অজয় দাশগুপ্ত
প্রকাশ : ১৫ জুন ২০২৪, ০২:০৩ এএম
আপডেট : ১৫ জুন ২০২৪, ০৭:৪২ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

সুন্দর আগামীর জন্য তৈরি হওয়ার সময় এখন

সুন্দর আগামীর জন্য তৈরি হওয়ার সময় এখন

জরুরি পারিবারিক কারণে দেশে যেতে হয়েছিল। ঢাকা এয়ারপোর্ট নিয়ে আমার দুই ধরনের অভিজ্ঞতা আছে। একটি ভালো, অন্যটি নিঃসন্দেহে ভালো নয়। হয়রানি আর দেরি করানোর বেলায় আমাদের বিমানবন্দর শীর্ষে। বিশেষ করে আমাদের মতো প্রবাসীদের পেলে তো কথাই নেই। সবসময় যে তা হয় তা কিন্তু নয়। যেমন এবার পৌঁছে দেখি আমাদের বিমানবন্দর থেকে যেন বিদায় করতে পারলেই বাঁচে তারা। খুব দ্রুত পাসপোর্টে সিল মেরে মুখের দিকে ভাবলেশহীন তাকিয়ে হাতে পাসপোর্টটা ধরিয়ে দিয়েছিল। ধন্যবাদ বা স্বাগতম এসব কিছু আমাদের দেশের এয়ারপোর্টে চলে না। এমনকি আমরা বললেও তার জবাব মেলে না। মাঝেমধ্যে মনে হয় বাঘ আর সারসের গল্পের মতো। ব্যাটা জান নিয়ে পালা। মুখ থেকে মাথা বের করতে পেরেছিস এটাই তো যথেষ্ট। এবার তাদের আগ্রহ আর তাড়াতাড়ি বিদায় করার কারণ বুঝলাম ইমিগ্রেশন পার হওয়ার পর। ঢাকার আকাশ তখন অন্ধকার। চারদিকে সবাই ব্যস্তভাবে ছোটাছুটি করছেন। এও বুঝলাম, কেন মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনসের বিমানটি অবতরণ না করে আকাশে চক্কর মারছিল। যদিও তারা যাত্রীরা মানে আমরা ভয় পাব বলে ঘোষণায় অন্য কিছু বলছিল। আসলে কারণ ছিল রিমাল। ঘূর্ণিঝড় তখন প্রায় আসন্ন। সে কারণে দ্রুততম সময়ে পার হয়ে গেলাম বিমানবন্দরের সব আনুষ্ঠানিকতা। কিন্তু এটাও মানতে হবে এখন আর আগের মতো ঝুট-ঝামেলা নেই। কাউন্টারে কর্মরত অনেকেই বয়সে নবীন। তারা দেরি করানোর সংস্কৃতি শেখেনি। বরং ব্যবহার আর সেবায় তাদের এগিয়ে রাখতেই হবে।

দেশের ভেতরটা সবসময় ভিন্ন ধরনের। আপন মানুষজন আর পরিচিত গণ্ডি মানেই সুখ। যে কথা বলছিলাম, দেশে গেলে আমি সাধারণ নামে পরিচিত অসাধারণ মানুষদের সঙ্গে সময় কাটাতে পছন্দ করি। যখনই সুযোগ মেলে তাদের সঙ্গে মন খুলে কথা বলি। চট্টগ্রাম যেতে এবার দুদিন সময় লেগে গিয়েছিল। পরপর দুদিন ফ্লাইট বাতিল হওয়ার পর তৃতীয় দিনে যাত্রা এবং পৌঁছানো। এ দুদিন আমি ঢাকা শহরে কোথাও যেতে পারতাম না? অবশ্যই পারতাম। কারণ ঢাকায় রিমাল আঘাত হানেনি। কিন্তু এ দুদিন আমাকে রাস্তার পানিবন্দি মানুষ আর বন্যার মতো পানির আসা-যাওয়া দেখেই সময় পার করতে হয়েছে। খটকা লেগেছে এই ভেবে, বাইরে বসে আমরা যে উন্নয়নের কথা শুনি এবং যে অগ্রগতি চোখে পড়ে তার সঙ্গে তো এটা মেলে না। একটু বৃষ্টি হতেই তলিয়ে গেল রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা। চট্টগ্রামের পানিবদ্ধতা তো ইতিহাস। দেশের দুই প্রধান নগরীর এ হাল আমাদের ব্যথিত করে। কোথায় তাহলে গলদ?

