চট্টগ্রাম আমাদের ইঞ্জিনের মতো। শুধু বাংলাদেশ নয়, প্রতিবেশী দেশগুলোর অর্থনীতিতেও অবদান রাখার সক্ষমতা রাখে। চট্টগ্রামকে ঘিরে অনেক মেগা প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, এগুলো নির্ধারিত সময়ে শেষ করা দরকার। কোনোরকম বাধা-বিপত্তি ছাড়া এগুলোর ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে চট্টগ্রামের চেহারা বদলে যাবে, দক্ষিণ এশিয়ার হাব হয়ে উঠবে। চট্টগ্রাম এগিয়ে গেলে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশও। অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভারত-বাংলাদেশ একসঙ্গে কাজ করতে চায়।
গতকাল শনিবার চট্টগ্রাম ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের বঙ্গবন্ধু কনফারেন্স হলে ‘বাংলাদেশ-ভারত ইতিহাস ও ঐতিহ্য পরিষদ এবং উন্নয়ন সমন্বয়ের যৌথ উদ্যোগে চট্টগ্রামের উন্নয়ন ও কানেক্টিভিটি: সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ’ বিষয়ে আয়োজিত এক সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন।
অনুষ্ঠানের গেস্ট অব অনার বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চট্টগ্রামের গুরুত্ব অপরিসীম। চট্টগ্রাম এগিয়ে গেলে বাংলাদেশও এগিয়ে যাবে। অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভারত-বাংলাদেশ একসঙ্গে কাজ করতে চায়। এই আলোচনা ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তিনি আরও বলেন, কানেক্টিভিটি উন্নত করে এবং মাল্টি-মোডাল কানেক্টিভিটি প্রচার করে আমাদের পারস্পরিক সহযোগিতার বাধাগুলো দূর করতে পারব। দুদেশের প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্কের অনেক পরিবর্তন এসেছে। গত এক দশকে আমরা অভূতপূর্ব অগ্রগতি করেছি। দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলকে দীর্ঘদিন ধরে কম সংযুক্ত অঞ্চল হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। আমরা সংযোগের ব্যবধান পূরণ করতে শুরু করছি।
ভারতের হাইকমিশনার আরও বলেন, আমরা কানেক্টিভিটিকে একটি ভাগ করা আকাঙ্ক্ষার পাশাপাশি আমাদের ভবিষ্যৎ অংশীদারত্বের চালক হিসেবে দেখছি। প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারের সম্মতিমূলক অর্থায়নের সঙ্গে বাংলাদেশ বিশ্বের আমাদের বৃহত্তম উন্নয়ন অংশীদার, যা ভারত সরকার ঋণের লাইন, অন্যান্য কর্মসূচি বা বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রকল্পের অধীনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও উন্নয়ন সমন্বয়ের চেয়ারম্যান ড. আতিউর রহমানের সভাপতিত্বে এ সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন উন্নয়ন সমন্বয়ের পরিচালক (গবেষণা) আব্দুল্লাহ নদভি।
ড. আতিউর রহমান বলেন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পগুলো সম্পন্ন হলে বদলে যাবে চট্টগ্রাম। তবে শুধু প্রকল্প বাস্তবায়ন করলেই হবে না তা সমন্বয় করতে হবে। চট্টগ্রাম আমাদের ইঞ্জিনের মতো। শুধু বাংলাদেশ নয়, প্রতিবেশী দেশগুলোর অর্থনীতিতে অবদান রাখার সক্ষমতা রাখে। চট্টগ্রাম ঘিরে অনেক মেগা প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, এগুলো নির্ধারিত সময়ে শেষ করা দরকার। কোনো রকম বাধা-বিপত্তি ছাড়া, এগুলোর ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে চট্টগ্রামের চেহারা বদলে যাবে। দক্ষিণ এশিয়ার হাব হয়ে উঠবে।
