কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০৬ মে ২০২৪, ০২:২১ এএম
আপডেট : ০৬ মে ২০২৪, ০৭:৩১ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

জাদুর শহর জঞ্জালের শহর

মাহতাব উদ্দিন
মাহতাব উদ্দিন। সৌজন্য ছবি
মাহতাব উদ্দিন। সৌজন্য ছবি

যারা ঢাকা বিমানবন্দর থেকে উড়োজাহাজে চড়ে কোথাও গিয়েছেন, তারাই দেখবেন আমাদের ঢাকার চারপাশে অনেক সবুজ জায়গা, শুধু মাঝের অংশে কিছু নেই—খালি ইট, পাথর। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে Urban Economics (শহুরে অর্থনীতি) পড়িয়েছি। খুব সহজ ভাষায় বললে, আমাদের ঢাকার vertical expansion হয়েছে। এর বড় কারণ আমাদের ঢাকার গণপরিবহনের অবস্থা যা ইচ্ছে তাই।

মতিঝিলের একজন চাকরিজীবী খুব অনায়াসেই তার আবাসস্থল হিসেবে বেছে নিতে পারতেন গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, সাভার, নরসিংদী কিংবা মানিকগঞ্জ। কিন্তু বেশিরভাগই কেন নেন না? একটা বড় কারণ যাতায়াত। যারা ঢাকা-গাজীপুর দৈনিক অফিস করেন, তারাই জানেন কী আজাবের মধ্য দিয়ে তাদের দৈনিক পার হতে হয়। মাত্র ৩০ কিলোমিটার পার হতে এখানে লাগে তিন ঘণ্টা। এ ছাড়া ঢাকার বাইরে ঢাকার মতো ভালো স্কুল নেই। ভালো কোচিং সেন্টার বা টিচার নেই। ভালো হাসপাতাল নেই। তাই যত কিছুই হোক, আমরা কোনোমতে মাথা গোঁজার ঠাঁই হলেও ঢাকায় থাকতে চাই।

ঢাকার এখন যে অবস্থা, তাতে এই শহর কীভাবে টিকে আছে, সেটা একটা বিস্ময়। একটু বৃষ্টি হলেই কোমর পরিমাণ পানি উঠে যায়। রাস্তায় বের হতে ভয় লাগে। জীবনে বহুবার এ রকম কোমরসমান পানি দোয়া পড়তে পড়তে পাড়ি দিয়েছি। রিকশা হলে গদির ওপর পা তুলে দিয়েছি আর দোয়া করেছি, ‘এই রিকশার চাকা যেন গর্তে না পড়ে।’ আশপাশের বহু রিকশা সহজেই খোলা ম্যানহোলের ঢাকনার গর্তের আবর্তে পড়তে দেখেছি। গাড়িতে হলে মনে মনে দোয়া করেছি, ‘আল্লাহ, গাড়ির ইঞ্জিন তুমি এই পানির মধ্যে বন্ধ করো না।’ অনেক সময় পানিতে গাড়ির বনেট ডুবে গেছে, প্রায় ডুবন্ত অবস্থায় সাঁতার কাটতে কাটতে গাড়ি জ্যামের রাস্তা পাড়ি দিয়েছে।

তাই ঢাকায় বৃষ্টি হলে একদিকে যেমন ভালো লাগে, আরেকদিকে ভয় লাগে, ‘রাস্তায় কী আজাবে পড়তে হয়।’ সস্ত্রীক অফিস থেকে ফেরার সময় বহুদিন বৃষ্টিস্নাত ঢাকার রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকার অভিজ্ঞতা আছে। দু-এক দিন যানজট রোমান্টিক লাগলেও এটাই যখন নিয়ম হয়ে যায়, তখন আর রোমান্স থাকে না।

ঢাকার অনেক জিনিসই খারাপ। (এত খারাপের মধ্যেও এই শহরকে আমি নিজেও জাদুর শহর বলি—আমার/আমাদের মতো এত রোমান্টিক/ইমোশনাল ব্যক্তি/জাতি খুব কমই আছে)। এ রকম আরেকটা খারাপ জিনিস, আমাদের শহরে কোনো গাছ নেই। বাসার পাশে, এমনকি অনেক আবাসিক এলাকায় কোনো পার্ক নেই। স্ত্রীর সঙ্গে রাগ করে যে পার্কে গিয়ে বসে থাকবেন, সেই উপায়ও নেই। বাচ্চাদের খেলার জায়গা নেই। খেলার জায়গা বলতে আছে টগি ওয়ার্ল্ড, বাবুল্যান্ড, টুনটুন আরও কী কী। সবই বিল্ডিংয়ের ভেতরে, পয়সা দিয়ে ইনডোর প্লের জায়গা। খালি জায়গায় পার্ক না বানিয়ে আমরা এখন শিশুদের বিনোদন খুঁজছি বিল্ডিংয়ের ভেতরে কৃত্রিম খেলার জায়গায়। শহরে এত বিল্ডিং এখন আর এতই গাছের আকাল যে, গরমের দিনে আমরা খুঁজি বিল্ডিংয়ের ছায়া; গাছের ছায়ার নাম-গন্ধও নেই।

