

ঢাকার রমনা কালীমন্দির প্রাঙ্গণে উৎসবের আমেজে জমে উঠেছে ভিন্নরকম এক বাজার। এখানে সাজসজ্জা নয়, আলোকিত হওয়ার কারণ হলো সুবিধাবঞ্চিত শিশু ও তাদের পরিবারের জন্য ‘১ টাকায় পূজার বাজার’। বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে মাত্র এক টাকায় নতুন পোশাক কিনতে পারছে পথশিশুরা।
মন্দিরে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে রংবেরঙের পোশাকের স্টল। নতুন জামা, শাড়ি, ফ্রক আর শার্ট ঝুলছে ছোট্ট এক স্টলে। সেই স্টলে কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক ব্যস্ত পোশাক গুছিয়ে রাখতে। এমন সময় মন্দিরের গেট দিয়ে ঢুকে পড়ে ৬-৮ জন পথশিশু। তাদের চোখে বিস্ময়, মুখে উচ্ছ্বাস। ‘আমার ওই লাল জামাটাই চাই!’—চিৎকার করে ওঠে এক কিশোরী। পাশ থেকে আরেকজন বলে, ‘আপু, ওই নীল ফ্রকটা দিয়া দেন।’ মুহূর্তেই ভাঙল নীরবতা। মন্দির প্রাঙ্গণ ভরে উঠল শিশুদের হাসি, বায়না আর আনন্দের কলতানে।
শহীদ মিনার এলাকায় ফুল বিক্রেতা সাত বছরের সুমাইয়া আজ হাতে ধরে রাখছে গোলাপি রঙের একটি ফ্রক। খিলখিলিয়ে হেসে বলল, ‘একটা আপু বলছিল এখানে নাকি ১ টাকায় জামা পাওয়া যায়। আমি ভাইকে নিয়াই আইলাম। দেখি সত্যি কথা! আমি আর ভাই দুইজনের জন্য দুইটা জামা নিলাম, মাত্র ২ টাকায়! বিশ্বাস করতে পারছি না।’
আট বছরের রনি প্রথমবারের মতো নিজের টাকায় নতুন জামা কিনেছে। ছোট্ট শরীরে নতুন শার্টটা গায়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আয়নার সামনে। সে জানাল, ‘ঈদের সময় সবসময় পুরান জামা পরি। এইবার প্রথমবার নিজের টাকায় নতুন জামা কিনলাম। মনে হইতেছে আমিই দুনিয়ার বড়লোক।’
আজিমপুরে চুড়ি বিক্রি করে সংসারে সাহায্য করে ১০ বছরের লাবনী। ১ টাকায় ফ্রক কিনে ছলছল চোখে সে বলল, ‘মনে হইতেছে আমারও পূজা লাগছে।’ এই আয়োজনে শুধু শিশুরাই নয়, নিম্ন আয়ের পরিবারের বাবা-মায়েরাও জায়গা পেয়েছেন। চল্লিশ বছরের শেফালি বেগম হাতে একটা হালকা সবুজ শাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে। বললেন, ‘আমি নিজের জন্য অনেক বছর কিছু কিনিনি। মাইয়াগো জন্যই সবকিছু লাগে। কিন্তু এখানে তিনটা টিকিট পাইছি। তাই মাইয়াগো জন্য জামা আর নিজের জন্য একটা শাড়ি নিলাম।’
রিকশাচালক আলমগীর হোসেন বলেন, ‘সারাদিন রিকশা চালাই, সংসার চালাইতে কষ্ট হয়। বাচ্চাগো কোনোদিন দোকানে নিয়াই জামা কিনাই নাই। এখানে ১ টাকায় পাইছি। এখন আমার ছেলেমেয়েরে কইতে পারব তোমাগোর জামা বাবা কিনে দিছে।’
বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের অপারেশনাল ম্যানেজার আবু হাসনাত দিপু বলেন, ‘আমরা চেয়েছি সুবিধাবঞ্চিত মানুষের মুখে উৎসবের হাসি ফুটুক। এই কর্মসূচি শুধু হিন্দুদের জন্য নয়, সব ধর্মের মানুষের জন্য। প্রতিদিন দুই থেকে আড়াইশ মানুষ নতুন জামা কিনছে। আমরা আগে থেকেই তাদের সিলেক্ট করেছি, টোকেন দিয়েছি। সেই টোকেন নিয়েই তারা এসে পোশাক বেছে নিচ্ছে।’
ফাউন্ডেশনের কমিউনিকেশন হেড মিজানুর রহমান বলেন, এই কর্মসূচির উদ্দেশ্য হলো—শুভেচ্ছা মূল্য হিসেবে ১ টাকা নেওয়া, যাতে তাদের আত্মসম্মান বজায় থাকে। এই উদ্যোগ শুধু পোশাক বিতরণ নয়, এটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিরও প্রতীক। হিন্দু, মুসলিম, খ্রিষ্টান—সব ধর্মের মানুষই এখানে একসঙ্গে দাঁড়িয়ে নিজেদের পছন্দের পোশাক কিনছেন।
মন্তব্য করুন