

‘এহনে মেয়ে বিয়া দিমু না। বিয়া দিমু ক্যা? এ যে শ্রম দিতাছি কার জন্যে? ওদের জন্যে (মেয়েদের) তো শ্রম দিতাছি। পড়াশোনা শিখায় উপযুক্ত বয়সে বিয়া দিমু।’ একাদশ শ্রেণি পড়ুয়া মেয়ের বিয়ে দেওয়া প্রশ্নে এভাবেই বলছিলেন গৃহবধূ জুঁই আক্তার।
অভাবের সংসারে সন্তানদের লেখাপড়া চালিয়ে নিতে সম্প্রতি তাঁতের কাজ শুরু করেছেন জুঁই। বাড়িতে নিজের কেনা তাঁত মেশিনে সুতোয় নিয়মিত শাড়ি বুনছেন। বিক্রি করে আয় করছেন।
জুঁই আক্তারের বাড়ি কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার চর শৌলমারী ইউনিয়নের চর শৌলমারী গ্রামে। ওই গ্রামের দিনমজুর সিরাজুলের স্ত্রী তিনি। এ দম্পতির ঘরে দুই মেয়ে এক ছেলে। বড় মেয়ে একাদশ শ্রেণি এবং ছোট মেয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ছে। ‘দিন এনে দিন খাওয়া’ সংসারের সামাজিক বাস্তবতায় বাল্যবিয়ের ঝুঁকিতে তাদের দুই মেয়ে।
তাদের পড়াশোনা চালিয়ে নিতে স্বামীর পাশাপাশি নিজেও রোজগার শুরু করেছেন এ গৃহবধূ। এতে করে বাল্যবিয়ে থেকে মুক্তি মিলেছে দুই কিশোরীর।
চরশৌলমারী গ্রামের চর শৌলমারী ডিগ্রি কলেজের ঠিক উত্তরে বসবাস গৃহবধূ চায়না বেগমের। দরিদ্র সীমার নিচে বসবাস করা এই গৃহবধূর সম্বল পাঠখড়ি নির্মিত একটি মাত্র ঘর। ওই ঘরে তিন মেয়ে নিয়ে বসবাস। স্বামী মোহাম্মদ আলী ভাটা শ্রমিক। টানাপোড়নের সংসারে টিকে থাকতে আঙ্গিনায় পেঁপেসহ সবজি আর বস্তায় আদা চাষ করেছেন।
চায়না বেগমের ছোট মেয়ে কোলের শিশু। বড় মেয়ে ডিগ্রি তৃতীয় বর্ষে আর মেজো মেয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ছে। এত অভাবের সংসারে চায়না-মোহাম্মদ আলী দম্পতি মেয়েদের বাল্য বিয়ে দেননি। মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে দরিদ্রতার সঙ্গে লড়ছেন। বাড়তি আয়ের জন্য তাঁতের শাড়ি বুনছেন চায়না। নিজের ঘরে স্থান সংকুলান না হওয়ায় শ্বাশুড়ির ঘরের এক কোণে তাঁত মেশিন বসিয়ে তৈরি করছেন তাঁতের শাড়ি। সেই শাড়ি বিক্রির টাকায় চালিয়ে নিচ্ছেন মেয়েদের লেখাপড়া।
চায়না বলেন, ‘স্বামীর রোজগারে সংসার আর মেয়েদের লেখাপড়ার খরচ মেটান যায় না। আরডিআরএস থেকে তাঁত চালানের প্রশিক্ষণ নিছি। তারা মেশিন কেনার টাকাও দিছে। পুরান মেশিন কিনছি। পাশের বাড়ি থেকে শাড়ির নকশা তোলা শিখছি। অহন বড় মেয়েরে সঙ্গে নিয়া প্রতি দুই দিনে একটা কইরা শাড়ি তৈরি করি। মহাজন সুতা দেয়। আমরা শাড়ি তৈরি করে দেই।’
‘প্রতি শাড়ির জন্য ৬৫০ টাকা পাই। মাসে ১৮ থেকে ২০ টা শাড়ি তৈরি করতে পারি। সংসারের কাজের সঙ্গে তাঁতের কাজ করে যে আয় করতাছি তাতে দুই মেয়ের লেখাপড়ার খরচ চালাইতে পারছি। ওরা যদ্দিন ইচ্ছা পড়বো, তারপর বিয়াশাদি।’ যোগ করেন চায়না।’
চর শৌলমারি গ্রামে তাঁত শিল্প অনেক পরিবারে বাড়তি আয়ের মাধ্যম হয়ে উঠছে। সংসারের কাজের পাশাপাশি তাঁত প্রশিক্ষণ নিয়ে নারীরা উদ্যোক্তা হয়ে উঠছেন। বাড়তি আয় করছেন। চায়না ও জুঁই আক্তারের মতো ওই ইউনিয়নের ৫০টি পরিবাররের নারীদের তাঁত প্রশিক্ষণ দিয়েছে আরডিআরএস বাংলাদেশ।
সংস্থাটির চাইল্ড নট ব্রাইড (সিএনবি) প্রকল্পের আওতায় তারা প্রশিক্ষণের পাশাপাশি তাঁত মেশিন কেনার আর্থিক অনুদান পেয়েছেন। সেই টাকায় মেশিন কিনে নিজেরা শাড়ি তৈরি করে বাড়তি আয় করছেন। সেই আয়ে সন্তানদের পড়াশোনার খরচ চালিয়ে নিতে সক্ষম হচ্ছেন। ফলে বাল্যবিয়ের ঝুঁকি থেকে রক্ষা পাচ্ছে কিশোরীরা।
সিএনবি প্রকল্পের তথ্য বলছে, চর শৌলমারী গ্রামে গত এক বছরে ৬০ শিশু বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। যাদের সবাই দরিদ্র পরিবারের সন্তান। এখনও বাল্যবিয়ের ঝুঁকিতে রয়েছে অন্তত ১৮০টি পরিবার। এমন পরিবার থেকে ৫০ জন নারীকে প্রকল্প থেকে প্রশিক্ষণত্তর তাঁত মেশিন কেনার আর্থিক অনুদান দেওয়া হয়েছে।
এতে করে পরিবারগুলো বাড়তি আয়ের মাধ্যমে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। বিয়ের ঝুঁকিতে থাকা শিশুদের পড়াশোনা চালিয়ে নিতে সক্ষম হচ্ছে।
সিএনবি প্রকল্পের কুড়িগ্রাম জেলা সমন্বয়কারী অলিক রাংসা কালবেলাকে বলেন, ‘এনআরকে-টেলিনথ ও প্লান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ এ প্রকল্পে আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতা করছে। বাল্যবিয়ের ঝুঁকিতে থাকা মেয়ে শিশুদের পরিবারের আয়বৃদ্ধিতে সহায়তা করা এই প্রকল্পের একটি অংশ। যাতে পরিবারগুলো মেয়ে শিশুদের বোঝা মনে না করে তাদের পড়াশোনা চালিয়ে নিতে পারে। এতে করে জেলায় বাল্যবিয়ে ও জোরপূর্বক বিয়ের হার পূর্বের তুলনায় কমে আসছে।’
মন্তব্য করুন