দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতার আকাশবাণীর সংবাদ পাঠক, ঘোষক ও আবৃত্তিকার তথা কিংবদন্তি বাচিক শিল্পী। একই সঙ্গে তিনি ছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একজন পরম বন্ধু। একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধারা যেমন হাতে রাইফেল নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, তেমনি দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় শব্দসৈনিক হিসেবে রেখেছিলেন বিরাট ভূমিকা। দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৩৪ সালের ২৫ জুন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার শান্তিপুরে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা নন্দদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় ও মাতার নাম নীহার বালা। সংসারের অর্থকষ্ট মেটাতে বন্ধ করতে হয় পড়াশোনা। তাতে বিষম চটে গিয়েছিলেন তার বাবা। তিনি তখনই তার সঙ্গে সব সম্পর্ক ত্যাগ করেন। কলকাতায় ঘরছাড়া হয়ে উঠলেন হ্যারিসন রোডের একটি মেসে। ওই মেসে তখন থাকতেন সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। রোজগারের জন্য তখন যে কাজই পেতেন, তাই করতেন। কখনো গৃহশিক্ষকতা, টাইপিস্ট, স্টোরকিপার এবং চায়ের দোকানেও কাজ করতে হয়েছে। কিন্তু এসবের মধ্যেও সৃজনী মনটা কিন্তু তার হারিয়ে যায়নি। সময় পেলেই শুনতেন জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ও বাচনভঙ্গি। তার অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন কাজী সব্যসাচী, আবৃত্তিচর্চার সূত্রপাত তাকে ঘিরেই। সারা দিন চায়ের দোকানে কাজ করতেন, রাতে ফিরে কলম-খাতা নিয়ে বসে যেতেন। কবিতাও লিখতেন। এমনই একটা সময় সংগীত পরিচালক সুধীন দাশগুপ্ত তাকে আকাশবাণীর ‘অনুষ্ঠান ঘোষক’-এর পদে চাকরির পরীক্ষা দিতে বলেন। অতঃপর ১৯৬০ সালে তিনি ঘোষক হিসেবে আকাশবাণীর চাকরিতে প্রবেশ করেন। তারপর একটানা ৩২ বছর আকাশবাণীতে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন। অচিরেই কুশলতায় হয়ে ওঠেন আকাশবাণীর সংবাদ ও ভাষ্যপাঠক। ১৯৬৪ সালে তিনি দিল্লিতে বাংলা বিভাগে সংবাদ পাঠকরূপে নির্বাচিত হন। সংবাদ পাঠকে তিনি এমন একটা জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলেন যে, ঘরে ঘরে সংবাদ পরিক্রমা শোনার জন্য রেডিও খোলা হতো। বাংলাদেশকে তিনি নিজের দেশ মনে করতেন। আবার পেশাগত কারণে বাঙালি স্বাধীন রাষ্ট্র ‘বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে যুক্ত হতেও কিছুটা সহজ হয়েছিল তার জন্য। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই তার কণ্ঠস্বর ইতিহাস রচনার দলিল হয়ে ওঠে। একাত্তরের রণাঙ্গনে তার প্রত্যক্ষ উপস্থিতি ছিল না ঠিকই, কিন্তু প্রণবেশ সেনের গ্রন্থনায় রাত সাড়ে ১০টায় আকাশবাণী কলকাতার সংবাদ পরিক্রমায় সেই উদাত্ত কণ্ঠ ‘আকাশবাণী কলকাতা, খবর পড়ছি দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়...’ বাঙালিকে নিয়ে যেত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মাতৃভূমিকে রক্ষার লড়াইয়ের রণাঙ্গনে। এ সময়টুকুতে যুদ্ধের সংবাদে আবালবৃদ্ধবনিতারা মনে করতেন মুক্তিযোদ্ধাদের মতো তারাও সম্মুখযুদ্ধে নেমেছেন, রাইফেলের বদলে দেবদুলালের কণ্ঠকে হাতিয়ার করে। তার কণ্ঠস্বর পৌঁছে যেত শুধু কলকাতায় নয়, যুদ্ধরত সব মুক্তিসেনার কাছে। সেই শব্দতরঙ্গ কখন যেন দেশভাগের জ্বালাকে মুছিয়ে দিয়ে পশ্চিমবঙ্গকে আবার পূর্ববাংলার সঙ্গে একাকার করে দিত। এভাবেই শব্দকে কণ্ঠের জাদুতে মিশিয়ে তিনি হয়ে উঠলেন মুক্তিযুদ্ধের শব্দসৈনিক, হয়ে উঠলেন বাঙালির এক প্রেরণা-কণ্ঠ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ভারত সরকার তাকে ‘পদ্মশ্রী’ সম্মানে ভূষিত করে। বাংলাদেশ গঠিত হওয়ার পর তিনি ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশে এলে বঙ্গবন্ধু তাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। পরে ২০১২ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে মরণোত্তর মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা প্রদান করে। দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় ২০১১ সালের ২ জুন মারা যান।