অবশেষে নানা আলোচনা ও মতপার্থক্যকে পেছনে ফেলে আত্মপ্রকাশ ঘটল নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক কমিটির (এনসিপি)। গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে জাঁকজমক অনুষ্ঠানে এ দলের ঘোষণা দেওয়া হয়। যেখানে বিভিন্ন দলের শীর্ষ নেতা, কূটনীতিকসহ সুশীল সমাজ ও পেশাজীবী সমাজের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অগ্রভাগে থাকা একদল তরুণ-তরুণী মূলত এ দল গঠনের উদ্যোক্তা। রাজনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা বলছেন, বিলম্ব হলেও শেষ পর্যন্ত রক্তাক্ত এক বিপ্লবের ফল হিসেবে ভাষার মাস ফেব্রুয়ারির শেষ দিনে নতুন দলের আত্মপ্রকাশ হলো। আওয়ামী লীগের পতনের পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সবার প্রত্যাশা হচ্ছে, দেশের রাজনীতিতে নিজেদের শক্ত অবস্থান তৈরি করবে এনসিপি। গ্রহণযোগ্য কর্মসূচির মাধ্যমে জনসম্পৃক্ততা বাড়াবে দলটি। নতুন দলের কাছে সবাই নতুন রাজনীতিই প্রত্যাশা করছে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, ঠিক এই মুহূর্তে নতুন একটি দলের আত্মপ্রকাশ দেশের রাজনীতির জন্য জরুরি। অতীতেও দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অনেক রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। এনসিপিও তার ব্যতিক্রম নয়। গণঅভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগের পলায়নের কারণে রাজনীতিতে বিদ্যমান শূন্যতা পূরণে নতুন দলের আত্মপ্রকাশ দেশবাসীকে আশা জোগাবে। অবশ্য জাতীয় নাগরিক কমিটির তত্ত্বাবধানে নতুন দল গঠনের বিষয়কে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল সাধুবাদ জানালেও এ ব্যাপারে জাতীয় নির্বাচনের সময় অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে এরই মধ্যে প্রশ্ন তুলেছে বিএনপিসহ কয়েকটি দল। এমনকি সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে নতুন দল গঠিত হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেছেন রাজনৈতিক দলগুলোর কয়েকজন দায়িত্বশীল নেতা।
জানা গেছে, সাধারণত বাংলাদেশের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ কোনো না কোনো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক দলগুলো গঠিত হয়েছে। ১৯৪৭ সালে ভারত উপমহাদেশের বিভক্তি, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং ১৯৯০-এর দশকে সামরিক শাসক এরশাদের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন—এসব ঘটনার পর রাজনৈতিক শক্তিগুলো জনগণের আকাঙ্ক্ষা থেকে বিকশিত হয়েছে। সর্বশেষ ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। এক পর্যায়ে ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান স্বৈরাচার শেখ হাসিনা। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতা থেকে টেনে নামায় ছাত্র-জনতা। অভ্যুত্থানের প্রায় সাত মাস পর গতকাল এনসিপি নামে নতুন আরও একটি রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটল। এনসিপির তরুণ নেতৃত্ব দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তন ও গণতন্ত্রকে সুসংহত করতে এবং সব ধরনের বৈষম্যের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপি জনগণের ভোটাধিকার রক্ষা ও দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা রাখবে—এমন প্রত্যাশা বিএনপি, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন দলের। সেইসঙ্গে দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নতুন দলও ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবে বলে দলগুলোর প্রত্যাশা। গতকাল এনসিপির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিএনপি, জামায়াত, নাগরিক ঐক্য, গণসংহতি, লেবার পার্টি, জেএসডি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা।
নতুন দলের আত্মপ্রকাশ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বিএনপি সব সময় গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে এবং সেটি পরিচর্যা করে। আমরা আশা করব নতুন যে রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটল, তা দেশের গণতন্ত্রের জন্য কাজ করবে।
