ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন রাজশাহী শহরের বাসিন্দা নাসিমা আক্তার। ৩৯ বছর বয়সী তিন সন্তানের এই জননী এক দশকের বেশি সময় ধরে অসংক্রামক এই রোগ দুটির সঙ্গে লড়ছেন। মধ্যবিত্ত পরিবারের পক্ষে এসব রোগের চিকিৎসা ব্যয় বহন করা কঠিন। এই ব্যয় খরচ মেটাতে অন্যান্য প্রয়োজন কাটছাঁট করতে হচ্ছে নাসিমা আক্তারের পরিবারকে। এভাবে চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে এমন অনেককেই প্রতি বছর দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যেতে হচ্ছে। অথচ তাদের জন্য বিনামূল্য বা স্বল্পমূল্যে গুণগত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার (ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজ-ইউএইচসি) মূলনীতি। কিন্তু সেই লক্ষ্য অর্জনে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই।
সংবিধানে স্বাস্থ্যসেবাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও চিকিৎসক ফি, রোগ নির্ণয় ও ওষুধ কিনতে রোগীকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ব্যক্তিকেই চিকিৎসা ব্যয়ের ৭৩ শতাংশ বহন করতে হয়। সরকারি গবেষণাতে দেখা যাচ্ছে, নাগরিকের মাথাপিছু সরকারি বরাদ্দ কমেছে। স্বাস্থ্য ব্যয় বহন করতে গিয়ে বছরে ৮৬ লাখের বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। সবচেয়ে বেশি ব্যয় ওষুধে, ৫৪ দশমিক ৫০ শতাংশ। এ ছাড়া রোগ শনাক্তে ২৭ দশমিক ৫২ এবং চিকিৎসকের পেছনে খরচ ১০ দশমিক ৩১ শতাংশ। বিশ্বের অন্যান্য দেশে জিডিপির ২ থেকে ৩ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ থাকে, বাংলাদেশে তা এক শতাংশেরও কম। বিশ্বব্যাংকের সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা সূচকে অনেক পিছিয়ে বাংলাদেশ। ১০০ স্কোরে বাংলাদেশের অবস্থান ৫১। এ তালিকায় নেপালের স্কোর ৫৩, ভারতের ৬১, ভুটানের ৬২, শ্রীলঙ্কার ৬৭ ও মালদ্বীপের ৬৯। অন্যদিকে ৪৫ স্কোর নিয়ে বাংলাদেশের নিচে রয়েছে পাকিস্তান।
এমন পরিস্থিতিতে বৃহস্পতিবার ১২ ডিসেম্বর দেশে পালিত হচ্ছে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য—স্বাস্থ্য: এটি পরিবারের নাকি সরকারের দায়িত্ব। প্রতিপাদ্যে গুরুত্ব পেয়েছে মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি, চিকিৎসা নিতে গিয়ে সর্বস্বান্ত না হওয়া এবং জনস্বাস্থ্য সংকট থেকে রক্ষার উপায়। দিবসটি উপলক্ষে আজ সকালে রাজধানীর মিরপুর কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতাল ও রিসার্চ ইনস্টিটিউটে সেমিনার হবে। এ ছাড়া দেশের সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান নানা আয়োজনে দিবসটি পালনের উদ্যোগ নিয়েছে।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৯৭ সাল থেকে স্বাস্থ্য ব্যয়ে সরকারের মাথাপিছু বরাদ্দ বাড়েনি, বরং কমেছে। সরকার ২০১২ সালে চিকিৎসায় ব্যয় কমানোর উদ্যোগ নেয়। ওই বছর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগ সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনের কৌশলপত্র প্রণয়ন করে। সেখানে ২০৩০ সালের মধ্যে চিকিৎসা ব্যয়ের ৬৮ শতাংশ সরকারি বরাদ্দ এবং বাকি ৩২ শতাংশ রোগী দেবেন—এমন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ হয়। এরপর এক যুগের বেশি সময় পার হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। উল্টো ২০১৫ সালে ব্যক্তির চিকিৎসা ব্যয় ৬৪ থেকে বেড়ে ৬৭ শতাংশ হয়। ২০২০ সালে স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের গবেষণায় দেখা গেছে, একজন ব্যক্তি স্বাস্থ্য খাতে মোট ব্যয়ের ৬৮ দশমিক ৫ শতাংশ নিজেই বহন করেন। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গত জুলাইয়ে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, জনপ্রতি ১০০ টাকা চিকিৎসা ব্যয়ের মধ্যে রোগীকে ৭৩ শতাংশ বহন করতে হয়। এর মধ্যে ৫৪ দশমিক ৪০ শতাংশ ওষুধে, রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ২৭ দশমিক ৫২ শতাংশ। চিকিৎসকের পেছনে ব্যয় ১০ দশমিক ৩১ এবং যাতায়াতে ব্যয় করতে হয় ৭ দশমিক ৭৭ শতাংশ।
বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় ৪০ ভাগ মানুষ এখনো প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবার বাইরে। এসব দেশের সরকার স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ দেয় প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। ফলে চিকিৎসা ব্যয় প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এতে মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা পেতে আর্থিক অসুবিধার সম্মুখীন পরিবারের অনুপাত বাড়ছে। ২০১৫ সালের তুলনায় ২০২১ সালে এই অঞ্চলে যক্ষায় মৃত্যুর হার ৮ দশমিক ৬ শতাংশ বেড়েছে। চারটি প্রধান রোগ-কার্ডিওভাসকুলার, ক্যান্সার, ডায়াবেটিস এবং দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসযন্ত্রের রোগ থেকে ৩০ থেকে ৭০ বছর বয়সের মধ্যে মৃত্যুহার এখন ২১ দশমিক ৬।
বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে, দরিদ্র এবং ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠী এখনো প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে বড় বাধার সম্মুখীন হয়। তাদের স্বাস্থ্য এবং সুস্থতার জন্য বিপর্যয়কর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। দরিদ্র জীবন মানেই তাদের রোগ এবং মৃত্যুর জন্য দায়ী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদ কালবেলাকে বলেন, রোগীরা এখন বেশিরভাগ চিকিৎসা ব্যয় বহন করেন। সরকারের ব্যয় এ ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশেরও কম। এই হিসাবটা উল্টে দিতে হবে। রোগী ও তার পরিবার কোনোভাবেই ৩০ শতাংশের বেশি ব্যয় বহন করবে না। ৭০ শতাংশের বেশি ব্যয় সরকারকে করতে হবে। এজন্য শুধু বাজেটে অর্থের বরাদ্দ বাড়ালে হবে না। পুরো স্বাস্থ্য খাতের আমূল পরিবর্তন করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, সুনির্দিষ্টভাবে ব্যয়ের খাতগুলো চিহ্নিত করে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে। বিচার বিভাগের নিয়োগের মতো স্বাস্থ্য খাতে বিসিএস প্রথার বাইরে নিয়োগ কাঠামো তৈরি করতে হবে। ক্যান্সার, হৃদরোগ, কিডনি, উচ্চ রক্তচাপসহ অসংক্রামক মরণঘাতী রোগের জন্য পৃথক তহবিল করতে হবে। এখান থেকে রোগীদের চিকিৎসা ব্যয়ে ভর্তুকি দেওয়া হবে। তাহলেই সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার অঙ্গীকার পূরণ হবে।