গাইবান্ধা প্রতিনিধি
প্রকাশ : ০৬ অক্টোবর ২০২৫, ০৩:৩৮ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

কষ্টে দিন যাচ্ছে ‘এক টাকার মাস্টারের’, কেউ খবর রাখে না 

মাত্র এক টাকার বিনিময়ে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষার আলো ছড়িয়ে যাচ্ছেন শিক্ষক লুৎফর রহমান। ছবি : কালবেলা
মাত্র এক টাকার বিনিময়ে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষার আলো ছড়িয়ে যাচ্ছেন শিক্ষক লুৎফর রহমান। ছবি : কালবেলা

গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার গিদারী ইউনিয়নের বাগুড়িয়া গ্রামের মো. লুৎফর রহমান (৮০)। স্থানীয়দের কাছে তিনি পরিচিত ‘এক টাকার মাস্টার’ নামে। গত অর্ধশতাব্দী ধরে মাত্র এক টাকার বিনিময়ে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষার আলো ছড়িয়ে যাচ্ছেন এই প্রবীণ শিক্ষক।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই, ১৯৭২ সালে গুণভরি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন লুৎফর রহমান। কিন্তু চরম দারিদ্র্যের কারণে আর কলেজে ভর্তি হতে পারেননি। তবু তিনি শিক্ষা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেননি। নিজের না পাওয়া শিক্ষার কষ্টকে প্রেরণা করে তিনি শিশুদের ঝরে পড়া ঠেকাতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে পড়ানো শুরু করেন। শুরুতে বিনা পয়সায়, পরে প্রতিদিন মাত্র এক টাকা করে নেওয়া শুরু করেন।

লুৎফর রহমানের জীবনে এসেছে নানা দুঃসময়। একসময় তার পরিবার ছিল সচ্ছল। কিন্তু ১৯৭৪ সালের ভয়াবহ বন্যা ও নদীভাঙনে সব হারিয়ে ওয়াপদা বাঁধের পাশে ছোট্ট একটি টিনের ঘরে আশ্রয় নিতে হয়। সেখান থেকেই শুরু হয় তার দীর্ঘ সংগ্রামের পথচলা।

বর্তমানে তিনি স্ত্রী লতিফুন বেগম, দুই ছেলে ও দুই মেয়েকে নিয়ে সেখানে বসবাস করছেন। বড় ছেলে লাভলু অটোরিকশা চালিয়ে সংসার চালান, ছোট ছেলে মশিউর দাওরায়ে হাদিস (মাস্টার্স সমমান) সম্পন্ন করেছেন।

অভাব নিয়ে প্রতিদিন সকালে সাইকেলে চেপে বা হেঁটে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে ছুটে বেড়ান লুৎফর রহমান। উদ্দেশ্য একটাই— শিক্ষার আলো পৌঁছে দেওয়া। বাগুড়িয়া, মদনেরপাড়া, পুলবন্দি, চন্দিয়া, কঞ্চিপাড়া, মধ্যপাড়া ও পূর্বপাড়াসহ আশপাশের অন্তত সাত-আটটি গ্রামে তিনি নিয়মিত পড়ান ৩০-৪০ জন শিক্ষার্থীকে। কোথাও রাস্তার ধারে, কোথাও গাছতলায় কিংবা বাঁধের ওপর বসেই চলে ক্লাস।

তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী আয়শা আক্তার বলেন, ‘স্যার খুব আদর করে পড়ান। আমরা না এলে নিজেই বাড়ি গিয়ে ডাকেন। তার কাছে পড়তে খুব ভালো লাগে।’

আরেক শিক্ষার্থী রুপা আক্তার বলেন, ‘আমরা প্রতিদিন স্যারকে এক টাকা করে দিই। স্যার আমাদের এত সুন্দরভাবে বুঝিয়ে পড়ান, না বুঝলে বারবার ব্যাখ্যা দেন। একবার না পারলে তিনবার করে শিখায় তবুও পড়া শিখিয়ে যায়।’

শিক্ষার্থীদের অভিভাবক জয়নব বেগম বলেন, ‘লুৎফর স্যার এই এলাকার গর্ব। এখন এক শিশুকে প্রাইভেটে পড়াতে ১ থেকে দেড় হাজার টাকার বেশি খরচ হয়, কিন্তু তিনি নামমাত্র টাকায় বাচ্চাদের শিক্ষা দিচ্ছেন। তার ছাত্ররা এখন অনেকেই বিসিএস কর্মকর্তা ও বিভিন্ন ভালো প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছে।’

নিজের জীবনের গল্প তুলে ধরে লুৎফর রহমান বলেন, ‘ম্যাট্রিকের পর অর্থাভাবে কলেজে ভর্তি হতে পারিনি। সেই না-পাওয়ার কষ্টই আজও তাড়িয়ে বেড়ায়। তাই আমি চাই না আমার এলাকার কোনো শিশু পড়াশোনা থেকে পিছিয়ে থাকুক। প্রথমে বিনা পয়সায় পড়াতাম, পরে নামমাত্র এক টাকা নিতে শুরু করি। কেউ না দিলেও কিছু বলি না। আমার অনেক ছাত্র এখন ডাক্তার, প্রভাষক, সেনাবাহিনী, পুলিশ, অধ্যক্ষ— ওদের সাফল্যই আমার সবচেয়ে বড় পাওয়া।’

তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমানে খুব কষ্টের মধ্যে আছি। অর্থাভাবে দিন কাটছে। ঠিকমতো সংসার চালাতে পারছি না, তারপরও শিশুদের এখনো বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে পড়াচ্ছি‌। শিশুদের পড়াতে গেলেই অভাবের কথা ভুলে যাই। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আমার এই কাজ আমি অব্যাহত রাখতে চাই। শিশুদের না পড়াতে গেলে আমি এমনিতেই অসুস্থ হয়ে যাব। এই কাজটি আমার প্রতিদিনের রুটিন। এক ধরনের নেশাও বলতে পারেন।’

‘এক টাকার মাস্টার’ এই শিক্ষক বলেন, ‘মোবাইল একটা ছিল আমার তাও এখন আর চলে না। এজন্য অনেক ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ হয় না। অপরদিকে সাইকেলটাও আধা-মরা কখন যে নষ্ট হয়। বর্তমানে কষ্টেই দিন যাচ্ছে, তবে খবর কেউ রাখে না।’

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ছাত্র বা শুভাকাঙ্ক্ষী তাকে সামান্য ১০০ টাকা দিলে তিনি খুশিতে আত্মহারা হয়ে যান। নিতে না চাইলেও জোর করে তারা দেন। তবে নাম-পরিচয় জানাতে অনিচ্ছুক এক শুভাকাঙ্ক্ষী বলেন, ‘সে খুব অভিমানী মানুষ। পেটে ক্ষুধা থাকলেও কখনো বলে না ক্ষুধার কথা। আমি ব্যক্তিগত ভাবে মাঝে মধ্যে চা খাওয়ার টাকা-পয়সা দিই। তবে তিনি নিতে সবসময় নারাজ থাকেন।’

গাইবান্ধা প্রেস ক্লাবের সভাপতি ও শিক্ষাবিদ অমিতাভ দাশ হিমুন কালবেলাকে বলেন, ‘লুৎফর রহমান মাস্টার ৭০-এর দশকের শুরু থেকে শিক্ষা বিস্তারে অনন্য ভূমিকা রেখে আসছেন। তিনি শুধু বাগুড়িয়া নয়, আশপাশের আট-দশটি গ্রামের শত শত সুবিধাবঞ্চিত শিশুর হাতেখড়ি করিয়েছেন। তিনি একজন নির্লোভ, নিঃস্বার্থ মানুষ। সমাজের বিত্তবান ও প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের উচিত তার পাশে দাঁড়ানো।’

এক টাকার বিনিময়ে ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে শিক্ষা দান— এ যেন টাকার বিনিময়ে নয়, মানবতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত। লুৎফর রহমানের এই ত্যাগ, মমতা ও নিবেদন আজও উত্তরবঙ্গের গ্রামীণ শিক্ষায় প্রেরণার বাতিঘর হয়ে জ্বলছে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ফুটবলের সঙ্গে আবেগ-ভালোবাসা মিশে আছে : বাসস চেয়ারম্যান

আন্দোলনের মুখে শিক্ষক-কর্মচারীদের বাড়ি ভাড়া নিয়ে নতুন প্রস্তাব

পবিত্র কোরআন অবমাননার বিচারের দাবিতে জবি শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ

ব্লাড সুগার বাড়ানো থেকে রক্ষা পেতে বাদ দিন সকালের ৪ খাবার

আশুলিয়ায় পোশাক কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড, চার ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে

শেখ হাসিনার বিষয়ে দুই দেশকে কী করতে হবে, জানালেন বিক্রম মিশ্রি

দাফনের ১৯ দিন পর স্কুলছাত্রীর লাশ উত্তোলন

ভালোবাসার শিখরে থেকেই বিদায় নিতে চান তাহসান

ছাত্রদলে যোগ দিলেন বৈষম্যবিরোধীর পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থী

বিচ্ছেদের পথে থাকে যেসব ছোট ছোট কারণ

১০

দেশের জন্য উৎসর্গ প্রাণ, বাবার দেখা হলো না সন্তানের মুখ

১১

সব দল একমত হলে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন হওয়া সম্ভব : গোলাম পরওয়ার

১২

ডা. আজিজুর রহমান মারা গেছেন

১৩

নির্বাচনী জোটে যাওয়া নিয়ে সিদ্ধান্ত জানাল বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস

১৪

তারেক রহমানের বক্তব্যের প্রশংসায় শিশির মনির

১৫

বিসিবি নির্বাচন / ভোট গণনার সময় যে বার্তা দিলেন তামিম

১৬

ব্রহ্মপুত্র নদে ভেসে আসছে হাজার হাজার গাছের গুঁড়ি

১৭

গবেষণা / ঘুম না হলে সহজ ব্যায়ামে মিলতে পারে সমাধান

১৮

ইউপি সদস্যকে কুপিয়ে হত্যা

১৯

বিসিবি নির্বাচনের ভোটগ্রহণ শেষ, চলছে গণনা

২০
X