অর্জিতা সূত্রধর
প্রকাশ : ০৪ মে ২০২৪, ০২:৪০ এএম
আপডেট : ০৪ মে ২০২৪, ০৮:২২ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

উচ্চ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে বাড়ছে জনদুর্ভোগ

উচ্চ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে বাড়ছে জনদুর্ভোগ

উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি ও বাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দরিদ্র পরিবারগুলো আরও হুমকির মুখে পড়ছে। সংসারের খরচ চালানো একদম দায় হয়ে পড়েছে। অনেক পরিবারে মাছ খাওয়াও ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ মাংস কবে কেনা হয়েছে, তা তো বলতেও পারবে না বোধহয় সঠিকভাবে। প্রান্তিক অঞ্চলের অনেকেই আবার নির্ভর করে থাকেন নদীপাড় থেকে সংগ্রহ করা শাকপাতা বা এমন সহজলভ্য প্রাকৃতিক খাবারের ওপর। চড়া দামে বাজার থেকে যে কিছু কিনে খাবেন, তাতেও কাহিল অবস্থা তাদের।

সাধারণ শিক্ষার্থীরাও এসব থেকে বঞ্চিত নয়। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সব হলেও এখন প্রতিটি খাবারের দাম ২-৪ টাকা, এমনকি কিছু ক্ষেত্রে ৫-১০ টাকা করেও বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ক্যান্টিনের কর্মচারীদের এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে একটাই উত্তর দিচ্ছে—বাজারে জিনিসের দাম বাড়ছে।

গত বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) আসন্ন বছরগুলোতে তিনটি বিষয়কে অর্থনীতির প্রধান ঝুঁকি হিসেবে নির্ধারণ করে। যার মধ্যে একটি ছিল— উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি। বছরের শুরু থেকেই উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে বিভিন্ন হুমকিস্বরূপ তথ্য প্রকাশিত হলেও বছরের শেষেও মূল্যস্ফীতি প্রায় সাড়ে ৯ শতাংশেই রয়ে গেল। গত বছর জানুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ, যা পরবর্তী সময়ে বেড়ে বছর শেষে প্রায় সাড়ে ৯ শতাংশতে দাঁড়ায় বলে জানায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)।

বিগত বছর থেকেই হঠাৎ বিভিন্ন কারণে পণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে চলে। ফলে অর্থনৈতিক বাজার ব্যবস্থায় নেমে আসে অস্থিরতা। মাছ, মাংস, ডিম, আলু, চিনি, পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ ইত্যাদি সব ভোগ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির দরুন সাধারণ জনগণ ক্রমেই ভোগান্তির শিকার হয়। বাঙালির প্রধান খাদ্য চালের পাশাপাশি তেল, সাবান, শ্যাম্পু, স্যান্ডেল ইত্যাদি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামও বেড়ে চলে। এ ছাড়া শিক্ষা, চিকিৎসা, পরিবহনসহ প্রতিটি খাতেই খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। ওই প্রসঙ্গেই আমার এক শ্রমিক চাচা সেদিন তার এক পরিচিত রেস্তোরাঁর কথা জানান, যেখানে তিনি দুপুরবেলা ৫৫ টাকায় কোনোমতে অল্প ভাত আর মাছ দিয়ে খেয়ে নিতে পারতেন। সেই খাবারের দাম বেড়ে এখন ৭০ টাকা হয়ে গেছে। পরে অগত্যা তিনি ৪০ টাকায় শুধু ডাল-ভাত খেয়ে এলেন আর এখন প্রতিদিন এই খাবারই তার নিত্যসঙ্গী হয়ে গেছে। কারণ মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের অনেক হিসাব করে চলতে হয় কি না। চালের দামও বাড়ছে, মাছের দামও বাড়ছে; এর ফলে মাছে-ভাতে বাঙালি যদি মাছ-ভাতই কিনে খেতে না পারে—সেটা নিয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করেন তিনি।

কৃষক-শ্রমিক-মজুর ইত্যাদি যাদের কাঁধে ভর দিয়ে আমাদের দেশ দাঁড়িয়ে আছে, মূল্যস্ফীতির ফলস্বরূপ তাদেরই প্রতিনিয়ত বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এসব পরিপ্রেক্ষিতেই বাংলাদেশ ব্যাংক এই বছরের ১৭ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ কর্মসূচির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সর্বশেষ মুদ্রানীতি ঘোষণা করে।

ওই নতুন নীতিতে মূল্যস্ফীতি ঠেকাতে বেশ কয়টি উদ্যোগ নেওয়ার কথা উল্লেখ আছে। যেমন—নীতি সুদ হার ৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৮ শতাংশ করা, বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা বিদ্যমান ১১ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা। এ ছাড়া মুদ্রার বিনিময় হারের অস্থিরতা রোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও ‘ক্রলিং পেগ’ নীতি গ্রহণ করেছে। চলতি অর্থবছর শেষে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৭ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

