সেলিনা হোসেন
প্রকাশ : ১৬ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম
আপডেট : ১৬ জুন ২০২৩, ০৮:৩৭ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ

কথাসাহিত্যের ভাষা ও আমার সময়

সেলিনা হোসেন
সেলিনা হোসেন

কথাসাহিত্যের ক্ষেত্রে আমার সবসময় মনে হয়, ভাষার সাবলীলতা সৃষ্টি হতে হবে বিষয়কে কেন্দ্র করে। কারণ যে বিষয়ে আমি লিখব, ভাষা যদি তাকে সঠিকভাবে বর্ণনা করতে না পারে, তাহলে সে লেখা পড়ে যাবে। পাঠকের কাছেও চিন্তা যথাযোগ্যভাবে পৌঁছাবে না।

গল্পের পটভূমি যে অঞ্চলের, সে অঞ্চলের নির্দিষ্ট ভাষার প্রয়োগ আমি প্রথমদিকে করেছি। তবে এখন আর এটা পারছি না। এখন এ বিষয় আমি ছেড়ে দিয়েছি। যখন ‘ভূমি ও কুসুম’ লিখলাম— দহগ্রাম, আঙ্গরপোতা ছিটমহল অঞ্চলে আমি গিয়েছি। তখন ওখানে আট ঘণ্টা খোলা থাকত। সে সময়ে সবাই বাজার-সদাই বা প্রয়োজনীয় কাজ-কারবার সেরে নিত। সেই সময়ে আমি ওখানে গিয়েছি।

যে অঞ্চলের গল্প লিখব, সেখানটাতে আমার তো যেতেই হবে। কোনো জায়গায় না গিয়ে সে জায়গার গল্প আমি লিখি না। জায়গা আগে জরিপ করি, দেখে আসি; তা নিয়ে গবেষণা করি। কিন্তু একটা সময়ে যখন আমি দেখলাম, সেই ভাষা যথার্থভাবে ব্যবহার করতে পারব না, তখন আমি একটা কমন বা সার্বজনীন ভাষাতেই লিখেছি। আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করতে গিয়ে আরেকবার আমি একটা ধাক্কা খেয়েছিলাম।

সেটা ১৯৭৬ সাল; আমি ‘পোকামাকড়ের ঘরবসতি’ লিখব। সে জন্য জেলেপল্লি খুঁজছি। প্রথমে গিয়েছিলাম পটুয়াখালী। একজন বলেছিল, সেখানে একটা লালদিয়ার নামে একটা চর নামে। আমার স্বামী আনোয়ার ছোট্ট একটা একতলা লঞ্চ ভাড়া করে আমাকে সেখানে নিয়ে গেল। গিয়ে দেখি, ওখানে জেলেরা মাছ ধরে আর শুঁটকি বানায়। কোনো বসতি নেই। কিন্তু কোনো বসতি ছাড়া আমি গল্প বানাব কী করে! আমার তো লোকজন লাগবে।

বাংলা একাডেমিতে চট্টগ্রামের দুজন মানুষ ছিলেন—সুব্রত বড়ুয়া ও সংগীতশিল্পী কল্যাণী ঘোষ। তারা বলল, আপনি শাহপরীর দ্বীপে যান। টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপে গিয়ে সত্যি চমৎকার একটা জেলেপল্লি পেলাম। আমি তাদের জীবনযাপন দেখলাম, নানাকিছু লিখে রাখলাম। আমার উপন্যাসের নায়ক হাঙর শিকারি। তাই ওখানকার এক জেলে নৌকায় করে সমুদ্রে হাঙর ধরাও দেখতে গেলাম। কিন্তু সমস্যা হলো, আমি তো চট্টগ্রামের ভাষা পারব না! হুবহু তাদের শব্দ তুলে আনা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

