কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২৮ মে ২০২৪, ০২:৪০ এএম
আপডেট : ২৮ মে ২০২৪, ০৭:৫২ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
মহসীন হাবিবের নিবন্ধ

ক্রস বর্ডার ক্রাইম ও প্রাসঙ্গিক শঙ্কা

ক্রস বর্ডার ক্রাইম ও প্রাসঙ্গিক শঙ্কা

সম্প্রতি বাংলাদেশের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার কলতাকাতার একটি ফ্ল্যাটে খুন হয়েছেন। খুন অবশ্য বাংলাদেশের মানুষদের হাতেই হয়েছেন, সেটা নিশ্চিত হওয়া গেছে। নিঃসন্দেহে ঘটনাটি চাঞ্চল্যকর ও স্পর্শকাতর। এই প্রথম বাংলাদেশের কোনো সংসদ সদস্য বা রাজনীতিক ভারতে গিয়ে স্বদেশিদের হাতে খুন হলেন। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখে দুই দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভূতপূর্ব সহযোগিতা চালিয়ে যাচ্ছে। ভারতে গুরুত্বপূর্ণ লোকসভা নির্বাচনের সময় এ ঘটনাটি তারা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। অবশ্য বাংলাদেশের পুলিশই সুতোর আগা খুঁজে বের করেছে এ দেশে বসেই। কিন্তু কোথায়, কীভাবে, কেন, কখন খুন হয়েছেন—সব দুই দেশের পুলিশের সমন্বিত প্রচেষ্টায় একে একে বের হয়ে আসছে। এ হত্যাকাণ্ডের পুঙ্খানুপুঙ্খ বুঝতে এবং আরও তদন্তের স্বার্থে এরই মধ্যে ভারতীয় পুলিশ দল বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের পুলিশ দল কলকাতায় সফর সেরেছেন। ভালো কথা। দুই দেশের কাজ করার যথেষ্ট সুযোগও আছে, যেহেতু দুই দেশের মধ্যে একটি বন্দিবিনিময় চুক্তিও আছে। ২০১৩ সালে চুক্তিটি চূড়ান্ত রূপ পায়। ওই চুক্তির অধীনে অনুপ চেটিয়াকে ভারতে ফেরত পাঠানো হয় এবং দিল্লিতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত বাদল ফরাজিকে ঢাকায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়। সুতরাং বন্দিবিনিময় নিয়েও কোনো জটিলতা নেই। চাইলে বাংলাদেশ অথবা ভারত চাহিদামতো বন্দি আনা-নেওয়া করতে পারবে। যদিও বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যে এক্সট্র্যাডিশন ট্রিটি রয়েছে, তার ধারা-উপধারাগুলো পড়লেই বোঝা যায় যে, এই চুক্তি বাস্তবায়ন নির্ভর করে সম্পূর্ণ দুই দেশের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর। পড়ে দেখেছি, ধারা-উপধারাগুলো এমনভাবে রয়েছে যে, দুই দেশের যে কোনো একটি দেশ অসহযোগিতা করলে আর এক্সট্র্যাডিশন ট্রিটিটা কার্যকর থাকবে না। এ চুক্তিই সুযোগ করে দিয়েছে দুই দেশের মধ্যে বন্দিবিনিময়ের। যেমন বাদল ফরাজি নির্দোষ বলে একটি দাবি আছে। দিল্লির অমর কলোনিতে ২০০৮ সালের মে মাসে এক বৃদ্ধাকে হত্যার অভিযোগ আনা হয় বাদল সিং নামে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে। ওই বছর ২১ জুলাই বাদল ফরাজি বাংলাদেশ থেকে ভারতে প্রবেশ করলে তাকে ওই হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়। যদিও বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশন থেকে বৈধভাবে ভিসা নিয়েই তিনি ভারতে প্রবেশ করেছিলেন। দিল্লির বিচারিক আদালত বাদল ফরাজিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করেন। পরে দিল্লি হাইকোর্ট সেই যাবজ্জীবন বহাল রাখেন এবং সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগও সেই একই রায় বহাল রাখেন। ঘটনা কী তা পুরো বিচার প্রক্রিয়াটি না পড়লে বোঝা যাবে না, তাই আর দোষ-নির্দোষ নিয়ে কথা না বলাই ভালো। এ সাজার বিরুদ্ধে দিল্লিতে রাহুল কাপুর নামে একজন সমাজকর্মীর নেতৃত্বে দিল্লির উদারমনের মানুষরা মিছিল করেন। বাদলের সাজা হয় ২০১৫ সালে। তাকে ২০১৮ সালের ৬ জুলাই ঢাকায় ফেরত আনা হয় ভারতের জেল থেকে। অনেক পত্রিকায় অনেক আবেগঘন লেখা প্রকাশিত হয়েছে বাদল ফরাজিকে নিয়ে। এমনকি বাংলাদেশের সরকারও একটা চাপ অনুভব করেছে, বিব্রত হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ইচ্ছা করলেই তো বাদলকে সরকার ছেড়ে দিতে পারে না। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যে ট্রান্সফার অব সেনটেন্সড প্রিজনার অ্যাগ্রিমেন্ট, অর্থাৎ সাজাপ্রাপ্ত বন্দিবিনিময় চুক্তি রয়েছে, তার আর্টিক্যাল ৮ এর ১ ধারায় লেখা আছে—The receiving state shall be bound by the legal nature and duration of the sentence as determined by the transferring state. আবার পরেই ৮ এর ২ ধারায় লেখা আছে, যদি ওই সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তির সাজা বন্দিকে গ্রহণকারী দেশের আইনের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ না হয়, তাহলে প্রেরণ করা দেশের সম্মতিতে নিজ দেশের নিয়মানুযায়ী শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারবে। কিন্তু বাংলাদেশে বা ভারতের আদালত কর্তৃক সাজাপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তিকে নিজ দেশে নিয়ে ইচ্ছা করলেই ছেড়ে দেওয়া যাবে না। শুধু বাংলাদেশ ভারত নয়, বিশ্বব্যাপী এক্সট্র্যাডিশন চুক্তিগুলো সাধারণত এ ধাঁচেই হয়ে থাকে।

