মহসীন হাবিব
প্রকাশ : ০৭ মে ২০২৪, ০২:৩৮ এএম
আপডেট : ০৭ মে ২০২৪, ০৯:১০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ডেমু ট্রেনের ঘটনা অবশ্যই কেলেঙ্কারি!

ডেমু ট্রেনের ঘটনা অবশ্যই কেলেঙ্কারি!

বাংলাদেশের মানুষের অর্থ বড়ই কষ্টার্জিত। মাথার ওপর ঋণের বোঝা, হাড়ভাঙা পরিশ্রম করা রেমিট্যান্স, পৃথিবীর সবচেয়ে কম মজুরির গার্মেন্টস রপ্তানি, মূল্যবান জীবনের আয়ু বিলিয়ে জাহাজ ভাঙা—অতঃপর সরকারের রাজস্ব আদায়। এ রাজস্ব আয়, শর্তসাপেক্ষে পাওয়া ঋণ ও অনুদান একটি সরকার বিভিন্ন খাতে ব্যবহার করে থাকে। এর মধ্যে অন্যতম হলো উন্নয়ন ও সেবা খাত। একটি সরকার যখন কোনো প্রকল্প গ্রহণ করে, তখন সেই প্রকল্পে অর্থের সর্বোচ্চ ব্যবহার করবে তেমনটাই প্রত্যাশিত। যতটা সম্ভব স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও দক্ষতার সঙ্গে কার্যসম্পন্ন করবে। কিন্তু বাংলাদেশে যা চলছে তা শুধু লুটপাটই নয়, দায়িত্বজ্ঞানহীনতারও চরম বহিঃপ্রকাশ। আজ শুধু একটি বিষয় বলব, তাতেই মাথা ঘুরে যাবে। আমার নিজেরই সব খুঁটে দেখতে গিয়ে মাথা ঘুরে গেছে। তবে সব খবর তো আর কাগজে-কলমে থাকে না, অন্ধকারেও থাকে অনেক কিছু, যা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের দ্বারা উদঘাটন সম্ভব নয়। এজন্য যে পেশাদার সংস্থাগুলো আছে তাদের সদিচ্ছা, তাদের প্রতি নির্দেশ দরকার হয়। আমরা শুধু অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে ঘেউ ঘেউ করতে পারি।

বলছিলাম ডিজেল ইলেকট্রিক মাল্টিপল ইউটিন বা ডেমু ট্রেনের কথা। প্রথম ২০১১ সালের ৪ আগস্ট বাংলাদেশের তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন এবং চীনের রাষ্ট্রদূত ঝ্যাংজিয়ান ৫৮.৩ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে ২০টি মিটারগেজ ডেমু ট্রেন আমদানির একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। চুক্তিতে কম্পোন্যান্ট, স্টাফ ট্রেইনিং ও মেইনটেন্যান্স; অর্থাৎ যন্ত্রাংশ, স্টাফদের প্রশিক্ষণ এবং রক্ষণাবেক্ষণের কথাও অন্তর্ভুক্ত ছিল। ট্রেনগুলো কেনা হয়েছিল চীনের হেবেই প্রদেশের সিএনআর থাঙ্কসান কোম্পানির কাছ থেকে। তিন কোচবিশিষ্ট এ ট্রেনের ধারণক্ষমতা ৩০০ যাত্রী এবং সর্বোচ্চ গতি ৮০ কিলোমিটার। সে অনুযায়ী ২০১৩ সালে বাংলাদেশে প্রথম ডেমু ট্রেন যাত্রা শুরু করে। ট্রেনগুলো ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ এবং চট্টগ্রামে ব্যবহারের জন্য কেনা হয়েছিল। এ ডেমুর ইঞ্জিনের বয়সকাল ধরা হয়েছিল ২০ বছর এবং ওয়াগনের বয়স ৩৫ থেকে ৪৫ বছর। কিন্তু মাত্র ৫-৬ বছরের মধ্যে সব ট্রেন সম্পূর্ণরূপে অকেজো হয়ে এখন পড়ে আছে। সব ট্রেন ওয়ার্কশপে পড়ে আছে। টেলিভিশনের রিপোর্টে দেখা গিয়েছে, ঘন জঙ্গলে ঢেকে আছে, জং ধরে গেছে ট্রেনের যন্ত্র ও বডিতে। রেলওয়ের আনুষ্ঠানিক বক্তব্যে বলা হচ্ছে—দুটি ট্রেন চলছে, কিন্তু বাস্তবে একটিও চলছে না বলে জানা গেছে।