তখন আমি উপন্যাসটা সাধারণ ভাষায় লিখে, ডায়ালগগুলো সুব্রত বড়ুয়া আর কল্যাণী ঘোষকে দিয়ে চট্টগ্রামের ভাষায় করিয়ে নিয়েছি। ভুল লেখার চাইতে তাদের সহায়তা নেওয়াকেই শ্রেয় মনে করেছি। তারপর আখতারুজ্জামান এ উপন্যাসটা নিয়ে সিনেমা বানালেন। সে সিনেমা যখন চট্টগ্রামে দেখানো শুরু হলো, তখন আখতারুজ্জামান আমাকে ফোন করলেন। বললেন, ‘লোকজন তো ফাটাইয়া ফেলতেছে! এই সিনেমা এক্ষুনি নামিয়ে ফেলতে বলছে! তারা বলছে, এটা কী হইছে? এটা কোনো চট্টগ্রামের ভাষা হইল! আমাদের ভাষা এ রকম না।’ মহামুশকিল! এখন ববিতা, আলমগীরের মুখে হুবহু চট্টগ্রামের ভাষা কী করে সম্ভব!

আমার কথা হলো, যে পটভূমিতে উপন্যাসটা রচিত হচ্ছে, সে পটভূমিকে আমার প্রবলভাবে মাথায় রাখতে হবে। এই পটভূমি ধরে আমার ভাষার বিন্যাস, শব্দের বিন্যাস, ডায়ালগ—এ সবকিছু নির্মাণ করতে হবে। বাক্যের ক্ষেত্রে আমি খুব বড়ও না, আবার ক্ষুদ্রও না; মাঝামাঝি ধরনের বাক্য লিখতে পছন্দ করি। ছোট ছোট বাক্যে অনেক সময় চিন্তাটা টুকরো হয়ে যায়। অনেকে বলেন, আমার গদ্য কাব্যিক। আমি ইচ্ছা করে অনেক সময় এটা করি না। কারণ গদ্যটা যদি পাঠকের মনকে স্পর্শ না করে, সে গল্পে বেশিদূর প্রবেশ করতে চাইবে না। ভাষাটা যদি তার ভালো লাগে, তবেই সে তার পাঠটাকে টেনে নিয়ে যাবে। এ টেনে নিয়ে যাওয়ার কাজটা আসলে যৌথ। লেখক ও পাঠক দুজনেরই এতে অংশগ্রহণ করতে হয়। অংশগ্রহণের সেই জায়গাটা প্রস্তুত করে দিতে হয় লেখককেই।

সময় করে সমসাময়িক অনেকের লেখাই আমি পড়ে দেখার চেষ্টা করি। এখন আমার যেটা মনে হয়, আমাদের তরুণ যারা লিখছে; তারা তাদের নিজেদের নতুন ভঙ্গিতে বিগত কালের কথাসাহিত্যের ভাষার স্রোতকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। পঞ্চাশে আমাদের সাহিত্যের যে স্রোত শুরু হয়েছিল, একেবারে ষাটের আখতারুজ্জামান ইলিয়াস পর্যন্ত। স্বাধীনতা-পরবর্তী আমাদের লেখকরা সেই স্রোতকে টেনেই এগোচ্ছে।

অনেক দিন ধরেই আমি একটা কাজ করতে চাই, কিন্তু করা হচ্ছে না। তারওপর এখন শরীরটা খুবই খারাপ যাচ্ছে। সে কাজটা আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের জনজীবন নিয়ে। কাপ্তাই ড্যামটা করতে গিয়ে সেখান থেকে প্রায় এক লাখ আদিবাসী উচ্ছেদ হয়ে গেছে। তারা সবাই চলে গেছে অরুণাচলে। ওদেরই একটা ঘটনা আমি একবার শুনেছিলাম যে, ২৮ বছর পর ওদের একজন ফিরে এসেছে সেখানে; থেকে যাওয়া স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে। এই যে মিলনের মাধুর্য, কষ্ট, বেদনা—সবকিছু মিলিয়ে উপন্যাসটা শুরু করে তাদের অধিকারের প্রশ্নে আসা। ওদের জনজীবনের দুঃখ-কষ্ট, কৃষিকাজ, শিক্ষাব্যবস্থা, অধিকারবঞ্চিত হওয়ার কথা। অনেক দিন ধরেই এটা আমি মাথায় রেখেছি। যদিও আমার একটা বই আছে আদিবাসীদের মেঘ ও শিশির নামে। ওই এলাকাটায় আমি অনেক ঘুরেছি।

