেদের দোষমুক্ত রাখতে দায় ফেলেন তাদের বড় মিয়াদের ওপর। বড় মিয়ারা একযোগে কারসাজি করে পণ্যের দাম বাড়ালে ছোট বা খুচরারা কী করবেন, কী করার আছে—এ ধরনের কড়া যুক্তিতে বেচাবিক্রির কাজটা সেরে ফেলেন।

মূলত নিত্যপণ্যের মধ্যে গম, চিনি, সয়াবিন তেল, পামঅয়েল, ডাল ও সয়াবিন তেলের কাঁচামাল সয়াবীজ আমদানিতে তুলনামূলক বেশি ব্যয় হয়। বিশ্ববাজারে এগুলোর দাম কমতির দিকে। রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের পর গত বছর মার্চে খাদ্যপণ্যের দামে যেভাবে বাড়তির ঢোলে বাড়ি পড়েছিল, তা কমে গেছে গত কয়েক মাসে। ভোজ্যতেল, দুগ্ধজাত পণ্য, চিনির দাম কমায় এ সূচক নিম্নগামী। সংস্থাটি জানায়, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়াসহ রপ্তানিকারক দেশগুলোর সরবরাহ বাড়ায় গমের দাম ২.৫ শতাংশ কমেছে। জানুয়ারিতে কমার মধ্য দিয়ে টানা তিন মাস নিম্নমুখী গমের বিশ্ববাজার। এরপরও বিশ্ববাজার পরিস্থিতির অজুহাতে ছাড় নেই। দাম কমার বিপরীতে দেশে গমের দাম বাড়ছে। তখন গমের দাম বাড়ায় গম দিয়ে তৈরি বেকারি পণ্যের দাম ২০-৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ায় বেকারি অ্যাসোসিয়েশন। এর ফলে একটি ৫০০ গ্রামের পাউরুটি কিনতে আগে যেখানে ৬০ টাকা লাগত, দাম বেড়ে গিয়ে সেটি এখনো ১০০-১২০ টাকায় বিক্রি হয়।

বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ আমদানি করে এমন নিত্যপণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কমেছে পাম তেলের দাম। এর আগে ভোজ্যতেল আমদানিতে সরকারের পক্ষ থেকে ভ্যাট প্রত্যাহার ছাড়াও বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়। আর ওই সুবিধা নিয়ে আমদানি করা তেল দেশের বাজারে এলে দাম কমার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। মূলত ব্যবসায়ীদের অজুহাতেরই জয় হয়। বিশ্ববাজারে চিনির দরও কমতির দিকে। কিন্তু বিপরীত চিত্র বাংলাদেশে। সেইসঙ্গে তলে তলে কারসাজিও চরমে। কারসাজিকে পোক্ত করতে অজুহাত তো আছেই। লোহিত সাগরে আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্বের অজুহাত নতুন করে যোগ হয়েছে গত কদিন ধরে। বাংলাদেশের বাজার এমন পরিস্থিতিতে চলে গেছে যে, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে এর প্রভাব বাংলাদেশের বাজারে পড়ে না। আমদানি হয়ে যখন ভোক্তাপর্যায়ে আসে তখন মধ্যস্বত্বভোগীরা বাজারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সংগতি থাকলেও বাংলাদেশে এখন উৎপাদন ও পরিবহন খরচ তুলনামূলক বেশি। এ খরচ কমাতে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও ডিজেলের দাম কমানো দরকার। সরকারের পক্ষে সেটি করা অসম্ভব। এ ছাড়া আমদানি বাড়িয়ে বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়ানোর রাস্তাও দিতে চান না বড় মিয়ারা। ব্যবসায়ীরা যুক্তি দেখান, আগের বেশি মূল্যে আমদানি করা থাকে। তাই আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও তারা দাম কমায় না। কমে যাওয়া দামের পণ্য আমদানি না হওয়া পর্যন্ত দেশের ব্যবসায়ীরা আগের দামেই পণ্য বিক্রি করেন। আবার কম দামে পণ্য আনলেও তারা বেশি মুনাফার লোভে পণ্য মজুত করে রাখার চেষ্টা করেন। চাতুরি-কারসাজির সব পথ তাদেরই কবজায়।