আব্দুল্লাহ নদভি বলেন, চট্টগ্রাম কেবল নামে বাণিজ্যিক রাজধানী, তবে আশার কথা হচ্ছে সরকারের উচ্চপর্যায়ে চট্টগ্রাম নিয়ে গভীরভাবে ভাবা হচ্ছে। প্রকৃত অর্থে বাণিজ্যিক রাজধানী গড়ে তোলা বাংলাদেশের অর্থনীতি জন্য খুবই জরুরি। মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রামের গুরুত্ব বাড়িবে দেবে। ভারতের জন্য সহজ ও সাশ্রয়ী হবে বন্দরটি। মাতারবাড়ী বন্দর বাংলাদেশের জিডিপির ১ দশমিক ১৪ শতাংশ বৃদ্ধি করবে, এতে ৯ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। এসব কানেক্টিভিটিকে কাজে লাগাতে হলে অংশীজনের একযোগে কাজ করা জরুরি।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল বলেন, সেবার মান বৃদ্ধির জন্য মাস্টারপ্ল্যান করেছি, আমাদের গভীর সমুদ্রবন্দর মাতারবাড়ী ২-৩ মাসের মধ্যে চালু হবে। ভারতের সেভেন সিস্টার্স ও অন্যান্য প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে বাণিজ্যের দ্বার উন্মোচন করবে। চট্টগ্রাম বন্দর সবার জন্য উন্মুক্ত, এখানে যে কোনো দেশ ব্যবহার করতে পারে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক শিরীণ আক্তার বলেন, চট্টগ্রামের সঙ্গে সড়ক, রেল, নৌ এবং আকাশ পথে উন্নত যোগাযোগ রয়েছে। ভারতের হাব হিসেবে ব্যবহার করার সুযোগ রয়েছে। এতে তারাও উপকৃত হবে। আমি ভারতীয় ব্যবসায়ীদের সুযোগ গ্রহণের অনুরোধ জানাই।
বাংলাদেশ ভারত ইতিহাস ও ঐতিহ্য পরিষদের সিনিয়র সহসভাপতি প্রফেসর ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া বলেন, আমাদের জলাবদ্ধতা আমাদের বড় অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে। এটি নিয়ে কাজ করতে হবে। ট্রেড, ট্রানজিট এবং ট্যুরিজম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। উভয় দেশ এখান থেকে লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে। সহজ নৌপথ এখনো অবহেলিত রয়ে গেছে। এ জন্য কোস্টাল শিপিং কানেক্টিভিটি ম্যাপিং করা জরুরি।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক প্রশাসক মোহাম্মদ খোরশেদ আলম সুজন বলেন, ব্রিটিশ আমল থেকেই চট্টগ্রাম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে। বন্দর হচ্ছে সোনার ডিম পাড়া হাস, আমরা একে গলা টিপে হত্যা করছি। পতেঙ্গায় যদি কোনো জাহাজ ডুবে তাহলে বন্দর অচল হয়ে যায়। মাল্টিলেভেল যোগাযোগ ব্যবস্থা করা গেলে ভারত, নেপাল ও ভুটানের মধ্যমণি হয়ে উঠবে চট্টগ্রাম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন বলেন, চট্টগ্রাম ভবিষ্যতে আঞ্চলিক হাব হিসেবে গড়ে উঠবে।
ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রির নির্বাহী পরিচালক টিআইএম নুরুল কবীর বলেন, আমরা এনআইডি শুধু পরিচয়পত্র হিসেবে ব্যবহার করছি, ভারত আধারকার্ড হিসেবে নানামুখী ব্যবহার নিশ্চিত করেছে। আমাদের এনআইডির বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করা দরকার। কাস্টমস সিস্টেমকে আরও সহজীকরণ করা জরুরি।
বাংলাদেশ ভারত ইতিহাস ও ঐতিহ্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলামের সঞ্চালনায় সেমিনারে আরও বক্তব্য দেন চট্টগ্রাম চেম্বারের সিনিয়র সহসভাপতি তরফদার রুহুল আমীন, চেম্বারের পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ, গালফ টেইনারের প্রতিনিধি জিনা সুজিত, সমুদ্র যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ড. আলমগীর আক্তার সর্দার, ইশাত গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাকিবুল হাসান সোহেল, এমকে শিপিং লাইনসের কর্ণধার মাসুম খান, নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন, নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক প্রদীপ দাশগুপ্ত প্রমুখ।
সেমিনারে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন বাংলাদেশ-ভারত ইতিহাস ও ঐতিহ্য পরিষদের চট্টগ্রাম বিভাগীয় প্রধান তারিকুল ইসলাম জুয়েল। এই অনুষ্ঠানে সহকারী ভারতীয় হাইকমিশনার, চেম্বারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
মন্তব্য করুন