যাই হোক, আনোয়ারুল আজিম হত্যাকাণ্ড দুঃখজনক, চাঞ্চল্যকর এবং ভিন্নরকম। এ ক্ষেত্রে এক্সট্র্যাডিশন প্রশ্নটিও প্রাসঙ্গিক। দুই দেশেরই আন্তরিকতার কোনো কমতি নেই। এই মুহূর্তে ভারত ও বাংলাদেশের পুলিশ প্রশাসনকে যথেষ্ট তৎপর দেখা যাচ্ছে। স্বাভাবিক। তবে প্রাসঙ্গিক শঙ্কা হলো, আমরা জানি না এ হত্যাকাণ্ডের বিচার কতদিনে শেষ হবে, মূল পরিকল্পনাকারী যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দা আখতারুজ্জামান শাহীন আদৌ ধরা পড়বে কি না এবং মামলার সুবিচার কোথায় গিয়ে ঠেকবে! প্রথমত, শাহীন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক বলে জানা গেছে। হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী আখতারুজ্জামান শাহীনকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইন্টারপোলের মাধ্যমে ফিরিয়ে আনা হবে বলে জানিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। মনের মধ্যে খচ করে ওঠে একটি প্রশ্ন—বহু বছর ধরে ইন্টারপোলের রেড অ্যালার্ট জারি করা বাংলাদেশের একাধিক আসামি ইউরোপ-আমেরিকায় প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আনা গেছে তাদের কাউকে? যে দেশ বিভিন্ন দেশ থেকে তাদের মাদক নিয়ে ধরা পড়া, খুন করা আসামিদের ছলেবলে কৌশলে ছাড়িয়ে দেশে নিয়ে মুক্ত করে দেয়, সেই দেশ থেকে শাহীনকে ধরে আনা যাবে এ যেন কল্পনাই মাত্র। দ্বিতীয়ত, দশ দিন পার হয়ে গেলেও বহু চেষ্টা করে এ হত্যাকাণ্ডের কোনো আলামত বাংলাদেশ বা ভারতের পুলিশ সংগ্রহ করতে পারেনি। এসব আইজীবী ও পুলিশই ভালো বলতে পারবেন। তবে আমরা কমনসেন্স এবং বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে যতটুকু বুঝতে পারি, সেটাই আলোচনা করছি। যদি আলামত সংগ্রহ করা না যায় (হয়তো যাবে) এবং মূল পরিকল্পনাকারী ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে, তাহলে মামলার মেরিট কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? কলকাতার পুলিশ, ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট থেকে শুরু করে স্থানীয় জেলেরা পর্যন্ত বিধাননগর খালে তন্ন তন্ন করে খুঁজে আনোয়ারুল আজিমের দেহাবশেষের কিছু পায়নি। পুলিশ তদন্তের স্বার্থে এখনো কিছু তথ্য লুকিয়ে রাখলে সেটা ভিন্ন কথা, আমরা জানি এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। এ ক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার, বিচার ব্যবস্থার কোনো দোষ নেই, বিচার-আইন চলে রেলগাড়ির মতো সোজা পথে। বিচারের কাছে আবেগ কোনো কাজ করে না এবং বিচারপতিরা আবেগের বশবর্তী হয়ে কোনো রায় দেন না। সঠিকভাবে সবকিছু তাদের সামনে উপস্থিত করা না গেলে তারা একজন অপরাধীকেও ছেড়ে দিতে বাধ্য হন, যতই নিজে তার বিবেক দিয়ে সত্য-মিথ্যা বোঝেন না কেন। হত্যা মামলায় ভারত ও বাংলাদেশের আইনে আলামত যে কত গুরুত্বপূর্ণ, তার আইন ও বিচারসংশ্লিষ্টরাই জানেন।

এমপির নিখোঁজ হওয়া নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশে যথাক্রমে নিখোঁজ এবং অপহরণ মামলা হয়েছে। বলা হচ্ছে, দুই দেশের সুসম্পর্ক রয়েছে এবং সমন্বয়ের মাধ্যমে এ বিচার চলবে। প্রয়োজনে বাংলাদেশ থেকে সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে ভারত যাবে আর ভারত থেকে সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে বাংলাদেশে আসবে। কিন্তু বিষয়টি বলা যত সহজ, বাস্তবায়ন কি ততটা সম্ভব হবে?