১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র ও বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম কালবেলাকে বলেন, ছাত্ররা মনে করেছে নতুন দলের চাহিদা আছে। আবার অনেক রাজনৈতিক বোদ্ধা মনে করেন নতুন দলের দরকার নেই। আমরা মনে করেছিলাম ছাত্ররা পড়ালেখা শেষে কোনো দলে যোগদান করবে। কিন্তু আমরা উদ্বোধন অনুষ্ঠানে এমন কিছু অতিথি পেয়েছি, যারা স্বৈরশাসকের পদলেহন করে এমপি-মন্ত্রী হয়েছেন। তারা কীভাবে দাওয়াত পেলেন, সেটি আমাদের বিস্মিত করেছে। সুতরাং নতুন দলকে স্বৈরশাসনের পদলেহনকারী, অনুপ্রবেশকারী ও সুবিধাবাদী হতে সতর্ক থেকে এগিয়ে যাওয়াটা চ্যালেঞ্জ। তাদের মধ্যে অভিজ্ঞতারও ঘাটতি আছে। তারা উদ্বোধন অনুষ্ঠানটি যথাসময়ে শুরু ও শেষ করতে পারত। তবু তারা অভ্যুত্থানের পক্ষের দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে পথ চললে কল্যাণ হবে বলে মনে করি।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর প্রচার সম্পাদক অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, নতুন রাজনৈতিক দল দেশের গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা ও স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ভূমিকা রাখবে এবং আগামী দিনের দেশ গঠনে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবে—এটিই প্রত্যাশা।
জাতীয় নাগরিক পার্টির ঐতিহাসিক আত্মপ্রকাশকে স্বাগত জানিয়ে আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি) চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু কালবেলাকে বলেন, আমাদের তরুণরা রাজনীতিবিমুখ ছিল। মতবাদ, মতাদর্শ ও পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির প্রতি নতুন প্রজন্মের কোনো আগ্রহ ছিল না। কিন্তু সেই তরুণরাই আজ অধিকারভিত্তিক বর্ণাঢ্য রাজনীতির এক অবিস্মরণীয় পথে যাত্রা শুরু করল—দেখে আমি খুবই আনন্দিত। অনেক বাধাবিপত্তি ও চ্যালেঞ্জ তাদের মোকাবিলা (ফেইস) করতে হবে। পুরোনো রাজনীতির ট্রেন্ড তাদের পেয়ে বসতে পারে, তারা সে পথকে সাহসের সঙ্গে উপেক্ষা করবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এনডিপি) চেয়ারম্যান ক্বারি আবু তাহের নতুন দলকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, আমরা বিশ্বাস করি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির সমন্বয়ে নতুন দল বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদবিরোধী এবং গণতন্ত্রের জন্য কাজ করবে। কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা ও বৈষম্যের ঠাঁই যাতে বাংলাদেশে না হয়।
অন্যদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলামিস্ট ড. মারুফ মল্লিক বলেন, পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে সব সময়ই দুটি প্রধান দলের উপস্থিতি ছিল। ব্রিটিশ আমলে কংগ্রেস গঠিত হওয়ার পর খুব বেশিদিন দলটি একক রাজত্ব করতে পারেনি। কয়েক বছর পর মুসলিম লীগ রাজনীতিতে চলে আসে। ১৯৪৭-এ দেশভাগের দুই বছরের মধ্যেই মুসলিম লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হয় আওয়ামী মুসলিম লীগ, পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর মুসলিম লীগ বিলুপ্ত হয়। আওয়ামী লীগের বিপরীতে দাঁড়ায় জাসদ। কিন্তু হঠকারী রাজনীতির জন্য রাজনীতিতে গুরুত্ব হারায় জাসদ। পরবর্তী সময়ে বিএনপি দেশের অন্যতম জনপ্রিয় দলে পরিণত হয়। ফলে দেখা যাচ্ছে, ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ, ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগ ও ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধ—প্রতিটি বড় ধরনের রাজনৈতিক পরিবর্তন বা বিপ্লবের পরপরই একটি নতুন দল গঠিত হয়েছে এবং একটি দল রাজনীতিতে গুরুত্ব হারিয়েছে বা বিলুপ্ত হয়েছে। তেমনই ২৪-এর বিপ্লবের পর আওয়ামী লীগ পালিয়ে গেছে। আন্তর্জাতিকভাবে গুরুতর মানবতাবিরোধী অপরাধকারী হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ফিরতে পারবে কি না, তা নিয়ে বড় প্রশ্ন আছে। ইতিহাসের ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন রাখতে এবারের নতুন দল হতে পারে ছাত্রদের দলটি।
তিনি বলেন, নতুন বন্দোবস্তের কথা বলে ছাত্ররা নতুন দিনের রাজনীতি করতে চান। কিন্তু আদৌ কি তারা নতুন বন্দোবস্ত করতে পারবেন? নাকি পুরোনো দিনের রাজনীতিতেই ফিরে যাবেন? আপাতত তাদের দল গঠন-পূর্ব রাজনীতি
দেখে মনে হচ্ছে, মুখে নতুন বন্দোবস্তের কথা বললেও তারা পুরোনো রাজনৈতিক চর্চাই অনুশীলন করছেন। একই সঙ্গে সরকার ও রাজনীতি—এই দুই জায়গায় নিজেদের উপস্থিতি ধরে রাখতে গিয়ে
তারা এখন ‘কিংস পার্টি’ হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছেন।
কোন প্রেক্ষাপটে কোন রাজনৈতিক দল
সিপিবি: বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) মূলত ১৯২০ সালে গঠিত অল ইন্ডিয়া কমিউনিস্ট পার্টির উত্তরসূরি সংগঠন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর দলটি কমিউনিস্ট পার্টি অব পাকিস্তান নামে পরিচিত হয় এবং ১৯৪৮ সালের ৬ মার্চ কলকাতায় অল ইন্ডিয়া কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে।