৫-৬ বছরও বাঁচল না? রহস্য কী? চীনের এ ডেমুগুলোতে যে সফটওয়্যার ও যন্ত্রাংশ ব্যবহার করা হয়েছে, তা ব্যবহারের লোক বা দক্ষ কর্মচারী বাংলাদেশের নেই। এই ডেমু যখন চলত তখন হঠাৎ করেই রাস্তায় বন্ধ হয়ে যেত। বিভিন্ন সময় এগুলো চালু রাখতে আরও ৩০ কোটি টাকার অধিক ব্যয় করেছে রেলওয়ে। রেলওয়ের হিসাব অনুযায়ী, এ বিশাল অঙ্কের ব্যয়ে ক্রয় করে এবং চালু রাখতে রেলের সর্বমোট আয় হয়েছে ২২ কোটি টাকা। অর্থাৎ পুরোটাই পানিতে গেছে। পত্রিকান্তরে সংবাদ বের হয়েছে, ডেমু কিনতে ৪৮ লাখ টাকা ব্যয় করে আটজন কর্মকর্তাকে চীনে পাঠানো হয়েছিল ডেমুর কার্যকারিতা দেখতে। এ পরিদর্শনে যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে রেল ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা ছিলেন। প্রকল্পের টাকায় ছয়জন প্রকৌশলীকে চার মাসের প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হয়েছিল, যেখানে ব্যয় হয়েছে ১ কোটি টাকা। এর কোনো কিছুই কাজে লাগল না? রেলওয়ে সূত্রই সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছে, ট্রেনগুলোর মান ভালো ছিল না! খোদ রেলওয়ের মহাপরিচালক বলেছেন, এ ট্রেন কেনার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। এই ভুল কেমন ভুল? ভুল একজন মানুষ করতে পারেন এবং সেটা হঠাৎ হয়ে যায়। এত মানুষ রেল দেখতে গেলেন, এত মানুষ পরিকল্পনার সঙ্গে রইলেন, তারা সবাই ভুল করলেন? এ ভুল কি ইচ্ছাকৃত ভুল নয়?

দুঃখের বিষয়, এজন্য সংশ্লিষ্ট কোনো কর্মকর্তার কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়নি। জানামতে, কোনো তদন্ত কমিটিও করা হয়নি। আরও অদ্ভুত বিষয় হলো, এই ডেমু ট্রেন মেরামতের কোনো ওয়ার্কশপ নেই দেশে। কে এখন এই প্রশ্নের জবাব দেবে যে কেন কেনা হলো এবং কেনাই যখন হলো তখন মেরামতের কোনো ওয়ার্কশপ গড়ে তোলা হলো না কেন? আরও দুঃখজনক হলো, চীনের কোম্পানি বিক্রি করে দিয়েই খালাস। তারা এগুলো রক্ষণাবেক্ষণ অথবা পরিচালনায় সামান্য ভূমিকা রাখেনি। চার মাস যারা ট্রেনিং নিয়েছেন ডেমুর সফটওয়্যারগুলো বুঝতে, তারা কোথায়?

ডেমু ট্রেন বিশ্বের বড় বড় দেশে চলে। বেলজিয়াম, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য থেকে শুরু করে ভারতেও চলছে। আমি ইন্টারন্যাশনাল রেলওয়ে জার্নাল থেকে শুরু করে নানা রেলওয়ে সংক্রান্ত সংবাদ ঘেঁটে দেখেছি। কোনো দেশের ডেমুর এমন নাজেহাল অবস্থা কখনো হয়নি। শুধু এই দরিদ্র, হতভাগ্য দেশের ছাড়া! ১৯৫৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে যে ট্রেন আমদানি করা হয়েছিল, তা এখনো সচল আছে, ১৯৮০ সালে জার্মানি থেকে যে ট্রেন আনা হয় তাও এখনো বহাল তবিয়তে রেলসড়কে সচল রয়েছে। অথচ বেলুনের মতো চুপসে গেল চীন থেকে আনা এই ডেমু? এখন শোনা যাচ্ছে, এগুলো আবার মেরামতের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। আল্লাহ মালুম এবার কী হবে!

চীন নিয়ে অনেক গল্প চালু আছে, সত্য-মিথ্যা জানি না। বলা হয় চীনে নাকি একই আইটেমের নানা ধরনের মান থাকে। যারা ক্রয় করতে যান তাদের জিজ্ঞেস করা হয়, আপনি কত টাকা মধ্যে চান? মোবাইল ফোনের কথাই ধরি। ২ হাজার থেকে শুরু করে দুই লাখ টাকার মোবাইল আছে। সেগুলো চীনাদের মতোই দেখতে সব একইরকম। তবে চীনারা খুবই ‘রসিক’। যারা সেখানে যান তাদের নাকি বাজিয়ে দেখেন। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের সরকারি কর্মকর্তাদের পেলে তো কথাই নেই। কোম্পানিগুলোর নানা লেভেলের সুন্দরী কর্মচারীরা নানা পার্সেন্টেজ বুঝিয়ে দিতে বড়ই পারদর্শী। আর তৃতীয় বিশ্বের সরকারি কর্মচারীরাও তো এখন আর কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো বোকা নেই যে, সরকারি কাজে চীন সফরে গিয়ে খালি হাতে ফিরে এসে চীনযাত্রী নামে সুখপাঠ্য বই রচনা করবেন। আমি এক সরকারি কর্মকর্তাকে বলতে শুনেছি, একবার সরকারি ক্রয়ে চীন যেতে পারলে জীবনে আর কিছু লাগে না, পেনশনের টাকা না পেলেও ক্ষতি নেই!