ওই যে বলছিলাম সাধারণ মানুষজনের কথা। তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি চূড়ান্তভাবে আস্থাশীল। যে কজন গাড়িচালকের সঙ্গে কথা হয়েছে, তারা সবাই একবাক্যে তার আন্তরিকতা আর নিষ্ঠার প্রশংসা করেছেন। একইভাবে তারা আর সবকিছুর ওপর নারাজ। এই যে অনাস্থা এর কারণ দুর্নীতি। যে বিষয়টি চোখে পড়ল সিস্টেম লস বা নিয়মহীনতা এবং আশ্চর্য হলেও সত্যি, এ নিয়মহীনতার ভেতরেই আরেকটি নিয়ম কাজ করে। যে কারণে সবকিছু হয় বা হচ্ছে। অথচ শুরুতে মনে হবে এ কাজ হবে না বা হতে পারে না। এর ভালো দিকটি যেমন বললাম তেমনি খারাপ দিক হচ্ছে অনিশ্চয়তা। এই অনিশ্চয়তা মানুষকে ভাগ্যমুখী করে তোলে। অদৃশ্যের কাছে নতজানু মানুষ আস্থা হারায় নিজের প্রতি। তখন এসব আগাছাদের জন্ম যারা নানা বেড়াজালে সমাজকে আটকে ফেলে। শুরু হয় অন্ধত্ব।

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিষয়টি মায়া। দুনিয়ার আর কোনো দেশে আপনি এমন মায়াভরা সমাজ পাবেন না। পাশের বঙ্গে ও বাঙালির বসবাস। তারা আমাদের মতো বাংলায় কথা বলে। তাদের পোশাক, খাদ্য, আচার-ব্যবহার আমাদের মতো। কিন্তু আমার সেখানে গেলে নিজেকে আগন্তুক বা পরবাসী মনে হয়। এর মূল কারণ আন্তরিকতার অভাব। তাদের পেশাদারিত্ব আমাদের চেয়ে বেশি, সার্ভিস বা সেবাও তাই। কিন্তু আমাদের মতো টান বিষয়টি সেখানে কাজ করে না। ডিজিটাল জগৎ এই টানের ওপর তার থাবা বিস্তার করলেও বাংলাদেশে মায়া আছে, যা এখনো অম্লান।

বিশ্ব বাস্তবতার কঠিন ছায়া পড়েছে সমাজে। বিশেষ করে বাজারে জিনিসের দাম আগুনের মতো। সাধারণ মানুষের রাগ আর অসন্তোষের মূল কারণ সেটাই। তারা কিনতে পারছে না। শুধু গুটিকয় মানুষ আর একটি শ্রেণির কথা ভাবলে বা বাস্তবতায় রাখলে হবে না। সাধারণ মানুষ দামের জন্য বড় খারাপ অবস্থায় আছে। আমাদের এই সিডনিতেও আমরা ভালো নেই। আগের মতো বাজার করা বা যা খুশি কেনাকাটা করার দিন শেষ। মেপে মেপে প্রয়োজনমতো সবকিছু করছে মানুষ। পার্থক্য এই, আগুন দামের জিনিস পানির মতো করে কেনার কোনো বিশেষ শ্রেণি নেই এখানে। যে কারণে দুঃখটা এক কারও নয়। সবাই সমান ভুক্তভোগী।

সমাজ ও সংস্কৃতির ভেতর ডিজিটাল এমনভাবে ঢুকেছে যে, মানুষ আসলে ভালো-মন্দের তফাত করতে পারে না। আমার মনে হয়েছে সরকার বা প্রশাসন খারাপ চলছে না। খারাপ চলছে সমাজ। সমাজের এই সংকীর্ণ ও নাজুক অবস্থার জন্য দায়ী রাজনীতি। জনমানসে এর কোনো প্রভাব না থাকলেও মিডিয়ায় আছে। ফলে মানুষ মিডিয়াবিমুখ। তাদের ঘরে ঘরে ওপারের চ্যানেলগুলোর রমরমা অবস্থা। হবে না কেন? যে কদিন আমি ছিলাম, চ্যানেল ঘোরালেই চোখে পড়ত টক শো। নানাভাবে কথা হচ্ছে। সব চ্যানেলে খালি কথা আর কথা। এত কথা হজম করার শক্তি নেই মানুষের। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, মতামত দেওয়া। যে জানে এবং যে জানে না, সবাই খালি উপদেশ দেয়। এই উপদেশ-ক্লান্ত সমাজে সবচেয়ে কঠিন জায়গায় আছে শিশু-কিশোর আর বয়োবৃদ্ধরা। তাদের নিঃশ্বাস ফেলার জায়গা কোথায়? সুস্থ বিনোদন বা সংস্কৃতি আজ প্রায় উধাও। আগে ঘরে ঘরে গানবাজনা আর আনন্দের উৎস ছিল আড্ডা। গানবাজনা বিলুপ্ত প্রায়। আর আড্ডা? সে জায়গা দখল করেছে বায়বীয় জগৎ। যে কারণে মানুষ এখন একা। ভীষণ অসহায় ও একা। এমনই এক বাস্তবতা, কেউ হাসপাতালে গেলে তাকে দেখতে যাওয়ার আগে সামাজিক মিডিয়ায় পোস্ট দিতে ব্যস্ত সবাই। যাত্রাপথে আরেক পোস্ট। তারপর পৌঁছানো মানে ফটোসেশন। এর ভেতর আন্তরিকতা কোথায়? কোথায় ভালোবাসা?