শুল্ক সুবিধা দিয়েও সরকার তাদের বাগে আনতে পারে না। এক আব্দুল মোনেম গ্রুপের চিনি কারসাজিতেই সেই দৃষ্টান্ত বোধগম্য। বহু দেরিতে তাদের বন্ডেড সুবিধার অপব্যবহার ধরা পড়েছে। চিনি নিয়ে কারসাজি তারা করে আসছিল অনেক দিন থেকে। কিছু কারণে এবার একটু ফেঁসে গেছে মেসার্স আব্দুল মোনেম সুগার রিফাইনারি লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি দুই ধাপে বন্ড সুবিধায় আনা প্রায় পাঁচ লাখ টন চিনি অবৈধভাবে অপসারণ করেছে। এতে সরকারের হাজার কোটি টাকারও বেশি রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে। তারপরও খেমটি ছাড়েনি। সরকারের পাওনা শোধে গড়িমসি করতে থাকে। কিস্তিতে দেওয়ার কথা থাকলেও ৬৭৪ কোটি টাকা কোনোভাবে আদায় করতে পারছে না ঢাকা দক্ষিণ বন্ড কমিশনারেট। সর্বশেষ পদক্ষেপ হিসেবে আব্দুল মোনেম সুগার রিফাইনারির সব ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। বন্ডেড সুবিধায় চিনি এনে অবৈধভাবে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে, যা বন্ডেড সুবিধার অপব্যবহার। প্রথম ধাপে ঢাকা দক্ষিণ বন্ড কমিশনারেটের আওতাধীন প্রতিষ্ঠানটি ৩ লাখ ২৯ হাজার ৯১৯ টন চিনি ওয়্যারহাউস থেকে অবৈধভাবে অপসারণ করে, যার প্রমাণ পেয়েছে বন্ড কমিশনারেট। এতে প্রাথমিকভাবে মামলা করা হয়। রায়ে অর্থদণ্ডসহ প্রতিষ্ঠানটির কাছে পাওনা দাঁড়ায় ৬১২ কোটি ২৩ লাখ ১৭ হাজার ৪৪৪ টাকা। পাওনা আদায়ে প্রতিষ্ঠানটির আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম বন্ধের পাশাপাশি ব্যাংক হিসাব জব্দের চিঠি দেওয়া হয়েছে। মোনেমরা এক বা একা নয়। ঘটনাচক্রে এবং লেনদেনের সওদাগরিতে গোলমালের কারণে মোনেম গ্রুপ বেকায়দায় পড়েছে। এই মানের কাণ্ডকীর্তিতে হাত পাকা বিভিন্ন সেক্টরের আরও অনেকেরই।

সেই দাপুটি কমিউনিটির সদস্য তরমুজওয়ালারাও। কিন্তু পণ্যটি দ্রুত পচনশীল হওয়ায় তাদের থামতে হয়েছে। আলুবাজরা দমবে কেন? উৎপাদন মৌসুম শেষ হতে না হতেই আলুর বাজার গরম করে দিয়েছে তারা। গরমের ওপর গরম। আলু এবার মোটা চালকে পেছনে ফেলে দিতে বসেছে। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ-টিসিবির সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, বাজারে প্রতি কেজি মোটা চাল (স্বর্ণা ও চায়না ইরি) ৫০ থেকে ৫২ টাকা। আর রাজধানীতে খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি আলুর দাম এখন ৫০-৫৫ টাকা। রাজধানীর বাজারে ঈদের আগেই আলুর কেজিপ্রতি দাম বেড়ে ৫০ টাকার আশপাশে চলে আসে। ঈদের পরে আরেক দফা দাম বেড়েছে। সামনে আরও বাড়বাড়ন্তের নমুনা স্পষ্ট। এবার কৃষকের কাছ থেকেই বেশি দামে আলু বাজারে এসেছে। হিমাগারে রাখা আলুর দামও বেশি পড়ছে। এ ছাড়া গত বছর আলুর যে সংকট হয়েছিল, তা কাটিয়ে ওঠার জন্য বাড়তি যে উৎপাদন দরকার ছিল, সেটা হয়নি। সামনে আলুর দাম আরও চড়ার লক্ষণ বুঝে সরকার দেশের বাজারে আলুর সংকট নিরসনে এটি আমদানির অনুমতি দিয়ে রেখেছে। কিছু আমদানিকারক সামান্য পরিমাণে আলু নিয়ে আসছেন বলে তথ্য আছে কৃষি বিভাগের কাছে। তারা এবার বিশেষ মওকা পেতে পারে বলে জোর গুঞ্জন এই গরমের বাজারে। তা লাউ-লতি-কচুওয়ালাতেও। তাদের রোখা মুখের কথা নয়।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া খতিয়ে দেখার নির্দেশ

থানায় গিয়ে ওসিকেও পিটাইছি : চেয়ারম্যান প্রার্থী

অডিট অফিসার নেবে মধুমতি ব্যাংক, কর্মস্থল ঢাকা

৩৪ ঘণ্টা পর মিলল হৃদির মরদেহ

ডিন পদ ফিরে পেলেন ঢাবি অধ্যাপক রহমত উল্লাহ

সড়কে যানবাহনের গতিসীমা নির্ধারণ

সন্ধ্যার মধ্যে ৮০ কিমি বেগে ঝড়ের আশঙ্কা

রাফায় হামলার বিষয়ে যা বললেন নেতানিয়াহু

বিশ্ব ফুটবল দিবস ঘোষণা জাতিসংঘের

কুলাউড়ায় ভোট দিলেন চেয়ারম্যান প্রার্থী কামরুল

১০

শ্রমভবনে চারদিন ধরে ড্যানিস নিটওয়্যারের গার্মেন্স শ্রমিকদের অবস্থান

১১

দুই ঘণ্টায় ভোট পড়েছে ১০ শতাংশ : ইসি

১২

ভোটার শূন্য কেন্দ্র, ভোটারদের অপেক্ষায় এজেন্টরা

১৩

১৩৯ উপজেলায় ব্যাংক বন্ধ থাকছে আজ  

১৪

কানাডা ছেড়ে কেন চলে যাচ্ছে মানুষ?

১৫

সব কিছু ধ্বংসের পর আল্লাহ কী করবেন?

১৬

হিলি স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ

১৭

বিশ্ব গাধা দিবস / আজ কেউ গাধা বললে রাগ করবেন না

১৮

আজ ‘বিশ্ব গাধা দিবস’

১৯

বাজার থেকে করোনা টিকা তুলে নিচ্ছে অ্যাস্ট্রাজেনেকা

২০
X