অপরাধ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রদত্ত অন্য দেশগুলোর সঙ্গে আইনগত সহায়তা বাস্তবায়ন বিষয়ে একটি গাইডলাইন আছে। ভারত-বাংলাদেশ দুই দেশেরই আইনের উৎস ব্রিটিশ ভারত হলেও এখন লিগ্যাল সিস্টেম ও প্রসিকিউশনে অনেক ব্যবধান আছে। যে কারণে ট্রাফিকিং ও স্মাগলিং নিয়ে যথেষ্ট ঝামেলা পোহাতে হয় দুই দেশেরই। যেমন সীমান্তে যেসব অপরাধ সংঘটিত হয়, সেই অপরাধের জুরিসডিকশন নির্ধারণ করাই একটি জটিল বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশের ৫৩ বছরের ইতিহাসে সীমান্তে অনেক ঘটনার অবতারণা হলেও আনোয়ারুল আজিম হত্যার মতো ঘটনার সম্মুখীন হয়নি দুই দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ফলে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে, বিষয়টি দুই দেশের তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ কীভাবে হ্যান্ডল করে, তা দেখতে।

শুধু আনোয়ারুল আজিম প্রশ্নে নয়, এসব জটিল বিষয় নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে একটি কমন আইন তৈরির উদ্যোগ নেওয়া উচিত বলে আমরা মনে করি। বাংলাদেশের তিনপাশে ভারত। যতই তারকাঁটার বেড়া দেওয়া হোক বা না দেওয়া হোক, সীমান্তে অপরাধ কিছু না কিছু থেকে যাচ্ছেই। হতে পারে দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত অপরাধ প্রশ্নে কমন আইনের উদ্যোগ। সীমান্ত নিয়ে আরও বিস্তারিত ভাবার প্রয়োজন এই কারণে যে, দুই দেশের মধ্যে সর্বদা যে একই রকম সমঝোতা ও সহযোগিতা দেওয়া বা পাওয়া যাবে, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাই সীমান্ত অপরাধ নিয়ে সুনির্দিষ্ট স্পষ্ট কমন আইন এবং দুই দেশের সীমান্তরক্ষীদের জন্য কমন কিছু গাইডলাইন থাকলে তা একটি চিরস্থায়ী রূপ পেতে পারে।

লেখক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

এসিআই-এ নিয়োগ, আবেদন করুন অনলাইনে

ঢাকায় বৃষ্টি নিয়ে আবহাওয়া অফিসের বার্তা

বসতভিটা ছিনিয়ে নেওয়ার হুমকি, সন্তানের বিরুদ্ধে বাবার মামলা

ব্রাজিলের মন্ত্রীর মার্কিন ভিসা বাতিল, দায়িত্বজ্ঞানহীন বললেন লুলা

ভিপি প্রার্থীর বিরুদ্ধে রুমমেটকে ছুরিকাঘাতের অভিযোগ, কী বললেন প্রক্টর

শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে বৃদ্ধ আটক

২৭ আগস্ট : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

২৭ আগস্ট : টিভিতে আজকের খেলা 

আজ থেকে নতুন দামে বিক্রি হবে স্বর্ণ

২৭ আগস্ট : আজকের নামাজের সময়সূচি

১০

বুধবার রাজধানীর যেসব মার্কেট বন্ধ

১১

কৃষিবিদ আসাদুজ্জামান কিটোনকে সংবর্ধনা দিল এ্যাব

১২

মাছ ধরার নৌকায় মিলল সাড়ে ৪ লাখ পিস ইয়াবা, আটক ৯

১৩

ভোলায় নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল / এক লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা

১৪

যৌথ বাহিনীর অভিযানে অনলাইন জুয়া চক্রের ২ সদস্য আটক

১৫

জেলেরা হেলমেট পরে মাছ ধরেন যেখানে

১৬

বিমানবাহিনীর আন্তঃঘাঁটি স্কোয়াশ প্রতিযোগিতা সমাপ্ত

১৭

স্পেনে জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের ৪৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন

১৮

কারাগারে সন্তান জন্ম দিলেন হত্যা মামলার আসামি

১৯

সিলেটের সাদাপাথর লুটের ঘটনায় সিআইডির অনুসন্ধান শুরু

২০
X