আমার বাবা স্নেহপ্রবণ এবং দায়িত্ব জ্ঞানসম্পন্ন মানুষ ছিলেন। তিনি যে কাল যে শ্রেণির মানুষ ছিলেন, সেই কাল এবং সেই শ্রেণির গুণ এবং দোষ উভয়ই তার মধ্যে ছিল। গুণের কথা প্রথমেই বলেছি, সেটা হলো দায়িত্বজ্ঞান সম্পন্ন এবং স্নেহপ্রবণ। বাবা আমাদের পরীক্ষার আগে খুব উদ্বিগ্ন থাকতেন এবং পরীক্ষার সময় হলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন। আমি যখন মেট্রিক পরীক্ষা দিয়েছি, তখন বাবা আমার হল গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন এবং আমাকে সঙ্গে করে বাড়ি ফিরেছিলেন। আবার পরিণত বয়সে বাবা আমার বিয়ে ঠিক করে দিয়েছিলেন। যদিও পাত্রী আমার পরিচিত ছিল।
আর দুর্বলতার কথায় বলতে হয়, তিনি ছিলেন অত্যন্ত আমলাতান্ত্রিক। এই আমলাতান্ত্রিকতা তার জীবনে এসেছে চাকরি থেকে। আমাদের পরিবারটি ছিল পিতৃতান্ত্রিক। আমার মা পরিবারের সব কাজ করতেন। কিন্তু সিদ্ধান্তগুলো নিতেন আমার বাবা।
মধ্যবিত্ত পরিবারের স্বভাব অনুযায়ী তিনি তার সন্তানদের নিয়েই সব সময় ভাবতেন, সমাজের কথা ভাববার অবকাশ ততটা পেতেন না। তার ধারণা ছিল, সন্তানদের প্রকৃত শিক্ষা দিতে হবে এবং উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে। তাহলে তারা জীবনে প্রতিষ্ঠা অর্জন করবে এবং তাদের সম্পত্তির বিষয়টা সমাধান হয়ে যাবে।
তিনি নিজে ঢাকা শহরে কোনো সম্পত্তি অর্জনের কথা ভাবতেন না। ৪৭ সালের শেষ দিকে তিনি যখন ঢাকা শহরে এলেন, তখন ভাড়া বাড়িতে থাকতেন। তার সামনেই অনেক লোক জায়গা-জমি কিনে বিষয় সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। কিন্তু তিনি এসব নিয়ে ভাবতেন না। আমার বাবার মূলত দুটি চিন্তা ছিল। বিক্রমপুরে ছিল আমাদের বাড়ি। এটা স্বভাবতই রাজধানীর সঙ্গে যুক্ত। তিনি মনে করতেন, কলকাতার আশপাশের এলাকাগুলো যেমন সমৃদ্ধ হয়েছে; বিক্রমপুরও তেমনি সমৃদ্ধ হবে। কিন্তু নিজ এলাকা সমৃদ্ধ হওয়ার স্বপ্নটা তার সফল হয়নি। সমৃদ্ধি সব উত্তর দিকে চলে গেছে, দক্ষিণে বা পশ্চিমে এটা যায়নি। ফলে এ ক্ষেত্রে তার একটা হতাশা তৈরি হলো এবং ঢাকা শহরে ভালো জায়গা না পাওয়ায় পুরান ঢাকায় একটি ছোট বাড়ি করলেন। এটা তার জন্য একটি বেদনার বিষয় ছিল।
দ্বিতীয়ত, তিনি ভাবতেন তার ছেলেরা যদি ভালো শিক্ষা পায়; তাহলে তারা নিজেরই নিজেদের ব্যবস্থা করে নিতে পারবে। সেকালের পিতাদের মতো তিনিও সন্তানদেরই নিজের জগৎ মনে করতেন। তার বাইরে সামাজিক কাজগুলো উনি করতে পারতেন না।
তবে আমরা তখন যে সামাজিক কাজগুলো করছিলাম, তাতে তিনি বাধা দিতেন না। আমরা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মধ্যে বড় হয়েছি। তখন আমরা আজিমপুরে থাকতাম। সেখানে আমাদের একটি সামাজিক জীবন ছিল, সেগুলোতে অংশ নিতাম। এসব ক্ষেত্রে আমার বাবা আমাদের নিরুৎসাহিত করতে না। কিন্তু উনি মনে করতেন, আমাদের আসল কাজ হলো লেখাপড়া করা এবং লেখাপড়া হচ্ছে নিজের প্রতিষ্ঠা করার জন্য। এটাই ছিল তার জগৎ এবং চিন্তা।
আমার বাবা আমাদের জন্য কঠিন আত্মত্যাগ এবং শ্রম স্বীকার করেছেন। তিনি যখন মারা গেলেন, তখন আমি দেশে ছিলাম না। তখন আমি উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বাইরে ছিলাম। সেটা হচ্ছে ১৯৬৫ সালের ঘটনা। আমার জন্য খুব কষ্টকর হতো তার কষ্টকে সামনাসামনি দেখা।