আমাদের সহজ একটি প্রশ্ন—দেশের মানুষের এই কষ্টের টাকা যেসব কর্মকর্তা নষ্ট হতে দিয়েছেন, তাদের কি কোনো জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতে হয়েছে? জানি, চীনা কোম্পানিগুলোর সঙ্গে কোনো আঁতাত হয়ে থাকলে তা বের করার ক্ষমতা বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন সংস্থার নেই। কারণ পেমেন্ট বা ইনভয়েসিংয়ে কোনো ফাঁকফোকর থাকার কথা নয়, কেউ রাখে না। কিন্তু বিকল্পও তো আছে। যেমন আপনার বাসার পাশের একটি ব্যাংকে ডাকাতি হলো। কয়েক দিনের মধ্যে দেখলেন, পাশের কয়েকটি বেকার হতদরিদ্র যুবক ছেলে ভারী সোনার চেইন, দামি মোটরসাইকেল কিনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আপনার কি ওই টাকার উৎস সম্পর্কে আর কোনো সন্দেহ থাকবে? এতক্ষণ ইনিয়ে-বিনিয়ে বললাম, এখন সোজা কথায় বলি। ডেমু ট্রেন কেনায় চীনা কোম্পানির সঙ্গে কোনো না কোনো মহলের যোগসাজশে যে বিশাল অনিয়ম হয়েছে, এতে কোনোরকম সন্দেহ নেই। তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম অদক্ষতার কারণে হয়েছে, তাতেও যারা জড়িত তাদের শাস্তি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। কারণ যে কোনো অফিস, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান অদক্ষ লোক দিয়ে চালানোর চেয়ে দক্ষ চোর দিয়ে চালানো শ্রেয়। এই ডেমু ট্রেন ক্রয়ে যারা জড়িত ছিলেন তারা বিশ্বাস ভঙ্গ করেছেন, কর্তব্যে অবহেলা করেছেন, অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। সরকারের উচিত ডেমু মেরামতের আগে এদের মেরামত করা! তা না হলে এমন ডেমুর ঘটনা ঘটতেই থাকবে। আমরা চাই ডেমুর ঘটনাকে একটি কেলেঙ্কারি, একটি স্ক্যাম হিসেবে সরকার বিবেচনা করুক। বড়ই কষ্ট হয়। আমাদের কষ্টার্জিত অর্থ এভাবে ফানুসের মতো উড়ে যাবে!

লেখক: সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ইরানের প্রেসিডেন্টের দুর্ঘটনাস্থল থেকে মিলল সংকেত

কেন এত সময় লাগছে অনুসন্ধানে

টানা চারটি লিগ জয়ীদের এলিট ক্লাবে ম্যানসিটি

হেলিকপ্টার পাওয়ার বিষয়ে যা জানাল রেড ক্রিসেন্ট

রাইসির সঙ্গে হেলিকপ্টারে আর যারা ছিলেন

উন্নয়নের নামে রাতের আঁধারে শাহবাগে গাছ কাটার অভিযোগ

সবশেষ বিহারে ছিলেন এমপি আনার

‘অভিবাসী কর্মীদের জন্য আরও টেকসই ভবিষ্যৎ নির্মাণে কাজ করছে সরকার’

ইরানের প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিখোঁজ, যা বলছে যুক্তরাষ্ট্র

স্বামীর মোটরসাইকেলের চাকায় ওড়না পেঁচিয়ে নারীর মৃত্যু

১০

তবুও প্রার্থী হলেন সেই নাছিমা মুকাই 

১১

গাজীপুরে কারখানার ১০ তলার ছাদ থেকে লাফিয়ে নারী শ্রমিকের মৃত্যু

১২

রাজশাহীতে আগুনে পুড়ে ছাই ১০ বিঘার পানের বরজ

১৩

বিয়েবাড়ি থেকে কনের পিতাকে তুলে নিয়ে টাকা দাবি

১৪

ঠাকুরগাঁওয়ে নির্বাচনী অফিস ভাঙচুর , এলাকায় উত্তেজনা

১৫

ঈশ্বরদীতে ফেনসিডিলসহ রেল নিরাপত্তা বাহিনীর সিপাহি আটক

১৬

এমপি আনোয়ার খানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ওসিকে নির্দেশ

১৭

উপজেলা নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপে ১১৬ কোটিপতি প্রার্থী : টিআইবি

১৮

রাইসির জন্য দোয়ার আহ্বান

১৯

‘শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সুদৃঢ় হয়েছে’ 

২০
X