আওয়ামী লীগ: ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর প্রগতিশীল শক্তিগুলো মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক ও ডানপন্থি রাজনীতির বিরোধিতা করতে শুরু করে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমের নেতৃত্বে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের একটি অংশ ১৯৪৯ সালে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ গঠন করে। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এই দলের সভাপতি ও শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। পরে দলের ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ‘মুসলিম’ শব্দটি নাম থেকে বাদ দেওয়া হয় এবং এটি পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ হিসেবে বিকশিত হয়।
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ): ১৯৫৭ সালের জুলাই মাসে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাপ প্রতিষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগ নেতারা, বিশেষ করে মওলানা ভাসানী ও তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত ছিলেন। ভাসানীর নেতৃত্বাধীন বামপন্থি গোষ্ঠী দাবি করেছিল, বাংলাদেশকে কোনো পরাশক্তির সঙ্গে জোটবদ্ধ না হয়ে স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করতে হবে। তার অন্যতম প্রধান দাবি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের জন্য সর্বোচ্চ স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করা।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ): বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের অক্টোবরে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) গঠিত হয়। আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের বিভক্তি থেকে এই দলটি জন্ম নেয়। বামপন্থি এই দল গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন সিরাজুল আলম খান ও আ স ম আব্দুর রব।
বাকশাল: ১৯৭৫ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রবর্তিত হয় বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল)। এটি একটি একদলীয় শাসনব্যবস্থার রূপরেখা থেকে তৈরি করা হয়। বাকশালের নেতৃত্বে ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাকে হত্যাকাণ্ডের পর দেশ এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। সেই সময় থেকে জেনারেল জিয়াউর রহমান কার্যত দেশের সামরিক নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। এরপর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম ১৯৭৭ সালের এপ্রিলে পদত্যাগ করে ক্ষমতা জিয়ার হাতে তুলে দেন।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি): রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনামলে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি ১৯৭৭ সালের ৩০ এপ্রিল ১৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন, যা পরে তার রাজনৈতিক দল গঠনের পথ তৈরি করে দেয়। ১৯৭৮ সালে তার পৃষ্ঠপোষকতায় ‘জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল)’ গঠিত হয় এবং এর আহ্বায়ক ছিলেন তৎকালীন উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি আব্দুস সাত্তার। পরে জাগদল বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয় এবং ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বরে ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)’ প্রতিষ্ঠিত হয়। জেনারেল জিয়া নিজেই দলটির আহ্বায়কের দায়িত্ব নেন। বিএনপির নেতৃত্বে বামপন্থি ও দক্ষিণপন্থি—উভয় মতাদর্শের নেতারা এই দলে ছিলেন। বিএনপির ঘোষণাপত্রে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, জাতীয় অর্থনৈতিক মুক্তি, স্বনির্ভরতা এবং জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে অগ্রগতির ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়।
জামায়াতে ইসলামী: ১৯৩০-এর দশকের শুরুতে মওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদীর নেতৃত্বে ভারতে একটি ইসলামিক রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ১৯৪১ সালে মওলানা মওদুদীর নেতৃত্বে জামায়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশে ১৯৫০-এর দশক থেকে দলটির কার্যক্রম শুরু হয়। আল্লাহর ওপর বিশ্বাস ও আস্থার ভিত্তিতে দলটি বাংলাদেশে একটি ইসলামী গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও ভারসাম্যপূর্ণ অর্থনৈতিক কাঠামো প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে। দলটি রাষ্ট্রব্যবস্থায় ইসলামী আদর্শ অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে বিতর্কিত ভূমিকা এবং যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করা হয়। পরবর্তী সময়ে ১৯৭৯ সালে দলটি ফের বৈধতা পায়। সর্বশেষ ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ আমলে জামায়াত ও ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তা প্রত্যাহার করে।