আধুনিক হওয়ার জন্য যেসব উপাদান জরুরি তার সবই আছে দেশে। কিন্তু আদর্শ বা দিকনির্দেশনা নেই। মানুষ বই পড়ে না, এ কথা আমি মানি না। বাতিঘর নামের বুকশপে গিয়ে দেখলাম দলে দলে শিশুরা যায় সেখানে। বই পড়ে। কিন্তু কী বই পড়ে, কোন বই তাদের চোখ খুলে দিতে পারে, সেটা সম্ভবত জানে না। লেখকরা সেখানে যায় নিজেদের প্রচার করতে। ভাষণ দিতে। কিন্তু বাচ্চাদের জন্য বা নবীনদের জন্য যায় না। এই অভিভাবকত্বের সংকট দেশের সব জায়গায় দেখা যায়। যে কারণে আমরা এক পা এগিয়ে দুই পা পিছিয়ে পড়ছি বারবার।

তারপরও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। এটা গেলেই টের পাই। সঠিক নেতা সঠিক পথ আর সঠিক কাজ করলে আমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না। বাংলাদেশ তার তারুণ্যের প্রতি আস্থা রাখতেই পারে। বাকিটা যারা সমাজপতি তাদের দায়দায়িত্ব।

লেখক: সিডনি প্রবাসী প্রাবন্ধিক, ছড়াকার ও কলামিস্ট

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

জামায়াত অন্তত ১৬০টি আসন পাবে : সাদ্দাম

‘মাদ্রাসার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে ছাত্রী হয়রানির অভিযোগ মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’

পার্বত্য অঞ্চলকে অশান্ত করে খোয়াব পূরণ হবে না : জাগপা

‘আসল শিবির হইলো আমার মা, বাড়ি এলেই জোর করে বোরকা পরায়’

উৎসবের আবহে উদযাপিত হলো টাইমস স্কয়ার দুর্গা উৎসব

অবশেষে মুখ খুললেন আরিয়ান খান

৮-৯ অক্টোবর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি নিয়ে কী বলছে মাউশি

গণভবন কখনোই প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ছিল না : উপ প্রেস সচিব

ফ্রিডম ফ্লোটিলায় ইসরায়েলি বাধা / ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সহিংস বিক্ষোভ

বিশ্বকাপে রেকর্ডের বৃষ্টি তুলে প্রোটিয়াদের উড়িয়ে দিল ইংল্যান্ড

১০

১০০ আসন ছেড়ে দিতে পারে জামায়াত : গোলাম পরওয়ার

১১

জুলাই সনদের আইনিভিত্তি দেওয়া না হলে সাংবিধানিক সংকট তৈরি হবে : ড. আযাদ

১২

দেশের অগ্রগতির জন্য নারীদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ : খোকন

১৩

মুলাদীর সাবেক পৌর মেয়র রুবেল কারাগারে

১৪

গাজা অভিমুখে যাচ্ছে আরও ১১ জাহাজ

১৫

টসে জিতে ফিল্ডিংয়ে বাংলাদেশ, দেখে নিন একাদশ 

১৬

বিএনপির বিরুদ্ধে গুজব ছড়িয়ে লাভ হবে না : মাহবুবুর রহমান

১৭

ইসলামকে ক্ষমতায় নিতে নারী সমাজকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে : চরমোনাই পীর

১৮

নির্বাচন নিয়ে ধর্ম ব্যবসায়ী একটি দল বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে : মির্জা আব্বাস 

১৯

শনিবার বিদ্যুৎ থাকবে না সিলেটের যেসব এলাকায়

২০
X