রমজানের সময়গুলো দেখতে দেখতে ফুরিয়ে আসছে। এরই মধ্যে রহমত ও মাগফিরাতের দুই দশক অতিবাহিত করে শেষ দশকের দ্বারপ্রান্তে উপনীত আমরা। এ দশকেই ইতিকাফে আত্মমগ্ন হতে হয় প্রভুর সান্নিধ্য কামনায়। ইতিকাফের নিয়তকারী ব্যক্তি ২০ রমজান আসরের নামাজের পর সূর্যাস্তের আগে মসজিদে পৌঁছাবেন এবং কোণে একটি ঘরের মতো পর্দা দিয়ে ঘেরাও করে অবস্থান নেবেন; এমনভাবে যেন প্রয়োজনে জামাতের সময় পর্দা খুলে মুসল্লিদের জন্য নামাজের ব্যবস্থা করা যায়। এ স্থানে পানাহার ও শয়ন করবেন এবং বিনা প্রয়োজনে এখান থেকে বের হবেন না। আর নারীরা ঘরের নির্দিষ্ট স্থানে, যেখানে তিনি নামাজ আদায় করেন, সেখানেই ইতিকাফ করবেন এবং ঈদের চাঁদ উদয় না হওয়া পর্যন্ত ইতিকাফের স্থান ত্যাগ করবেন না। শাওয়াল বা ঈদের চাঁদ দেখা গেলে ইতিকাফ শেষ হবে।
ইতিকাফের সময় খুব বেশি বাকি নেই। তাই এখন থেকেই ইতিকাফের প্রস্তুতি নেওয়া চাই। প্রতিটি এলাকা থেকে কমপক্ষে একজন বালেগ পুরুষ যেন ইতিকাফে বসেন। একাধিক ব্যক্তি এক মসজিদে ইতিকাফ করতে পারবেন। সবারই মনে মনে ইতিকাফে বসার নিয়ত ও আগ্রহ রাখা কর্তব্য। যিনি ইতিকাফে বসার চূড়ান্ত নিয়ত করবেন তার বিশেষ প্রস্তুতি দরকার। মসজিদে থাকতে যা যা প্রয়োজন আগেভাগেই এর ব্যবস্থা করতে হবে। ইফতার ও সেহরি কে পৌঁছাবে, বাজার করবে কে? ঈদের বাজার, ফিতরা আদায়ের ব্যবস্থা, ছেলেমেয়ের আবদার রক্ষা, কেউ কোনো টাকাপয়সা পেয়ে থাকলে তা পরিশোধের চেষ্টা করা ও আত্মীয়স্বজনকে ঈদের অগ্রিম দাওয়াত দেওয়াসহ রয়েছে নানা প্রস্তুতি। এগুলো এখনই সারতে হবে। আগেভাগে এসব কাজ সেরে আগ্রহীরা ইতিকাফের জন্য প্রস্তুতি নিন।
ইতিকাফ অবশ্য-পালনীয় কোনো ইবাদত না হলেও প্রাপ্তির দিক-বিবেচনায় এর গুরুত্ব অপরিসীম। ইতিকাফ আদায়ের মাধ্যমেই লাইলাতুল কদর নসিবের আশা করা যায়। এজন্যই এ আমলটির ফজিলত ও তাৎপর্য এত বেশি। ইতিকাফ ও ইতিকাফ-সংক্রান্ত বিধিনিষেধ পবিত্র কোরআনে এসেছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তোমরা যখন ইতিকাফ করবে তখন স্ত্রীদের সঙ্গে সহবাস করো না। এগুলো আল্লাহর বেঁধে দেওয়া সীমারেখা। সুতরাং এর কাছেও যেও না। এমনিভাবে আল্লাহ তার নির্দেশনাবলি মানুষের জন্য সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন, যাতে তারা সতর্কতা অবলম্বন করতে পারে।’ (সুরা বাকারা: ১৮৭)।
ইতিকাফের আগে আল্লাহর কাছে মনে মনে কিছু দাবি-দাওয়া স্থির করে নিলে ভালো হয়। যেগুলো আমরা মসজিদে অবস্থান নিয়ে আল্লাহর নিকট চাইব। নীরবে নিভৃতে কান্নাকাটি করে ওইসব দাবি পেশ করব। দাবি আদায়ে আল্লাহর নিকট জোরালো দরখাস্ত করব। দুনিয়াতে যেমন বিশেষ দাবিতে মানুষ রাস্তায় অবস্থান নেয় বা কারও ঘরের দরজায় লুটিয়ে পড়ে থাকে। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত ওই জায়গা ছাড়বে না ভাব ধরে। ইতিকাফটাও এমনই একটা বিষয়। ইতিকাফ মানে দুনিয়ার যাবতীয় সম্পর্ক ছিন্ন করে মহান প্রভুর নিকট বিশেষ দাবিতে তার ঘরে অবস্থান নেওয়া। এমনভাবে আবেদন করা যে, দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত এখান থেকে সরব না। আর দাবির আগে কিছু আমলও করতে হবে। ইতিকাফে বসে সৎ ও ভালো কথাবার্তা বলতে হবে। কোরআন তেলাওয়াত, জিকির-আসগার, তাহাজ্জুদ ও বিভিন্ন নফল নামাজ, দরুদ শরিফ ও ধর্মীয় কিতাবাদি পাঠ করতে হবে। বিশেষ করে হাজার মাস ইবাদতের চেয়েও বেশি সওয়াবের রাত্রি শবেকদর লাভের আশায় ২১ থেকে ২৯ রমজান পর্যন্ত বেজোড় রাত্রিগুলো ও ঈদের রাত্রিতে বেশি বেশি ইবাদত করতে হবে।
ইতিকাফ মানুষকে দুনিয়ার ঝামেলা ত্যাগ করে নিবিষ্ট মনে ইবাদতের শিক্ষা দেয় এবং অল্প সময়ের জন্য হলেও আল্লাহর সঙ্গে তার সম্পর্ক জুড়ে দেয়। এতে মানুষের পক্ষে অন্তিমকালে দুনিয়া ত্যাগ করা সহজ হয় এবং দুনিয়ার মহব্বতের পরিবর্তে আল্লাহর মহব্বত বৃদ্ধি পায়। ইতিকাফকারীর উদাহরণ সেই হাজতি ব্যক্তির মতো, যে কোনো মহান ব্যক্তির দরবারে হাত পেতে থাকে এবং বলে, যে পর্যন্ত না আমার হাজত পূর্ণ করা হয়, আমি এ দরবার ত্যাগ করব না।
অতএব, আমাদের সবারই ইতিকাফের স্বাদ নেওয়া উচিত এবং এটিকে জীবনের মহামূল্য সুযোগ মনে করা উচিত। কোনো কারণে নিজে না পারলেও অন্যকে ইতিকাফে বসার জন্য উৎসাহ দেওয়া ও ইতিকাফকারীদের সাহায্য করা।
লেখক : মুহাদ্দিস ও ইসলামী চিন্তাবিদ
মন্তব্য করুন