বাবার রোগটা ছিল পাকস্থলীতে। তখন মধ্যবিত্তের স্বভাব ছিল খাওয়া-দাওয়া সময়মতো না করা। বাবা সকাল ৯টায় অফিসে যেতেন এবং বিকেল ৫টায় বাড়ি ফিরতেন। ফলে তার পাকস্থলীতে গ্যাস্ট্রিক এবং আলসার হয়েছিল। তখন এ রোগের তেমন কোনো চিকিৎসা ছিল না। তিনি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা নিতেন এবং রোগটাকে অবদমিত রাখার চেষ্টা করতেন। এটা বোধহয় একসময় ক্যান্সারের আকার নিয়েছিল এবং এ রোগেই তিনি মারা গেলেন।
আমার পিতার প্রজন্মের লোকেরা সন্তানদের খাওয়া-দাওয়ার ওপর খুব জোর দিতেন এবং সংসারের জন্য বাজার করাকে একটি বিনোদন মনে করতেন। সেকালে জিনিসপত্র খুব সস্তা ছিল। ফলে তারা সন্তানদের জন্য প্রচুর খাদ্যদ্রব্য কিনতেন; কিন্তু তারা ভাবেননি এবং চিন্তা করতে পারেননি তাদের পরবর্তী প্রজন্ম কোনোরকম জগতে প্রবেশ করবে।
আমার বাবা আমাদের যেভাবে প্রতিষ্ঠিত দেখে যেতে চেয়েছিলেন, তা পারেননি। আমি উচ্চশিক্ষা শেষ করে ইংল্যান্ড থেকে ফেরার আগেই বাবা চলে গেলেন। আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করার অনুমোদন তিনি দিয়েছিলেন। কিন্তু তার প্রথম পক্ষপাত ছিল আমি সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দিয়ে সিএসপি হবো। তিনি যেহেতু আমলাতান্ত্রিক কাজ করেছেন, তাই তিনি মনে করতেন এটাই জীবনের সার্থকতা। বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি তার দৃষ্টিতে ছিল মন্দের ভালো। কারণ আমরা যখন চাকরিতে ঢুকেছি, তখন বেতন ভালো ছিল না, উন্নতির তেমন আশা ছিল না এবং ক্ষমতা ছিল না। কিন্তু ভালো বেতন, উন্নতির আশা এবং ক্ষমতা—এ তিনটি বিষয় ওই সময় মানুষ গুরুত্বপূর্ণ মনে করত। কিন্তু আমার ইচ্ছা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিটা বাবা মেনে নিয়েছিলেন এবং এতে তিনি খুশিই হয়েছিলেন।
আমার আব্বা যখন মারা যান, গল্পে নয় জীবনেই—তখন তার কাছ থেকে অনেক দূরে ছিলাম আমি; দূরদেশের এক শহরে। মৃত্যুর সেই মর্মান্তিক খবরটা আমাকে জানানো উচিত হবে কি হবে না এবং জানাতে হলে কী হবে, সেই বিজ্ঞপ্তির ভাষা—এ সমস্ত অশ্রুসজল দ্বিধা ও সংশয় পার হয়ে যে চিঠি আমার নিরুপায় ছোট ভাই লিখেছিল আমাকে, স্বাভাবিক হাতেই সেটি খুলেছিলাম আমি। খুলে একেবারে প্রথমেই চোখ গিয়ে পড়েছিল একটি বাক্যাংশের ওপর—‘আব্বার মৃত্যুর পরে’। রক্তের প্রবাহ সঙ্গে সঙ্গেই দ্রুততর হয়ে উঠেছিল, হাত কাঁপছিল, পা কাঁপছিল—যেন ভূমিকম্প। ভবিষ্যতের একটা আশঙ্কার কথা বলেছে আমার ভাই, আমি এমনটা ভাবতে চেয়েছিলাম। ভবিষ্যতে একদিন যখন মৃত্যু হবে আমার পিতার, অবধারিত মৃত্যু অনিবার্য হয়ে উঠবে যেদিন—সেদিন সেই মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমরা কী করব, কেমন হবে আমাদের আচরণ, সেই সম্পর্কে জানতে চাইছে হয়তো—আমি ভাবতে চেয়েছি। ভাবতে চেয়েছি অন্য কোনো কারণে নয়, আত্মরক্ষার একেবারে জৈবিক প্রয়োজনে। একটা আশ্বাসের আবশ্যক ছিল, দরকার ছিল একটা অবলম্বন। তখন সময়টা যে ভূমিকম্পের। কিন্তু সে কয়েক মুহূর্তের জন্য শুধু। স্পষ্ট করে চিঠিটা খুলে ধরতেই তো দূর হয়ে গেল সবটা অন্তরাল, ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেল সমস্ত অবলম্বন। অন্তর্হিত হলো আশ্বাস। তখন আমি ও আমার পিতার মৃত্যুসংবাদ—এই দুজনা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, প্রবলতম শত্রু আমরা একে অন্যের। মাঝখানে আর কেউ নেই, কোনো কিছু নেই, আড়াল নয়, আবডাল নয়। কিন্তু শুধু সংবাদটি তো নয়, সেই বিদেশ, সেই পরিবেশ, পরিস্থিতি—সব কিছু বৈরী আমার। আমি একেবারে একাকী। আক্রান্ত। পরিবেষ্টিত। পালাব কোথায়? কোনদিক দিয়ে?