সবার মঙ্গল কামনায় শঙ্খধ্বনি ও কৃষ্ণ নামে অনুষ্ঠিত হলো শ্রীশ্রী জগন্নাথদেবের রথযাত্রা মহোৎসব-২০২৩। বৈরী আবহাওয়া উপেক্ষা করেও এই উৎসবে শামিল হন হাজারো মানুষ। আয়োজনের পুরোভাগে ছিল আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ-ইসকন বাংলাদেশ।
গতকাল মঙ্গলবার রথযাত্রাটি রাজধানীর স্বামীবাগের ইসকন মন্দির থেকে বের হয়ে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে গিয়ে শেষ হয়। এতে ঢাকাসহ আশপাশের জেলা-উপজেলা থেকে আসা ভক্তরা অংশ নেন। সাত দিন পর আগামী মঙ্গলবার ঢাকেশ্বরী মন্দির থেকে ইসকন মন্দিরে আসবে উল্টোরথ।
উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। রথযাত্রা উপলক্ষে অগ্নিহোত্র যজ্ঞ (বিশ্ব শান্তিকল্পে), আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, পদাবলি কীর্তন, ধর্মীয় নাটকসহ আট দিনব্যাপী নানা আয়োজন করা হয় ইসকন মন্দিরে। উল্টো রথযাত্রায় প্রধান অতিথি থাকবেন স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য। বিশেষ অতিথি থাকবেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন।
প্রতিবছর চন্দ্র আষাঢ়ের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে শুরু হয় শ্রীশ্রী জগন্নাথদেবের রথযাত্রা। এর ৯ দিনের মাথায় অনুষ্ঠিত হয় উল্টো রথযাত্রা। তবে এবার বিশেষ কারণে উল্টো রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হবে এক দিন আগে। করোনার কারণে দুই বছর বন্ধ থাকার পর এবার কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে মহাধুমধামে পালিত হলো এ উৎসব।
রথযাত্রা বিভিন্ন নামে পরিচিত। পুরী জগন্নাথদেবের মন্দির থেকে জগন্নাথদেবের রথযাত্রার প্রচলন হয়। দেশেও রথযাত্রা হিন্দুদের একটি পবিত্র উৎসব। রথযাত্রায় অংশ নিয়ে তাঁতীবাজারের বাসিন্দা সুমিতা বসু বলেন, ‘প্রভু জগন্নাথ, বলদেব ও সুভদ্রা মা আজ আমাদের কৃপা করবেন বলে ধরাধামে এসেছেন। আজ প্রার্থনা করব প্রভু যেন সব সংকট সমাধানে আমাদের সাহস ও শক্তি জোগান। আমাদের মন যেন সবসময় তার চরণে নিবেদিত থাকে।’
হিন্দুদের ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী, এদিন প্রভু জগন্নাথ, প্রভু বলদেব ও মাতা সুভদ্রা দেবী নিজ বাড়ি থেকে যাবেন মাসির বাড়ি। সেখানে সপ্তাহকাল থেকে ফিরবেন নিজ গৃহে। সে অনুযায়ী, মঙ্গলবার বিকেলে ইসকন মন্দির থেকে আলাদা ৩টি রথে করে দেবদেবীদের নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকেশ্বরী মন্দির প্রাঙ্গণে। ইসকন মন্দির থেকে বিশাল শোভাযাত্রা ঢাকার টিকাটুলী, মতিঝিল, দৈনিক বাংলা, গুলিস্তান, প্রেস ক্লাব, দোয়েল চত্বর হয়ে পৌঁছায় ঢাকেশ্বরী মন্দির প্রাঙ্গণে।
ইসকন অধ্যক্ষ চারুদাস ব্রহ্মচারী বলেন, ‘ভক্তের বিরহে ভগবানের করুণাঘন রূপই জগন্নাথ রূপ। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দ্বারকায় থাকাকালীন বৃন্দাবনবাসী ভক্তরা তার জন্য তীব্র বিরহ অনুভব করছিলেন এবং তিনিও সেই ভক্তদের বিরহে অত্যন্ত ব্যাকুল ছিলেন। ভক্তবিরহ-কাতর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এক দিন তার ভ্রাতা বলরাম, ভগিনী সুভদ্রাসহ কিছুকালের জন্য দ্বারকা থেকে রথে চড়ে বৃন্দাবন যাত্রা করেছিলেন। গৌড়ীয় বৈষ্ণবগণ সেই মনোভাব নিয়ে রথযাত্রা পালন করেন।’
তিনি বলেন, ভগবান জগন্নাথদেব স্বয়ং মন্দির থেকে রাজপথে বেরিয়ে আসেন তাদের দর্শন দানের জন্য। তিনি তার দুই বাহু সামনে প্রসারিত করেন। সবাইকে তার কৃপা লাভের জন্য আহ্বান করেন এবং করুণাসিক্ত অপলক নেত্রে তিনি সবার প্রতি তার করুণাদৃষ্টি দান করেন।
রথযাত্রার সামাজিক দৃষ্টিকোণ নিয়ে তিনি বলেন, ‘জগন্নাথদেবের রথযাত্রা মহোৎসবের উল্লেখযোগ্য দিক হলো এর সামাজিক মেলবন্ধন। জগন্নাথ শব্দের অর্থ—জগতের নাথ তথা সবার পরম প্রভু। জগন্নাথ সবার নাথ, তার কাছে ব্রাহ্মণ-শূদ্র, ধনী-দরিদ্র, সাদা-কালো প্রভৃতি মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ নেই। সেজন্য জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমাজের সব শ্রেণির মানুষ এ রথযাত্রায় অংশগ্রহণ করতে পারে। এভাবে সবার মধ্যে সৌহার্দ্য, মৈত্রী, ভ্রাতৃত্ববোধ তথা সামাজিক মেলবন্ধন গড়ে ওঠে। গড়ে ওঠে হিংসা-বিভেদহীন এক সুশৃঙ্খল সমাজ।’
মন্তব্য করুন