আরেকটা কাজের ইচ্ছা আছে। আমাদের নদীগুলো নষ্ট হচ্ছে। আমি এই নদীকে চরিত্র করে একটা উপন্যাস লিখব। এটা আমার অনেক দিনের ইচ্ছা। আমার ছোটবেলার নদী করতোয়া। আমার তরুণ বয়সের নদী পদ্মা। রাজশাহীতে। শৈশব কেটেছিল বগুড়ায়। করতোয়ার যে বিশালতা দেখেছি! সেই করতোয়া এখন এতটুকু। মহাস্থানগড়ের সামনে গিয়ে যখন দাঁড়ালাম, আমার চোখে পানি এসে গেছে। এই করতোয়া তো আমার শৈশবের করতোয়া না!

সব নদীর নামে চরিত্র নির্মিত হবে। নদী কথা বলছে, তার দুঃখ, আনন্দ-বেদনা প্রকাশ করছে আরেক নদীর কাছে। জনজীবনও থাকবে। তবে তারা থাকবে অনেকটা পোকামাকড়ের মতো। এখন এমন করে ভাবছি। লিখতে গিয়ে দেখি কী দাঁড়ায়!

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

এশিয়া কাপের আগে জার্সি স্পনসর হারানোর শঙ্কায় ভারত দল

গবেষণা / পুরুষদের তুলনায় নারীদের বেশি ঘুমের প্রয়োজন, জেনে নিন কেন

৪০ কোটি টাকায় দেড়শ বছরের সিআরবি ভবন সংস্কারের উদ্যোগ

সেতু কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ২৭০ ফ্ল্যাট বরাদ্দ বাতিলের সিদ্ধান্ত

‘যদি পিআরের জন্য আন্দোলন করেন, তাহলে নমিনেশন দিলেন কেন’

প্রপাগান্ডা ছড়ানোর আগে পরামর্শ নিতে বললেন শিবির প‍্যানেলের সর্ব মিত্র!

মালয়েশিয়ায় নামাজ আদায় করে কার্যক্রম শুরু করলেন নাহিদ

খাওয়ার পর করা এই ৮ কাজ ডেকে আনবে বিপদ, বলছেন বিশেষজ্ঞ

এবার নাহিদা-সোবহানারাও হারল যুবাদের কাছে

গুম-খুনের জন্য হাসিনার বিচার হতেই হবে : মির্জা ফখরুল

১০

৩৮ বছরের দাম্পত্য জীবনে ইতি টানছেন গোবিন্দ ও সুনীতা

১১

ফেনী থেকে নির্বাচন করবেন এবি পার্টির চেয়ারম্যান 

১২

চাঁদাবাজি ও ছিনতাইর অভিযোগে সাবেক সমন্বয়ক গ্রেপ্তার

১৩

অনুপ্রবেশকারীদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে বলল ছাত্রদল

১৪

ঐকমত্য কমিশনে মতামত দেয়নি যেসব দল

১৫

গ্রোক চ্যাটবটের সঙ্গে কথোপকথনের লাখো তথ্য ফাঁস

১৬

গাজায় কোনো দুর্ভিক্ষ নেই, বলল ইসরায়েল

১৭

হোটেলে নিয়ে তরুণীকে ধর্ষণ, সাবেক সমন্বয়কের বিরুদ্ধে মামলা

১৮

অজিদের বিপক্ষে প্রোটিয়াদের রেকর্ড সিরিজ জয়

১৯

তিস্তা সেচ ক্যানেলে নেমে ২ শিশুর মৃত্যু 

২০
X