—না, পলায়ন নেই। সত্য শুধু মৃত্যু, সত্য শুধু সত্যের শত্রুতা, আর সমস্ত কিছু মিথ্যা—আমার জন্য। সেই অন্তিম দৃশ্য কল্পনা করব—এমন সাহস আমার ছিল না। শেষ শয্যা, শবযাত্রা, কবর। তারপর ফিরে আসা, কবরে রেখে পিতাকে। খাওয়া, ঘুমানো। বেঁচে থাকা। কল্পনা করতে পারিনি আমার মায়ের মুখ, ভাইয়ের মুখ, বোনের মুখ। আমার কল্পনা যায়নি অতদূর। বরঞ্চ তখনো, সেই অন্তরালহীন, আশ্বাসবিহীন সত্যের নির্মম, নিরবচ্ছিন্ন আঘাতে ক্ষতবিক্ষত যখন আমি তখনো, ভেতরে ভেতরে, গোপনে গোপনে, মনে হয়েছে আমার যে, পিতার সঙ্গে আমার ব্যবধানটা কেবলই স্থানের। না, সময় নয়, শুধুই স্থানের। এখনই যদি রওনা হই, এই বিরূপ বিদেশ থেকে, তবে প্রচুর অর্থ ব্যয় ঘটবে নিশ্চয়ই, পরিশ্রমও হবে অনেকটা, কিন্তু দেখা হবে, আবার দেখা হবে সেই মানুষটির সঙ্গে, যাকে পেছনে রেখে এসেছি। ব্যবধান থাকবে না। আমরা মুখোমুখি হবো—আমি ও আমার পিতা। স্মিত হাসিতে আমরা জানাব একে অন্যকে যে, আমরা ভালো ছিলাম, আমরা ভালো আছি—আমরা উভয়েই। এরপরও অনেক দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে হঠাৎ হঠাৎ আমার মনে হয়েছে ওই চিঠিটা মিথ্যা, ওই সংবাদটি অলীক দুঃস্বপ্ন। মিথ্যা, মিথ্যা, মিথ্যা তারা। সকালের আলো বলছে সে-কথা। যেন সকালে উঠে দেখি অনেক দিনের পুরোনো অসুখটা সেরে গেছে হঠাৎ। কিন্তু চলেই তো গেছেন। দূরত্বটা তো সময়েরই। এই তো কাছেই তার কবর, এই শহরেই; কিন্তু আমি তো পারব না, কোনোদিনই আর পারব না পার হয়ে যেতে সময়ের ব্যবধান। পারবেন না তিনিও—সমস্ত স্নেহ, ভালোবাসা সত্ত্বেও না। তবু আমি তাকে দেখি। প্রায়ই দেখা হয়। এমনকি চমকেও উঠি না দেখা হয়ে গেলে। দেখি আপিসে চলেছেন হন হন করে, ব্যস্ত-সমস্ত তিনি। আবার দেখি ফিরছেন কখনো, ক্লান্ত তার পদক্ষেপ, যেন নুইয়ে পড়েছে দীর্ঘ দেহ। বাজার করছেন হয়তো আমার পাশেই দাঁড়িয়ে। আমি দেখি। ব্যাংকে দেখি, দেখি পোস্ট অফিসে। দেখে এমনকি চমকেও উঠি না। তার কারণ আছে। কারণ তিনি অসাধারণ ছিলেন না। অসামান্য কেউ ছিলেন না আমার পিতা। সাধারণ গুণনীয়ক তিনি। মধ্যবিত্ত জীবনের অঙ্ক—দেখতে সে যতই জটিল হোক, হোক কঠিন ও বিস্তৃত—সেই অঙ্কের সরল ও সাধারণ গুণনীয়ক তিনি—আমার পিতা। অনেক সময় আমার খুব ইচ্ছা হয় আরও কাছে যাই চলে, কথা বলি, জিজ্ঞাসা করি কেমন আছেন। ইচ্ছা হয় কুশল বিনিময় করি তার সঙ্গে, তাদের সঙ্গে যারা দেখতে, চলতে, পোশাকে-আসাকে, ব্যস্ততায়, বিষণ্নতায় আমার পিতারই মতন। তিনিই যেন আমার পাশ দিয়ে যান, আমার পাশে এসে দাঁড়ান। মুখে তার মেঘ-রৌদ্রের খেলা। যেন সেই দূর দেশের দূরের শহর থেকে ফিরেছি আমি, এখন, এই মাত্র। অনেক তারা। অনেকেরই একজন তিনি। সাধারণ ছেলের সাধারণ পিতা।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
শ্রুতলিখন: জাকির হোসেন