আমার বদ্ধ ধারণা, ঢাকার অবস্থা এখন এমন, দুই দিন পর বাচ্চাকাচ্চাকে গাছের ছবি দেখিয়ে বলতে হবে, ‘এটা গাছ। এটা অক্সিজেন দেয়। এর গায়ের রং খয়েরি, পাতার রং সবুজ।’ অনেকটা মুখস্থ গরুর রচনার মতো—বাচ্চারা গাছ দেখবে ছবির বইয়ে, কিংবা ইউটিউবে। ঢাকার যেই অবস্থা, অনেক বাচ্চা জোছনা রাত বলে কিছু আছে, সেটা জানে কি না, আমার সন্দেহ। ঢাকায় হাজার হাজার বিল্ডিং আছে, যেখানে সূর্যের আলোর সাধ্য নেই বছরে একবার মুখ দেখানোর। চাঁদ আর তারা অনেকের কাছেই হবে বইয়ে দেখা বস্তু। এ কথা বলার একটা বাস্তবিক ও যৌক্তিক কারণ আছে। আমার এক বন্ধুর ভাইয়ের ছেলের ছোটবেলায় ধারণা ছিল, মুরগি ফ্রিজে পাওয়া যায়। জীবনে জ্যান্ত মুরগি না দেখে ঢাকার অনেক সন্তানই এখন এরকম। ঢাকায় বেড়ে ওঠা বাচ্চাদের জন্য আমার অসম্ভব মায়া লাগে। স্কুলগুলোয় গাছ নেই, খেলার মাঠ নেই, পিটি বা প্যারেড করার মতো কোনো জায়গা নেই। অনেক বাচ্চার স্কুলে দেখেছি, তারা সকালের পিটি করায় তাদের স্কুলের নিচতলায়, যেটা কি না একটা গ্যারেজ। তারপর বাচ্চাগুলো সারা দিন খোঁয়াড়ে বন্দি মুরগির মতো স্কুলের কংক্রিটের দেয়ালের মধ্যে আটকে থাকে। যেই শিক্ষায় প্রাণের ছোঁয়া নেই, সেই শিক্ষা আর যাই তৈরি করুক, পরমতসহিষ্ণু মমতায় আদর্শ মানুষ কতটুকু তৈরি করবে, সেটা নিয়ে আমার ব্যাপক সন্দেহ আছে।

বিদেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় তফাত, বিদেশের রাজধানী বা বড় শহরগুলোও সবুজ। কিছুক্ষণ পরপর একটা না একটা পার্ক আপনি পাবেনই পাবেন। সারা দিন পর সন্ধ্যায় কিংবা সকালবেলা নির্মল বায়ুতে হাঁটলে আয়ু বাড়ে বৈকি। অনেক দেশই তাই তাদের শহরের রাস্তাঘাট কমিয়ে পার্ক বাড়ানোয় জোর দিয়েছে। ঢাকা শহরে আরও বেশি বেশি গাছ লাগানো দরকার। যেখানেই জায়গা আছে, গাছ লাগান। বাংলাদেশের মাটির এক আশ্চর্য গুণ হলো, এই মাটিতে আপনার খুব বেশি পরিচর্যা লাগে না। আপনি একটা গাছ আপনার জমিতে লাগিয়ে দিন, বছরান্তে দেখবেন কী সুন্দর সেই গাছ আপনার যত্ন ছাড়াই তরতর করে বেড়ে গেছে। বোনাস হিসেবে ফ্রি ফ্রি একগাদা ফল পাবেন।