জাতীয় পার্টি (জাপা): বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর তৎকালীন সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ (এইচএম) এরশাদ ১৯৮২ সালের মার্চে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। এরপর বিচারপতি এএফএম আহসানউদ্দিন চৌধুরীকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এরশাদ নিজের একটি রাজনৈতিক দল গঠনের পরিকল্পনা করেন এবং আহসানউদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে ‘জনদল’ গঠন করেন। পরবর্তী সময়ে এরশাদের উদ্যোগে ‘জাতীয় ফ্রন্ট’ নামে একটি নতুন রাজনৈতিক জোট গঠিত হয়। বিএনপির কিছু নেতা, জনদলের একটি অংশ, মুসলিম লীগ, গণতন্ত্রী দল ও ইউনাইটেড পিপলস পার্টির সদস্যরা এ ফ্রন্টে যোগ দেন। অবশেষে ১৯৮৬ সালের জানুয়ারিতে ‘জাতীয় পার্টি’ আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে, যার চেয়ারম্যান হন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।
অবশ্য জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে এরশাদ সরকার পতনের পর বাংলাদেশে বেশ কিছু নতুন রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ করে। এর মধ্যে অন্যতম ইসলামিক ঐক্য জোট। ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে ইসলামিক ঐক্য জোট প্রতিষ্ঠিত হয়। এই জোটে থাকা সাতটি দল হচ্ছে—১. খেলাফত মজলিস, ২. নেজামে ইসলাম, ৩. ফরায়েজী জামাত, ৪. ইসলামী মোর্চা, ৫. উলামা কমিটি, ৬. ন্যাপ (ভাসানী) দলের একাংশ এবং ৭. ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন। এই জোটের প্রধান লক্ষ্য ছিল একটি ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক আন্দোলন পরিচালনা করা, যা খেলাফতের আদলে ইসলামিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবে।
গণফোরাম: বিশিষ্ট আইনজীবী ও সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা ড. কামাল হোসেন ১৯৯৩ সালের আগস্টে ‘গণফোরাম’ প্রতিষ্ঠা করেন। এটি একটি উদারপন্থি দল, যা শক্তিশালী নাগরিক সমাজ এবং আইনের শাসন ও সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে।
আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টি: বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী থেকে বেরিয়ে আসা ও বহিষ্কৃতদের সমন্বয়ে রাজনৈতিক উদ্যোগ ‘জন আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ’ নামে সংগঠনটিকে রিসার্চ উইং হিসেবে রেখে ২০২০ সালের ২ মে নতুন রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। জামায়াতে ইসলামী থেকে পদত্যাগকারী এএফএম সোলায়মান চৌধুরীকে আহ্বায়ক ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি মুজিবুর রহমান মঞ্জুকে সদস্য সচিব করে আত্মপ্রকাশ করে দলটি। শুরুর দিকে অনেকে বলছিলেন যে, জামায়াতের বিকল্প কোনো দল হিসেবে এবি পার্টির জন্ম! তবে দলটির প্রতিষ্ঠাতারা দাবি করেন যে, এবি পার্টি একেবারেই স্বতন্ত্র একটি দল। ২০২৩ সালের অক্টোবরে ভাঙনের মুখে পড়েছিল এবি পার্টি। সে সময় দলের বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা আকস্মিক দল ছেড়ে সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টিতে যোগ দেন।
২০২৪ সালের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে দলটি নিবন্ধনের আবেদন করে এবং প্রাথমিক বাছাইয়েও উত্তীর্ণ হয়; কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা নিবন্ধন পায়নি। অতঃপর ২০২৪ সালের ১৯ আগস্ট হাইকোর্টের দেওয়া রায় ও আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২ অধ্যায় ৬-এর বিধান অনুযায়ী দলটিকে ‘ঈগল’ প্রতীকে নিবন্ধন দেওয়া হয়। এবি পার্টির ভাবাদর্শ হচ্ছে—‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার’। দলটির সহযোগী সংগঠন হচ্ছে বাংলাদেশ ছাত্রপক্ষ, এবি যুবপার্টি ও এবি পার্টি-মহিলা শাখা।
বাংলাদেশ গণঅধিকার পরিষদ: ২০২১ সালের অক্টোবরে ‘বাংলাদেশ গণঅধিকার পরিষদ’ নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠিত হয়। এর আহ্বায়ক হন সাবেক গণফোরাম নেতা রেজা কিবরিয়া এবং সদস্য সচিব হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সাবেক ভিপি নুরুল হক নূর।
মন্তব্য করুন