কিন্তু তারপরও কি কমছে এর হার? উপরন্তু শুধু বৃদ্ধিই নজরে পড়ছে। এবার রমজান মাসে এসব সমস্যা তো আরও বেড়ে যায়। জনজীবনও বেশ অস্থির হয়ে পড়ে। অথচ সরকার যথাসময়ে অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে সফল হতে পারেননি। ঈদের মধ্যেও পরিবারের সদস্যদের মুখে হাসি ফোটাতে পারেননি অনেকেই। তার কারণ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কারণ হিসেবে আমাদের দেশে বিদ্যমান এ অস্থিতিশীল অর্থনৈতিক অবস্থাকেই দায়ী মনে করেন বেশিরভাগ জনগোষ্ঠী।

গত এপ্রিল মাসেও দেশের এ বিদ্যমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতি কঠোর করা ও নিত্যপণ্যের শুল্ক কমানোর পরামর্শ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, এক বছর ধরেই সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে আছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে নিম্ন আয়ের মানুষ চাপে আছে বলে মনে করে বিশ্বব্যাংক।

বিশ্বব্যাংকের মূল্যায়নে, দেশে বিরাজমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রধান তিন কারণ হলো—টাকার অবমূল্যায়ন, ডলার সংকটে আমদানি নিয়ন্ত্রণ এবং জ্বালানি সংকট ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি।

এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর আবদৌলায়ে সেক বলেন, কঠোর মুদ্রানীতির মাধ্যমে, জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় প্রক্রিয়ায় নতুন কৌশল অবলম্বনে, রপ্তানি খাতে ভর্তুকি কমানো ইত্যাদির মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ হতে পারে।

চলমান মে মাস থেকে বাংলাদেশ সরকার উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে গৃহীত পদক্ষেপগুলো সফলভাবে বাস্তবায়নে সচেষ্ট থাকবে বলে আশাবাদী। কারণ দিনশেষে সর্বোচ্চ ভোগান্তি আমরা ও আমাদের দেশেরই হচ্ছে। এজন্য সরকার ও সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। নিজেদের নৈতিক মূল্যবোধ ঠিক রেখে অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় দুর্নীতি কমাতে হবে। যত দ্রুত সম্ভব বাজার ব্যবস্থায় সুশাসন আনা এখন খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জনগণের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি না হওয়ার দরুন সবাইকেই বিশেষত নিম্ন আয়ের মানুষদের বেশি চাপে পড়তে হচ্ছে। এক বা একাধিক শ্রেণিকে অবহেলা বা ভোগান্তিতে রেখে অথবা শুধু এক বা নির্দিষ্ট কিছু শ্রেণিকে নিয়ে দেশের উন্নতি সম্ভব নয়। অতএব, কার্যকরভাবে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দেশের সব স্তরের জনগণের কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিরও যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করুক—এটাই প্রত্যাশা।

লেখক : গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ,

তৃতীয় বর্ষ (সম্মান), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

জেমকন গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা কাজী শাহেদ আহমেদের মৃত্যুবার্ষিকী বৃহস্পতিবার

আরও ৪ দেশে এনআইডি কার্যক্রমের অনুমতি

ব্রাজিল দলে জায়গা না পেয়ে নেইমারের রহস্যময় বার্তা

বদনজর ও কালো জাদুর ক্ষতি থেকে বাঁচার ৫ আমল

বিশ্বকাপজয়ী মেসিকে নিয়ে মিলল সুসংবাদ

চিকন শিশুকে মোটা বলায় সংঘর্ষ, আহত ১০

চিরকুট লিখে প্রাণ দিলেন ব্যবসায়ী

প্রকৌশল শিক্ষার্থীদের দাবি পর্যালোচনায় কমিটি গঠন

আফগানিস্তানে যাত্রীবাহী বাস উল্টে নিহত কমপক্ষে ২৫

প্রধান শিক্ষক যুবলীগ নেতা, ফাঁদে পড়ে ইংরেজি শিক্ষক গরুর রাখাল

১০

প্রতীকী মূল্যে মসজিদ-মন্দিরকে জমি দিয়ে ইতিহাস গড়ল রেলওয়ে

১১

নওগাঁয় চালককে হত্যা, পাঁচজনের যাবজ্জীবন

১২

শাহরুখ না, শাকিবকে নায়ক হিসেবে চান মনিকা

১৩

শেখ হাসিনাও তত্ত্বাবধায়ক সরকার চান, ভূতের মুখে রাম নাম : অ্যাটর্নি জেনারেল

১৪

ত্রিদেশীয় সিরিজের জন্য দল ঘোষণা, ফিরেছেন জুনায়েদ সিদ্দিক

১৫

ভিকির মতো শান্ত মানুষ সাইকো থ্রিলার ভাবেন কীভাবে, প্রশ্ন নাবিলার

১৬

চন্দ্রনাথ পাহাড় ঘিরে উসকানিমূলক কিছু দেখামাত্র ব্যবস্থার নির্দেশ

১৭

আবুল খায়ের গ্রুপে মার্কেটিং অফিসার পদে নিয়োগ

১৮

পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ে নিয়োগ, আজই আবেদন করুন

১৯

রাজনীতিতে শিষ্টাচার-শুদ্ধাচারের আবশ্যকতা 

২০
X