কিন্তু এত কিছুর পরও শুধু ব্যক্তি প্রয়াস থেকে ঢাকার সমস্যার সমাধান অসম্ভব। এত কথার শেষ কথা সেটাই। অর্থনীতিতে একটা প্রবাদ আছে, ট্র্যাজেডি অব কমন্স, যার মূল সারসংক্ষেপ হচ্ছে, সব সময় জনগণের বা বাজারের হাতে সব কিছু ছেড়ে দিলে তার ফল শুভ হয় না। মানুষ স্বভাবগতভাবে লোভী। তাই অক্সিজেন, যেটা কিনতে পয়সা লাগে না, এর চেয়ে তার কাছে বাড়ির ভাড়া, যেটায় তার আয় বাড়ে, সেটাই চাইবে। আর এখানেই সরকারের গুরুতর ভূমিকার অবকাশ আছে।

তাই ব্যক্তিপর্যায়ের চেয়েও বড় ভূমিকা রাষ্ট্রের কাছ থেকে প্রয়োজন। যেসব বাসাবাড়ি গাছ লাগানোর জন্য বাড়ি করার সময় আলাদা জায়গা ছেড়ে দেবে, তাদের কর রেয়াতের সুযোগ দিন। প্রতিটি মহল্লায় প্রয়োজন অনুযায়ী মাঠ প্রস্তুত করুন। দরকার পড়লে জমি অধিগ্রহণ করে পার্ক প্রস্তুত করুন। যেসব পার্ক এখন আছে, উন্নয়নের নামে সেসব পার্কে কংক্রিটের জঞ্জাল না বানিয়ে পরিকল্পনা মাফিক আরও গাছ লাগান। আধুনিক বিশ্বে এখন আর কেউ ‘উন্নয়ন’ নিয়ে মাথা ঘামায় না। এখনকার যুগটাই টেকসই উন্নয়নের। অট্টালিকার উন্নয়নের পাশাপাশি অনেক সবুজ গাছ লাগানোর উদ্যোগ তাই অবশ্যম্ভাবী।

ঢাকাবাসী প্রতিদিন বুক ভরে বিশুদ্ধ বাতাস নেবে, বিকেলে তাদের সন্তানদের খেলার জন্য একটুকরো পার্ক থাকবে, বৃষ্টির দিনে কোমর পানি পেরিয়ে অফিস যেতে হবে না, আর গরমের দিনেও রাস্তায় গাছের ছায়া থাকবে—এসব শুনলে কেন মনে হবে যে, এটা পাগলের প্রলাপ বা অলীক স্বপ্ন? এটাই তো হওয়ার কথা! সেটাই যেন হয়, মেয়ররা সেটাই যেন দেখেন, সেই প্রার্থনা থাকবে।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পিএইচডি গবেষক ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটি, ইউকে

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

রাঙামাটিতে চলছে ইউপিডিএফের আধাবেলা অবরোধ

পায়ুপথে ব্রাশ দিয়ে বখাটেদের নির্যাতন

রাইসির হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত : কোনো আরোহী বেঁচে নেই

রাইসি মারা গেলে কে হবেন ইরানের নতুন প্রেসিডেন্ট?

হবিগঞ্জে ধান সংগ্রহের শুরুতেই হযবরল

আইপিএলে প্লে-অফে কে কার বিরুদ্ধে লড়বে?

তুর্কি ড্রোনে খোঁজ মিলল রাইসির হেলিকপ্টারের

ইরানের প্রেসিডেন্ট কি বেঁচে আছেন? 

খোঁজ মিলল রাইসির হেলিকপ্টারের, দুর্ঘটনাস্থল থেকে ২ কিমি দূরে উদ্ধারদল

পেকুয়া উপজেলা নির্বাচন / পড়ালেখায় এগিয়ে সজিব, অর্থসম্পদে আবুল কাসেম

১০

রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টারটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি

১১

‘রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টারের খোঁজ পাওয়া গেছে’

১২

কোরবানির ঈদকে ঘিরে স্বপ্নপূরণের আশা খামারিদের

১৩

দুই বোনকে হাতুড়ি দিয়ে পেটানো ছাত্রলীগ নেতা পায়েল বহিষ্কার

১৪

বন্ধুর বাড়ি থেকে যুবকের হাত-পা বাঁধা লাশ উদ্ধার

১৫

রাইসির ঘটনায় উচ্ছ্বসিত মার্কিন সিনেটর

১৬

সোমবার রাজধানীর যেসব এলাকায় যাবেন না

১৭

প্রবাসীর স্বর্ণ ছিনিয়ে পালাচ্ছিলেন পুলিশ সদস্য

১৮

রাইসিকে উদ্ধারকাজে বিশেষজ্ঞ দল পাঠাচ্ছে রাশিয়া

১৯

রাইসিকে উদ্ধারের সর্বশেষ অবস্থা জানাল ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়

২০
X